শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা

তুহিন ওয়াদুদ

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা

সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘কবিতাসমগ্র-৩’ এর প্রসঙ্গ-কথা অংশে কবিতাবিষয়ক সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, মানুষে-মানুষে সাঁকো তৈরির কাজ করে কবিতা। যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানুষ চলে তাকে মূর্ত করে তোলাই কবিতা তথা অন্যান্য শিল্পেরও কাজ বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন- ‘কবিতারই বটে; সময়ের অনুরণন, জীবন ভাবনা ও আত্মিক অনুভবের সবচেয়ে নিপুণ ও সাংকেতিক, প্রায় মন্ত্রতুল্য, প্রতীক ও রূপনির্ভর প্রকাশ-কবিতা।’ কবির উদ্ধৃতাংশ কবিতার জন্য যথাযথ। কবির কবিতাবিষয়ক যে বিশ্লেষণ এবং তাঁর কবিতা কতখানি সেই বিশ্লেষণ অভিমুখী তারই সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ-প্রয়াসী এ আলোচনা।

শিল্পী মাত্রেরই অগাধ কল্পনা শক্তি থাকে। শিল্পের পথযাত্রীদের প্রাথমিকভাবে সামর্থ্য না থাকলে তাদের সৃষ্টি মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। এটাই তাদের নিয়তি। এ কল্পনাশক্তি কতখানি বাস্তবানুগ তা পাঠকের মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ সূচকে বিবেচিত হয়। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর রচনায় সময়ের অনুরণন ঘটিয়েছেন প্রতিনিয়ত। তিনি ভাববিলাসী নন। জীবনবাদী লেখক। দেশ-কাল-মাটি-মানুষ এক কথায় নিত্যজীবন তাঁর ক্ষেত্রভূমি। নিজের অভিজ্ঞতাকে মূর্ত করে তোলার যে বাণী তিনি রচনা করেছেন তার প্রয়োগও আছে নিজ লেখনীতে। ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখায় ভাস্বর হয়ে আছে। তিনি ভুলে যাননি দেশ। অসহায় গ্রামীণ কিংবা নাগরিক জনাকীর্ণ জনপদের অতলে থাকা নিরন্ন মানুষও আছে তাঁর লেখায়।

‘ফিরে এসো বাংলাদেশ’ সৈয়দ শামসুল হকের অনন্য কবিতা। এ কবিতায় কবির কালিক ভাবনা ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠেছে। সময়ের দগদগে ক্ষত তিনি এঁকে দিয়েছেন কবিতার ছত্রে ছত্রে। ‘সময়ের অনুরণন’ কবিতায় থাকবে বলে তিনি স্বগোক্তি করেছেন তা তাঁর লেখাতে বরাবরই চিত্রিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে অকল্পনীয় এক ত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ সেনাশাসনকালে পথ হারিয়েছিল। কবি সেই বাস্তবতাকে কবিতায় পঙ্ক্তিবদ্ধ করেছেন। স্বদেশের বিপন্নতা কবিকে আঘাত করেছিল। সময়ের বিবর্ণ রূপ তাই ঝরে পড়েছে লেখায়। ইতিহাসের পাঠ, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ, সমাজতাত্ত্বিকের বিশ্লেষণ, নীতিবোধের বিচার আর কবিতার বোধ এক নয়। সবই স্বতন্ত্র। ভিন্ন ধারায় ভিন্ন পদ্ধতিতে সময়কে দেখা হয়। এমনকি শিল্পের মাত্রা বিশেষে ভিন্নভাবে হয় তার উপস্থাপন। কথাশিল্পের হাত ধরে যে সংকট বিস্তারিত লিখিত হয় সেই শিল্পই কবিতায় তুমুল সংযমী। এখানে অপ্রয়োজনীয় একটি দাঁড়ি, কমাও বাহুল্য। একজন চিত্রকর যেমন চূড়ান্ত বোধের প্রয়োগে রঙের আঁচড় দেন, কবিও তেমনি একেকটি শব্দ নিয়ে খেলা করেন।

সময়চিত্র যখন কবিতায় ছায়াচিত্র হয়ে ওঠে তখন কবিরা আলোকচিত্রীর কাজ করেন না, করেন এক সূক্ষ্ম জীবনশিল্পীর কাজ। যিনি কবিতাকে সাজাতে কল্পলোকে বোধের সমগ্র জগৎ ক্ষণকালেই পরিভ্রমণ করেন। সৈয়দ শামসুল হক চিত্রিত শিল্পের মধ্যে সময়ের ধ্বনি বেজে ওঠার কথা বলেছেন। তাঁর লেখনীতেও সেই সময় জ¦লজ¦ল করছে।

‘এখনো বাংলার বুকে’ কবিতায় সময়কে পরোক্ষ ভঙ্গিতে তুলে ধরতে কবি কয়েকটি আস্তরণ গেঁথেছেন। প্রকৃতি, ইতিহাস এবং সমাজের আস্তরণ সেসব। আস্তরণ ঠেলে ‘সময়ের অনুরণন’ উপলব্ধি করা যায়। কবির কল্পনাবিহার সর্বব্যাপী। সেসব বিহার শেষে আমাদের বুঝে নিতে বেগ পেতে হয় না যে কবি সমকালে ফিরেছেন গভীরভাবে। অতীতের ভাঁজে ভাঁজে যত অর্জন সেসব যেন ফিরে আসে আমাদের সময় পৃষ্ঠে।

সৈয়দ শামসুল হকের রচনার প্রধান প্রবণতা জীবন ভাবনা। আনন্দের আবরণ হিসেবে তিনি শিল্প সৃষ্টিতে প্রয়াসী হয়ে ওঠেননি। জীবনের প্রতি, সমাজের প্রতি, ইতিহাসের প্রতি, অনাগত কালের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা থেকে তিনি উৎসারিত। কবিতার জন্য ‘জীবন-ভাবনা’ কথাটি তিনি নিজের মধ্যে ধারণসাপেক্ষে বলেছেন। সৈয়দ শামসুল হক জীবন-ভাবনা বুননের কারিগর। তাঁর সব কবিতার মধ্যেই জীবনবোধ উন্মীলিত। রূপক এবং রূপকের আড়ালেও জীবনবোধের ছবি। কবি জীবনতরঙ্গ নিবিড়ভাবে দেখতে চান। সব অন্ধকার ঠেলে আলোকিত জীবন দেখার অভিপ্রায় কবির।

কবিতা জন্ম নেওয়ার আগে বিমূর্ত রূপে কবিতা আত্মিক অনুভবের মধ্যেই থাকে। ক্রমে ক্রমে তা মূর্ত হয়ে ওঠে। কবিতার ঔরস কিংবা গর্ভ যা-ই বলা হোক না কেন তা আত্মিক অনুভব, কবির ভাবকাঠামো। সেই অনুভূতি শব্দের ব্যঞ্জনায় চরণে চরণে বিধৃত হয়। যত খ্যাতিমান কিংবা অখ্যাত কবি আছেন সবারই পুঁজি আত্মিক অনুভব। কিন্তু সেই অনুভবের বিস্তৃতি, গভীরতা আর সুষম বিন্যাস কবিতাকে উচ্চমাত্রা দান করে। সৈয়দ শামসুল হক কবিতায় আত্মিক অনুভবের অনিবার্য অনুষঙ্গের কথাই বলেছেন। বিশেষত সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় আত্মিক আনুভবের যাত্রাপথ সর্বদাই সমৃদ্ধ। যে পথ তিনি রচনা করেন সে পথ দীনতায় মলিন নয়। তিনি কবিতার একটি আত্মিক অনুভব প্রতিষ্ঠা করার জন্য বৈচিত্র্যপূর্ণ এমন সব শব্দ নিয়ে আসেন যেগুলোর বিশেষত্বে কবিতা বিবিধ মাত্রায় উন্নীত হয়। তারপরও সেখানে এমন এক অখ- অনুভব প্রতিষ্ঠিত হয় যেটি হয়ে ওঠে কবিতার মূলসুর। তাঁর বহুল পঠিত এবং পরিচিত কবিতাগুলোর মধ্যে একটি ‘আমার পরিচয়’ কবিতা। এখানে উত্তম পুরুষের বর্ণিত পরিচিতিমূলক অভিব্যক্তি অনুভবের গাঢ়তায় হেঁটে এসেছে ইতিহাসের পথ ধরে। কিন্তু সেই উত্তম পুরুষের ‘আমি’র মধ্যেই যেন গড়ে উঠেছে জাতির চরিত্র। ব্যক্তি মুহূর্তেই হয়ে ওঠেন কালনিরপেক্ষ অমোঘ চরিত্র। এ কবিতায় চর্যাপদ, সওদাগরের ডিঙা, কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম, পালযুগ, চিত্রকলা, বৌদ্ধবিহার, মন্দির বেদি, সোনা মসজিদ, আউল-বাউল, বারোভূঁইয়া, মহুয়ার পালা, তিতুমীর, হাজী শরীয়ত, গীতাঞ্জলি, অগ্নিবীণা, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, জয়নুল, অবন ঠাকুর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমান একে একে কবিতার অঙ্গবিনির্মাণের উপাত্তে পরিণত হয়েছে। ফলে যে ‘আমি; আর যে ‘আমার’ এর বিস্তৃতি ঘটেছে তা মূলত কবির গভীর আত্মিক অনুভবের বয়ানমাত্র।

কবিতা তো কোনো ঘটনার প্রত্যক্ষ বয়ান নয় আবার কখনো কখনো পরোক্ষ বয়ানও বটে। সূক্ষ্ম নৈপুণ্য না থাকলে অন্তত কবি আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। নিপুণ বিনির্মাণই হচ্ছে কবি-কীর্তি। কবিতায় ‘নিপুণ’ শব্দের বিশ্লেষণ এক দীর্ঘ আলোচনা। সংক্ষেপে এটুকু বলা যায় কবিতাশিল্পের জন্য এ গুণ পরিহার্য হলে সেটি আর কবিতা থাকে না।

সাংকেতিকতা কবিতার অলঙ্কার। একেকটি সংকেত কবিতার গভীরে প্রবেশের একেকটি প্রচ্ছন্ন পথ। সেই প্রচ্ছন্নতার আলো-আঁধারি দূর করে একজন পাঠককে পৌঁছতে হয় কবির ভাবকল্পনায়। যেটি কবি রচনার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে কবিবোধে জন্ম নিয়েছিল। তবে অবিকৃতভাবে কবির ভাবকল্পনায় পৌঁছানো সব সময় সব পাঠকের পক্ষে সম্ভব নয়। এমনও হতে পারে কবির মূল ভাবনা অনুসারী পাঠক নাও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কবিতার বুনন সাংকেতিকতার ওপর নির্ভর করে অনেকখানি।

কবিতার মূল্যায়ন করতে সৈয়দ শামসুল হক কবিতাকে ‘প্রায় মন্ত্রতুল্য’ অভিধা দিয়েছেন। মন্ত্রতুল্য না হলে পাঠক একটি কবিতা কেন বারংবার করে পাঠ করবেন। কেন পাঠ শেষেও মনের মধ্যে ঢেউ তোলে ক্রমাগত। কবিতার মধ্যে অনেক আলো-আঁধারি থাকে। শব্দের ব্যঞ্জনায় অর্থের গভীরতা বিবিধ মাত্রা লাভ করে। ফলে কবিতা মন্ত্র না হলেও এর মধ্যে এমন অব্যক্ত ভাব থাকে যা মন্ত্রের মতো টানে। জাদুকরী শক্তির আধার হয়ে ওঠে কবিতা। সৈয়দ শামসুল হকের নিজস্ব উপলব্ধি আর সৃষ্টিতে কোনো বিরোধ নেই। তিনি একটিও মন্ত্র লেখেননি। লিখেছেন কবিতা। কিন্তু সেই কবিতায় আছে মন্ত্রমুগ্ধতা। তবে কোন কবিতা কোন পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষণ করছে তা পাঠক এবং কবিতার মধ্যে সম্পর্কের বিষয়। কবি মানুষে মানুষে যে সাঁকো নির্মাণের কথা বলেছেন সেই সাঁকো যেন পাঠক এবং কবির মধ্যে ক্রমাগত রচিত হতে থাকে। কোনো পাঠক হয়তো টগবগে উচ্চারণে মুগ্ধতার সন্ধান করেন, কোনো পাঠক হয়তো নরম-কোমল শব্দব্যঞ্জনায় আকৃষ্ট হন। তবে শিল্পস্রষ্টাকেই মুগ্ধতার অপার ক্ষেত্র রচনা করতে হয়। সৈয়দ শামসুল হক যে কাজটি মৃত্যুশয্যায় থেকেও করে গেছেন।

প্রতীকী ব্যঞ্জনা কবির একটি বড় গুণ। যেমন দেখেছি তেমনটি বিধৃত করলে সেটি কবিতা হয়ে ওঠে না। রহস্যপূর্ণ সৌন্দর্য কিংবা অন্য কিছুকে আশ্রয় করে কবিতার মধ্যে তরঙ্গ সৃষ্টি হলে পাঠকের মননে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয় সেখানেই কবিতার সার্থকতা। সৈয়দ শামসুল হক সময়-জীবন-অনুভব-সংকেত-প্রতীক এগুলোর রূপনির্ভর প্রকাশকে কবিতা বলেছেন। প্রতীকের বিবেচনায় নিপুণ হওয়ার কথাও বলেছেন। নিজের কবিতায় তাঁর অযুত ছাপ তিনি রেখে গেছেন। তাঁর ‘পাখি বিষয় কবিতা’ নামে একটি কবিতা আছে। এই কবিতা পাঠ করলেই বোঝা যাবে এখানে অসংখ্যবার পাখির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এটি পাখিবিষয়ক কবিতা নয়। পাখির জীবন, পাখির বৃত্তান্ত এখানে অনুপস্থিত। এ কবিতা মূলত মানুষের কবিতা। সংকটে থাকা মানুষের কথাই এখানে এসেছে। পাখি এমন একটি অনুষঙ্গ হয়ে এখানে এসেছে যে পাখি ছাড়া কবিতাটি অসম্পূর্ণ। পাখি এখানে প্রতীকী চরিত্র। পাখির আড়ালে সহজেই মানুষকেই আমরা পাই।

উদাহরণ-উপমা-উৎপ্রেক্ষায় কিংবা রূপক-প্রতীক-ইঙ্গিত-সাংকেতিকতায় কবিতা জ¦লে ওঠে। বেজে ওঠে পাঠকের পঠনসূত্রের হাত ধরে। নাড়া দেয় কবিতার একেকটি শব্দ, সাড়া দেয় পাঠক মন। এখানেই কবি পূর্ণতা লাভ করেন। সৈয়দ শামসুল হক কবিতায়াবিষয়ক যে মূল্যায়ন এবং সিদ্ধান্তমূলক বয়ান দিয়েছেন তার সব দিক তাঁর নিজের কবিতায় মূর্ত। কিন্তু তিনি যতবড় লেখক তাঁর লেখার পঠন-পাঠন ততখানি হয়ে ওঠেনি। জীবদ্দশাতে কবির স্বরূপ উন্মোচনের সীমাবদ্ধতা আমাদের রয়েছে। তবে সেই সীমাবদ্ধতা কালক্রমে ঘুচে যাবে। পাঠক-গবেষকের কাছে সেসবের উন্মিলন অবশ্যম্ভাবী। কবি জীবিতকালে নিরবচ্ছিন্ন শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পেয়েছেন। তারপরও একটি গভীর অসম্পূর্ণতা রয়েছে তাঁর সৃষ্টির পর্যালোচনার ক্ষেত্রে। সাহিত্যবোদ্ধাদের হাত ধরে একদিন পূর্ণরূপে আবিষ্কৃত হবেন সৈয়দ শামসুল হক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর