সাংবাদিক ও টিভি উপস্থাপক জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘দেশের মানুষ আর রূপকথা চায় না, তারা চায় প্রকৃত গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং নৈতিক নেতৃত্ব।’ গতকাল নিজের ইউটিউব চ্যানেলে তিনি এসব কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসায় পর মানুষ ভেবেছে এবার সত্যি এক ভিন্নধারার রাজনীতি দেখবে বাংলাদেশ। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, পুরনো অভ্যাস পুরনো অহংকার এবং সেই চেনা সুযোগসন্ধানীরাই আবার ফিরে এসেছে এক নতুন মোড়কে, এক নতুন মোহে।
২০২৪ সালের আন্দোলন ছিল একেবারেই ব্যতিক্রম। এর জন্ম কোনো বড় রাজনৈতিক দল বা আন্তর্জাতিক শক্তির সহায়তায় নয় বরং ছাত্র, তরুণ, বেকার, মাদরাসার ছাত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, স্কুলের ছাত্রী—এমনকি পল্লীর কৃষকের ক্ষোভের বিস্ফোরণে হয়েছে। সঙ্গে তো রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছিলই। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, সেটি হঠাৎ করেই এক জাতীয় গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনার ভিডিও যখন ভাইরাল হলো তখন যেন রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর জমে থাকা সব ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘এই আন্দোলনের ছিল না কোনো কেন্দ্র, নেতা বা চেনা রাজনৈতিক পতাকা। তবু এই অদৃশ্য আন্দোলনের শক্তি এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে দেশের দীর্ঘমেয়াদি শাসককেও বিদায় নিতে হয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সেই অসংঘটিত অথচ ঐতিহাসিক আন্দোলনকে সংঘটিত ও পরিকল্পিত বলে উপস্থাপন করা হচ্ছে যে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা নেতা এককভাবে পরিবর্তন এনেছেন।
এটা যেমন ইতিহাসের বিকৃতি, তেমনি গণ-আন্দোলনের প্রতি অসম্মান। যারা রাজপথে জীবন দিয়েছিল, যারা আন্দোলনের প্রতিটি বাঁকে ছিল তাদের অবদানকে অস্বীকার করে কিছু সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ আজ নিজেদের আন্দোলনের নায়ক বলে দাবি করছে। বিশেষ করে যারা আজ এনসিপির নেতৃত্বে রয়েছেন, তারা যেন এক নতুন পৌরাণিক চরিত্রে পরিণত হয়েছেন।’
জিল্লুর রহমান বলেন, ‘যেখানে ত্যাগ নয়, উপস্থিতি ও উচ্চস্বরে কথা বলাই সাফল্যের পরিমাপ। এনসিপি একটি নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল এই প্রতিশ্রুতিতে যে তারা পুরনো দলগুলোর ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এক নতুন ধারা প্রতিষ্ঠা করবে।
তারা বলেছিলেন তাদের রাজনীতি হবে গণমুখী, জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক এবং স্বচ্ছতায় পরিপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিন মাসের মধ্যে দলটির নেতারা যে ধরনের জীবনযাপন, বক্তব্য আর কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন, তা দেখে মানুষ হতাশ। পাঁচতারা হোটেলে ইফতার পার্টি, বিলাসবহুল গাড়ির বহর, দলীয় অভ্যন্তরীণ ফেসবুকে বিদ্রূপমূলক পোস্ট এসব দৃশ্য অনেককেই মনে করিয়ে দেয় পুরনো রাজনৈতিক গল্প। যেখানে আদর্শ নেই, আছে শুধু ক্ষমতার খেলা। এনসিপির প্রধান নেতা এখনো ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ। জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের যে মিডিয়া বা ফেসবুকে বক্তব্যেই তার সক্রিয়তা বেশি। আবার উত্তরাঞ্চলের এক নেতার শতাধিক গাড়ি নিয়ে শোডাউনের ঘটনা দলীয় শৃঙ্খলার প্রশ্নও তোলে।
কিছু নেতাকে শোকজ করা হলেও এটা অনেকটাই জনমতের চাপে। ফেসবুকে পোস্ট-পাল্টা পোস্টের মধ্য দিয়ে নেতাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সামনে চলে এসেছে। যদিও কেউ কেউ বলছেন, এটি গণতন্ত্রের প্রতিফলন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই দ্বন্দ্ব কি আদৌও গণতান্ত্রিক মতবিনিময়, নাকি জনসংযোগবিমুখ ক্ষমতার লড়াই। একই সঙ্গে সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে যে ঠাণ্ডা উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তা একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আভাস দেয়। এই অবস্থায় ব্রিটেনে আসন্ন সফর তারেক রহমানের সঙ্গে সম্ভাব্য বৈঠকের আলোচনা বা গুজব এবং আন্তর্জাতিক মহলের চাপ—সব কিছু মিলিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ, আমি প্রধান উপদেষ্টার সফরের কথা বলছিলাম।’
কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যদি এনসিপি নেতৃত্ব প্রশ্ন এড়িয়ে যায়, জনগণের স্বার্থকে পেছনে ফেলে দলীয় সুবিধা বেছে নেয় তাহলে এ দলও শেষ পর্যন্ত সেই পুরনো রাজনীতিরও অংশ হয়ে থাকবে। নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন কেবল বক্তৃতা আর ব্যানারে রাখা যাবে না। সেটি বাস্তবায়নের জন্য দরকার সাহসী নেতৃত্ব ও স্বচ্ছ কর্মসূচি এবং সর্বোপরি জনগণের সঙ্গে অটুট সংযোগ। এনসিপির সামনে এখনো সময় আছে, কিন্তু এই সময় সীমিত। এখনই যদি তারা মাঠে না নেমে দেশের প্রতিটি কোনায় নিজেদের বার্তা না পৌঁছায় তবে নির্বাচনের সময় তাদের অবস্থান জনবিছিন্নই থাকবে। বাংলাদেশের মানুষ আর রূপকথা চায় না, তারা চায় প্রকৃত গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং নৈতিক নেতৃত্ব।
বিডি প্রতিদিন/মুসা