এলাকার ক্লাব হিসেবে শুরু করে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ফুটবল অঙ্গনে প্রতিধ্বনি সৃষ্টির মাধ্যমে এখন দেশের প্রতিনিধিত্ব করে বসুন্ধরা গ্রুপের ‘পেট্রোনাইজড’ ক্লাব বসুন্ধরা কিংস। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে দেশের ফুটবলে বড় দাগ কেটে স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে এই ক্লাবের বেড়ে ওঠার গল্প সত্যি অসাধারণ। বসুন্ধরা কিংস পাল্টে দিয়েছে দেশের ক্লাব ফুটবলের সংস্কৃতি এবং ধ্যান-ধারণা। পাল্টে দিয়েছে ঘরোয়া ফুটবলের রং, রুচি ও সৌন্দর্যবোধ।
ক্লাব ফুটবলে কিংস চিহ্নিত হয়েছে ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে। ক্লাব ফুটবল যে দেশে দেশে একেকটি ‘ইন্ডাস্ট্রিতে’ পরিণত হয়েছে, বাংলাদেশে এর প্রবর্তক হলো বসুন্ধরা কিংস। প্রথম থেকেই বলা হয়েছে, ‘ইনডিভিজুয়ালাইজ’ নয়, কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ নয়—দেশের ফুটবলের স্বার্থেই বসুন্ধরা কিংস! এখানেই বসুন্ধরা গ্রুপ তাদের সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্যদের থেকে পৃথক।
ঘরোয়া ফুটবলে ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে তার ‘অপরিহার্যতা’।
ক্লাব ফুটবলের ব্যবস্থাপনায় পেশাদারি শুধু সুষ্ঠুভাবে ক্লাব পরিচালনা নয়, মাঠের সাফল্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঘরোয়া ফুটবলে বসুন্ধরা কিংস তার উদাহরণ। ওরা বিশ্বাস করে জবাবদিহি, দায়বদ্ধতা এবং সুশাসনে। শুরু থেকেই ক্লাবটির ব্যবস্থাপনামণ্ডলী শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং অনৈতিক কার্যকলাপের বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ (শূন্য সহনশীলতা) নীতি মেনে চলেছে।
ঘরোয়া ফুটবলে একটি আদর্শ এবং কমপ্লিট ক্লাব হলো বসুন্ধরা কিংস। সব দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ। নিজস্ব আধুনিক ফুটবল অ্যারেনা (যা দক্ষিণ এশিয়ায় কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রাইভেট ক্লাবের নেই), আন্তর্জাতিক মানের একাধিক প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড, সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বৃহৎ জিম ফ্যাসিলিটি, ক্লাবের নিজস্ব ফুটবল একাডেমি বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে অনাবাসিকভাবে। হেড কোচ, অন্যান্য কোচ, কোচিং স্টাফ এবং খেলোয়াড়দের জন্য উন্নতমানের আবাসিক ব্যবস্থা—ইউরোপ এবং অন্যান্য স্থানের পেশাদার ফুটবল ক্লাবের আদলে।
কিংসের ব্যবস্থাপনামণ্ডলী আত্মপ্রসন্নতা থেকে প্রথম থেকেই দূরে! ঐক্যবদ্ধ ও সংযোগ শক্তিতে বিশ্বাসী সবার লক্ষ্য এক এবং অভিন্ন, যা বিশ্বাস করা হয়, তা বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টার কোনো ধরনের ত্রুটি নেই।
এর জন্যই ক্লাবটির পক্ষে সম্ভব হয়েছে নিজকে ছাড়িয়ে যাওয়া। আলোচনার জন্ম দেওয়া। পেরেছে এমন কিছু অর্জন করতে, যা দীপ্তমান! এমনিতে তো পরাশক্তি তকমাটা আঠার মতো লাগেনি।
ক্লাবটির জন্ম ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর। জাতির বিজয় দিবস। দিনটির সঙ্গে সম্পৃক্ত মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার চেতনা এবং বিজয় দিবসের আবেগ। বিজয় দিবসের মূল্যবোধ এবং আবেগের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য বসুন্ধরা কিংস কখনো ১৬ নম্বর জার্সি মাঠের লড়াইয়ে বরাদ্দ করেনি। এটি শুধু ক্লাব সমর্থক, ভক্ত ও গুণমুগ্ধদের জন্য ‘ডেডিকেটেড’। ‘বসুন্ধরা কিংস’—এই শব্দটি ইংরেজিতে লিখতেও ১৬টি শব্দের প্রয়োজন হয়, এখানেও কী অদ্ভুত মিল বিজয়ের ১৬ ডিসেম্বরের সঙ্গে। এর আগে দেশের কাগজে ছাড়াও ‘ফুটবল এশিয়া’ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার অনলাইন ‘স্পন্সর’-এ বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট মো. ইমরুল হাসানের (যিনি ২০১৭ সাল থেকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন) জবানিতে পুরো বিষয়টি তুলে ধরেছি বিস্তারিতভাবে। আর এ সবকিছুই ইতিহাসের প্রয়োজনে।
২০১৮ সালে প্রিমিয়ার লীগ খেলতে নেমে গত ছয় মৌসুমের মধ্যে একনাগাড়ে পাঁচ মৌসুমে লীগ শিরোপা জিতেছে বসুন্ধরা কিংস। সৃষ্টি করেছে দেশের ফুটবল ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের। শুধু তা-ই নয়, ২০২৪ মৌসুমে ক্লাবটি ‘ট্রেবল’ জিতেছে। মাত্র কয়েকটি বছরের মধ্যে ক্লাবের ডিসপ্লে কেবিনেটে স্থান দখল করে নিয়েছে ১৮টি ট্রফি (পুরুষ ও মহিলা ফুটবল থেকে) ২২টি ট্রফির মধ্যে। এ ধরনের সাফল্যের নজির স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ফুটবলে কোনো ক্লাবের নেই! শুধু ঘরোয়া নয়, আন্তর্জাতিক ফুটবল তথা এএফসির কম্পিটিশনে বসুন্ধরা কিংস এবার নিয়ে একনাগাড়ে ছয়বার পার্টিসিপেট করল, যেটি আর কোনো ক্লাবের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সচেতন ফুটবল রসিকরা নিশ্চয়ই অবগত আছেন বাংলাদেশকে এএফসির কম্পিটিশন মঞ্চে ওপরে তুলেছে বসুন্ধরা কিংস।
এএফসি চ্যালেঞ্জ লীগে প্লে অফ ম্যাচে গত ১২ আগস্ট ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামে আবাহনী লিমিটেড কিরগিজস্তানের খুরাম ইউনাইটেড ক্লাবের বিপক্ষে পরিচিত দর্শকের সামনে খেলে ২-০ গোলে পরাজিত হয়ে কম্পিটিশন থেকে বিদায় নিয়েছে। অন্যদিকে সেদিন রাতেই কাতারের দোহায় বাংলাদেশের আরেক প্রতিনিধি বসুন্ধরা কিংস মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়ার ঐতিহ্যবাহী ও শক্তিশালী ক্লাব আল কারামাহের বিপক্ষে লড়াই করে ১-০ গোলে জয়ী হয়ে বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রেখে দ্বিতীয় পর্বে স্থান করে নিয়েছে। এটি দেশের এবং ক্লাব ফুটবলের জন্য আনন্দদায়ক খবর। আন্তর্জাতিক চত্বরে (এএফসি চ্যালেঞ্জ লীগ) বসুন্ধরা কিংস তো বাংলাদেশের ক্লাব দল হিসেবেই দেশবাসীকে বিজয় উপহার দিয়েছে। খেলোয়াড়দের দলগত নৈপুণ্য, তাঁদের মধ্যে বোঝাপড়া, আত্মবিশ্বাস, স্থানীয় কোচদের (বসুন্ধরা কিংস) তত্ত্বাবধানে তাঁদের ম্যাচ পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হওয়াতেই বিজয় এসেছে। খেলার মধ্যে ছিল আক্রমণ এবং প্রতি আক্রমণের ঝাঁজ।
এ বছর কুয়েতের জাবের আল মুবারক আল সাবা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের প্রতিনিধি বসুন্ধরা কিংস আগামী ২৫, ২৮ ও ৩১ অক্টোবর তিনটি ম্যাচ খেলবে যথাক্রমে ওমানের আলসিবা, লেবাননের আল আনসার এবং কুয়েত এফসির বিপক্ষে। মধ্যপ্রাচ্যের এই তিনটি ক্লাব শুধু ঐতিহ্যের অধিকারী নয়, তাদের অতীত ফুটবল রেকর্ড অনেক বেশি উজ্জ্বল। তিনটি দলই তাদের পরিচিত কন্ডিশনে মাঠে লড়বে। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ২১ অক্টোবর দেশ থেকে কুয়েতে গিয়ে সেখানকার কন্ডিশনের সঙ্গে সাধ্যমতো চেষ্টা করবে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য। সফরকারী দলের জন্য এটি সব সময় চ্যালেঞ্জ।
মধ্যপ্রাচ্যের ক্লাবগুলো ফুটবলে এগিয়ে চলেছে পেট্রোডলার ও অন্যান্য বাস্তবধর্মী পৃষ্ঠপোষকতা এবং সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে। ইউরোপের পেশাদারি ক্লাবগুলো মধ্যপ্রাচ্য ও আরববিশ্বের ক্লাব ফুটবলের কার্যকলাপ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। দেখছে ক্লাবগুলো কিভাবে তাদের মাঠের শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে।
ভারতের ঐতিহ্যবাহী ফুটবল দল মোহনবাগান তো এএফসি ফুটবলে পার্টিসিপেট না করার (ইরানে খেলার কথা) সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৩৪ জনের স্কোয়াডে তিনজন বিদেশি খেলোয়াড় ক্লাবের পক্ষে ইরানে খেলতে পারবেন এর জন্য। শক্তিশালী ক্লাবকে মোকাবেলা করতে হবে এর জন্য এভাবে পালিয়ে গর্তে ঢুকে পড়া কেন? মোহনবাগান তো ভারতের প্রতিনিধি! ভারতের সাবেক খেলোয়াড় প্রসূন ব্যানার্জি তাঁর টুইটারে কথাগুলো লিখেছেন।
বসুন্ধরা কিংসের নতুন আর্জেন্টাইন কোচ মারিও গোমেজ। অভিজ্ঞ এই কোচের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে দুই ডজনের কাছাকাছি ক্লাবের সঙ্গে কাজ করেছেন। ২০১৫ সালে মালয়েশিয়ার জোহর দারুল এফসির এএফসি কাপের শিরোপা জেতার পেছনে আছে তাঁর নিরবচ্ছিন্ন প্রশিক্ষণ এবং প্রস্তুতি। দেড় মাস ধরে বসুন্ধরা কিংস দলটি নিয়ে কাজ করছেন। এরই মধ্যে মৌসুমের প্রথম ট্রফি জিতেছে তাঁর তত্ত্বাবধানে বসুন্ধরা কিংস। এই কোচ কাজে বিশ্বাসী, প্রচারে কম—অনেকটা দলের প্রেসিডেন্ট মো. ইমরুল হাসানের মতো। এটি নিজেই হেসে হেসে বলেছেন। তাঁর কথা হলো, ‘বসুন্ধরা কিংসের অতীত রেকর্ড আর এই ক্লাবটি এখন কী চাচ্ছে, সেটি আমি জানি। আর আমি কেন দায়িত্ব নিয়েছি সেটিও জানি।’ এএফসি কম্পিটিশনের বিষয়ে কোচ মারিও গোমেজ পুরোপুরি অবগত। তিনি জানেন ক্লাব এখন চাচ্ছে যে চিত্তাকর্ষক ‘ওরিফ্রি’ ফুটবলটি পর পর পাঁচ বছর খেলতে পেরেছে—কিন্তু গত মৌসুমে খেলতে পারেনি, সেই ফুটবল থেকে বেরিয়ে আসা। বাংলাদেশের প্রতিনিধি বসুন্ধরার এবারের দলটি ভারসাম্যময়। বিদেশি ও দেশি পরীক্ষিত খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠন করা হয়েছে। কথা একটিই বিদেশে লড়াই করতে নেমে সবাইকে একসঙ্গে ‘ক্লিক’ করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমার যেটি মনে হয়, বসুন্ধরার বিদেশি খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সের ওপর অনেকটা নির্ভর করবে দলের সাফল্য এএফসি লড়াইয়ে।
বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বসুন্ধরা কিংস খেলবে কুয়েতে যে তিনটি দেশের ক্লাবের বিপক্ষে, তাদের সঙ্গে ছোট একটি তুলনা তুলে ধরতে চাচ্ছি। আর এটি ফুটবলপিপাসুদের কৌতূহল ও উৎসাহ লক্ষ করে। এখন তো ট্রান্সফার মার্কেট এবং অন্য অনেক কিছুর দিকে অনেকেই চোখ রাখেন।
ওমানের আলসিবার ৫.৮৩ মিলিয়ন ডলার হলো মূল্যায়ন। এই ক্লাবে খেলেন জাতীয় দলের ১২ জন খেলোয়াড়। বিদেশি খেলোয়াড় আছেন মাত্র একজন। ২০২২ সালে এএফসি কাপে ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ওমান পেশাদার লীগে এই ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে চারবার। ক্লাবটি স্থাপিত হয়েছে ১৯৭২ সালে।
লেবাননের আনসার ক্লাবের মার্কেট ভ্যালু ৪.৪৪ মিলিয়ন ডলার। ক্লাবে খেলেন ছয়জন জাতীয় দলের খেলোয়াড়। ক্লাব স্থাপিত হয়েছে ১৯৫১ সালে। এই ক্লাব কখনো এএফসি কম্পিটিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়নি। এই ক্লাব পেশাদার লীগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ১৫ বার। এর মধ্যে ১১ বার একনাগাড়ে।
কুয়েত এফসির মার্কেট ভ্যালু ৪.৮০ মিলিয়ন ডলার। এই ক্লাবে আছেন ১৩ জন জাতীয় দলের খেলোয়াড়। বিদেশি খেলোয়াড় আছেন সাতজন। ২০০৯, ২০১২ ও ২০১৩ সালে এএফসি ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে কুয়েত এফসি। ক্লাবটি স্থাপিত হয়েছে ১৯৬০ সালে। লীগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ২০ বার।
বসুন্ধরা কিংসের মার্কেট ভ্যালু ২.৮৯ মিলিয়ন ডলার। ক্লাবে আছেন ১৫ জন জাতীয় দলের খেলোয়াড়। বিদেশি খেলোয়াড় আছেন চারজন। ক্লাব এএফসি কাপে খেলেছে এবার নিয়ে টানা ছয়বার। দেশের প্রিমিয়ার লীগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে টানা পাঁচবার। ক্লাব স্থাপিত হয়েছে ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া