আজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন। উৎসব ও আমেজে উৎফুল্ল শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘ সাড়ে তিন দশক পর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পছন্দের প্রার্থী বাছাই করতে উন্মুখ শিক্ষার্থীরা। চাকসু নির্বাচনে আজ ২৬ পদের বিপরীতে স্বতন্ত্র ও ১৩টি প্যানেল মিলিয়ে মোট প্রার্থী ৪১৫ জন। এর মধ্যে নারী ৪৭ জন ও পুরুষ ৩৬৮ জন। একই সময়ে অনুষ্ঠিত হবে চবির ১৪টি হল (ছাত্রীদের পাঁচ হলসহ) ও একটি হোস্টেলের নির্বাচন। নির্বাচনের পর চাকসুর মনোনীত পাঁচ শিক্ষার্থী প্রতিনিধি হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিনেটের সদস্য। তাই কাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব তা নিয়ে চলছে নানা বিচার বিশ্লেষণ। তবে শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের প্যানেলের মধ্যে। এ ছাড়া চাকসুর কয়েকটি পদসহ হল সংসদে স্বতন্ত্র বা ভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা হতে পারে। নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট পেতে নানা কৌশলে কাজ করেছেন প্রধান দুই প্যানেলসহ চাকসুর প্রার্থীরা। জানা যায়, চবি নির্বাচনে এবার ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন ২৭ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। এর মধ্যে নারী ভোটার সাড়ে ১১ হাজার। অর্থাৎ মোট ভোটারের প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। ভোটযুদ্ধে এই নারী ভোটাররাই গড়ে দিতে পারেন ব্যবধান। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী হলের সংখ্যা ৫। নিবন্ধিত আবাসিক ছাত্রী ২ হাজার ৫৮২ জন। তবে গাদাগাদি করে হলে থাকেন সাড়ে ৩ হাজারের মতো ছাত্রী। বাকি নারী শিক্ষার্থীরা অনাবাসিক। ফলে ছাত্রীদের বেশির ভাগই ভোট দিতে আসবেন ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে।
চবি প্রশাসন জানায়, চাকসু নির্বাচন ওএমআর ফর্মে গ্রহণ করা হবে চাকসু ও হল সংসদের ভোট। বুধবার সকাল ৯টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে চলবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। প্রতিটি ব্যালট পূরণে সময় লাগতে পারে প্রায় ১০ মিনিট। দুটি লেয়ারে ভোট গণনা করা চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা হবে। এ প্রসঙ্গে নির্বাচনের তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, নির্বাচনের ফলাফল আজই (১৫ তারিখেই) ঘোষণা করা হবে। চাকসুর ভোট গণনা হবে দুই লেয়ারে। আমাদের ব্যালট পেপার আর রং পর্যন্ত এখনো কেউ জানে না। আমরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে ভোটের আয়োজন করছি। ফল গণনার সময়ও সব প্রার্থীর প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন। ভোটের সময় পরিদর্শক এবং গণমাধ্যমকর্মীদের থাকবে অবাধ চলাচল।
চাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলে ভিপি সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়, জিএস শাফায়াত হোসেন, এজিএস আইয়ুবুর রহমান তৌফিক। শিবির সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ থেকে ভিপি ইব্রাহিম রনি, জিএস সাইদ বিন হাবীব, এজিএস সাজ্জাদ হোসেন মুন্না। বৈচিত্র্যের ঐক্য প্যানেলে ভিপি ধ্রুব বড়ুয়া, জিএস সুদর্শন চাকমা ও এজিএস জশদ জাকির। স্যাড ও ছাত্র ফেডারেশন সমর্থিত বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলে ভিপি আবির বিন জাবেদ, জিএস চৌধুরী তাসনিম জাহান শ্রাবণ ও এজিএস পলাশ দে। ছাত্র ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট সমর্থিত দ্রোহ পর্ষদ প্যানেলে ভিপি ঋজু লক্ষ্মী অবরোধ, জিএস ইফাজ উদ্দিন ইমু ও এজিএস জোনায়েদ কবির শায়র। সাবেক সমন্বয়কদের প্যানেল স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন প্যানেলে ভিপি মাহফুজুর রহমান, জিএস রশিদ দিনার ও এজিএস জান্নাতুল ফেরদৌস। ছাত্র অধিকার পরিষদ ও ইসলামী ছাত্র মজলিস সমর্থিত সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলে ভিপি তামজিদ উদ্দিন, জিএস সাকিব মাহমুদ রুমি ও এজিএস রোমান রহমান। ইসলামী ছাত্র আন্দোলন সমর্থিত সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলে ভিপি আবদুর রহমান রবিন, জিএস মোহাম্মদ আবদুর রহমান ও এজিএস আমিনুল ইসলাম রাকিব।
রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক শিক্ষার্থী সমর্থিত সর্বজনীন শিক্ষার্থী ঐক্য পরিষদ প্যানেলে ভিপি সাইদ মো. রেদওয়ান, জিএস জিহাদ আরাফাত ও এজিএস আবদুল্লাহ আল মামুন। ‘অরাজনৈতিক’ শিক্ষার্থী সমর্থিত সার্বভৌম শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলে ভিপি তাওসিফ মুত্তাকি চৌধুরী, জিএস মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসাইন ও এজিএস সাইদ মোহাম্মদ মুশফিক হাসান। সুফিপন্থি শিক্ষার্থী সমর্থিত অহিংস শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলে ভিপি ফরহাদুল ইসলাম, জিএস ইয়াসিন উদ্দিন সাকিব ও এজিএস শহীদুল ইসলাম শাহেদ। বিশ্ব ইনসানিয়াত বিপ্লব স্টুডেন্ট ফ্রন্ট সমর্থিত রেভ্যুলেশন ফর স্টেট অব হিউম্যানিটি প্যানেলে ভিপি কেফায়াত উল্লাহ, জিএস শাহরিয়ার উল্লাহ ও এজিএস জোনায়েদ শিবলী।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাকসু নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের প্যানেলের মধ্যে হলেও কিছু হল সংসদে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে হাড্ডাহাডি লড়াই হবে উভয় প্যানেলের। সম্প্রতি শিবির সমর্থিত সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোটের ভিপি প্রার্থী ইব্রাহিম রনির বিরুদ্ধে ৫ আগস্টের পর দাউদ নামে এক যুবককে দোসর আখ্যায়িত করে মারধরের ঘটনাসহ বিগত সময়ে শিবিরের একক আধিপত্যকালীন নানা নেতিবাচক ঘটনা সামনে নিয়ে আসছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। এর প্রভাব ভোটে পড়তে পারে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। বিপরীতে ছাত্রদল প্যানেলের ভিপি প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়সহ তিন শীর্ষ প্রার্থীর জুলাই গণ অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া বিগত সময়ে ছাত্রদলের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস না থাকার কারণে তাদের দিকে শিক্ষার্থীদের সমর্থন রয়েছে বলে মনে করছে ছাত্রদল। তবে চবির ১৪টি হল ও একটি হোস্টেলে ছাত্র সংসদগুলোর মধ্যে ছাত্রদের ৯ হলের ছয়টিতে শিবির, তিনটিতে ছাত্রদলের প্রভাব রয়েছে। ছাত্রীদের ছয় হলেও শিবিরের ছাত্রীসংস্থার অবস্থান বেশ ভালো।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, চাকসু নির্বাচনের ব্যালট পেপারে থাকছে নিরাপত্তা কোড, যা ভুয়া ব্যালট ঠেকাতে কাজে দেবে। ব্যালটে প্রার্থীদের নাম ও ব্যালট নম্বর থাকছে; একই নামের ক্ষেত্রে থাকবে ডাকনাম। ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে পাঁচটি অনুষদ ভবনের ১৫টি কেন্দ্রে এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য চাকসু ভবনে ১টি বিশেষ কেন্দ্রে। প্রকৌশল অনুষদে ৪ হাজার ৩৬ জন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের শহীদ হৃদয় চন্দ্র তরুয়া ভবনে ৫ হাজার ২৬৩ জন, বিজ্ঞান অনুষদ ভবনে ৪ হাজার ৫৩৮ জন, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভবনে ৬ হাজার ৬০৬ জন এবং ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ভবনে ৭ হাজার ৭৩ জন শিক্ষার্থী ভোট দেবেন। নির্বাচনের দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পাঁচটি অনুষদের প্রতিটিতে একজন করে মোট পাঁচজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া কেন্দ্রগুলোর বাইরে আরও চারজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে থাকবে মোবাইল কোর্ট। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ, র্যাব, এপিবিএন, বিজিবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা বাহিনী, রোভার স্কাউট ও বিএনসিসি মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ৭০০ জন সদস্য মোতায়েন থাকবেন। ভোটগ্রহণ থেকে গণনা পর্যন্ত ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ১৪টি এলইডি স্ক্রিনে লাইভ সম্প্রচারের ব্যবস্থা থাকবে। শিক্ষার্থীরা যেন নির্বিঘ্নে ভোট দিতে ক্যাম্পাসে আসতে পারেন, সে জন্য শাটল ট্রেনের দুটি অতিরিক্ত ট্রিপ চালুর পাশাপাশি দেওয়া হয়েছে ১৫টি বিশেষ বাস।