তথাকথিত কোটা আন্দোলনের পেছনে যে বস্তুত বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের লোকদের আসল উদ্দেশ্য ছিল কিছু নিরীহ ছাত্রছাত্রীর কাঁধে ভর করে অসাংবিধানিক পন্থায় বর্তমান সরকারের পতন ঘটানো, সে যুক্তির সমর্থনে শুরুতেই বলতে হয় যে, সরকার যখন নিজেই কোটা ব্যবস্থার বিলুপ্তি চেয়েছিল, সেখানে কোটা বিলুপ্তির জন্য রাস্তায় নামার আদৌ কোনো যৌক্তিকতা ছিল না। উল্লেখ্য যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই ২০১৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা এবং অন্যদের জন্য রক্ষিত কোটাব্যবস্থা বাদ করে দিয়েছিলেন, যদিও তার ভাষ্যমতে তিনি অনেকের চাপে পড়ে এটি করেছিলেন। সরকারের ওই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন ছাত্র হাই কোর্ট বিভাগে রিট মামলা দায়ের করলে, শুনানি শেষে হাই কোর্ট বিভাগ রিটকারীদের পক্ষে ১ জুলাই রায় প্রদান করেন। হাই কোর্ট বিভাগে রিট মামলার শুনানিকালেও রাষ্ট্রের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কোটাব্যবস্থার বিলুপ্তির পক্ষে, অর্থাৎ সরকারি সিদ্ধান্তের সমর্থনে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছিলেন। হাই কোর্ট রিটকারীদের আবেদন মঞ্জুর করার পর প্রক্রিয়াগত কারণে যত সময় দরকার তা পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল সিনিয়র অ্যাডভোকেট এম আমিন উদ্দিন আপিল বিভাগে আপিল করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন করে আপিল বিভাগে তা জমা দেন। পূর্ণাঙ্গ আপিল করার জন্য আইনত প্রয়োজন ছিল হাই কোর্টের রায়ের লিখিত কপি পাওয়া, যার জন্য স্বভাবতই দেরি করতে হয়েছে। কিন্তু আপিল প্রক্রিয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল যে দলিল আপিল বিভাগে প্রদান করেছিলেন, সেখানে স্পষ্ট ভাষায় বলা ছিল যে, রাষ্ট্র হাই কোর্ট প্রদত্ত রায় বাতিলের জন্য আপিল করছে। সোজা কথায় অ্যাটর্নি জেনারেল যেদিন আপিল বিভাগে তার প্রাথমিক দরখাস্তটি জমা দিয়েছিলেন সেদিনই সরকারের তরফ থেকে হাই কোর্টের রায় বাতিল প্রার্থনা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়, অর্থাৎ আপিল বিভাগে সরকারের করা আপিল প্রক্রিয়া সেদিনই শুরু হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও স্বার্থান্বেষী কিছু লোকের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে সাধারণ ছাত্ররা রাস্তায় নামেন। ছাত্রদের বারবার বলা হয়েছে যে, বিষয়টি আপিল বিভাগের বিবেচনাধীন বিধায় আপিল বিভাগ থেকে সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত সরকার কিছু করার চেষ্টা করলেও সেটি হবে আদালত অবমাননা। তাদের এমন পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল যে, তারাও ইচ্ছা করলে আপিল মামলায় পক্ষভুক্ত হয়ে তাদের নিজস্ব আইনজীবীদের মাধ্যমে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে পারবেন, যে সুবিধা কয়েকজন ছাত্র নিয়েছিলেনও। সাধারণ ছাত্রদের অনেকেরই জানার কথা নয় যে সুপ্রিম কোর্ট সরকারের অংশ নয় এবং সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিরাও সরকারি কর্মকর্তা নন। কিন্তু যারা ছাত্রদের বিভ্রান্ত করছিলেন, তাদের তো এ মৌলিক আইনটি জানার কথা। তারা ছাত্রদের এ কথাটি না বুঝিয়ে বরং বারবার বলছিলেন সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যে ক্ষমতা সরকারের ছিল না। তারা শুধু ছাত্রদেরই বিভ্রান্ত করেননি, বরং গোটা দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করেছেন এমন বিভ্রান্তিকর প্রচারণার মাধ্যমে যে এ বিষয়ে সরকারই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিস্ময়ের কথা হলো এই যে দেশের অনেক জ্ঞানীগুণীজনও ভেবেছিলেন যে সরকার চাইলেই সব করতে পারে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, যারা দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে এমন অবান্তর কথা বুঝাচ্ছিলেন তারা সত্যিকার অর্থেই করিৎকর্মা এবং বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। অন্যদিকে আমরা সাধারণ ছাত্র এবং জনগণকে আইনগত দিকগুলো বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। গত ১০ জুলাই ছাত্রদের তথাকথিত কয়েকজন সমন্বয়ক মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের দাবি সংবলিত স্মারকলিপি প্রদান করতে গেলে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব তা যথাযথভাবে গ্রহণ করেন। এর বাইরে রাষ্ট্রপতিরও কিছু করার ক্ষমতা ছিল না, যে কথা তথাকথিত সমন্বয়করা যদি না জেনে থাকেন তাহলে তাদের মেধা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। সেদিনটিতেও তারা জানতেন যে খুব শিগগিরই আপিল বিভাগ তাদের রায় প্রদান করবেন। যে কোনো দক্ষ আইনজীবী পুরো বিষয় পর্যালোচনা করে মোটামুটি অগ্রিম আন্দাজ করতে পারেন মামলার রায় কী হতে পারে। অ্যাটর্নি জেনারেল এম আমিন উদ্দিনও তেমনি একজন অতি দক্ষ আইনজ্ঞ, যে কারণে তিনি এ মর্মে সবাইকে নিশ্চয়তা দিতে পেরেছিলেন যে রায় সরকারের পক্ষে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তথাকথিত আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা লোকদের উদ্দেশ্য ভিন্ন হওয়ায় তারা সেদিকে নজর দেননি।
তথাকথিত আন্দোলনটি প্রথম দিন সাতেক শান্তিপূর্ণই ছিল। শুরু থেকে বিএনপি, জামায়াত, শিবিরের লোকেরা কলকাঠি নাড়ালেও কৌশলগত কারণে তারা সে কদিন প্রকাশ্যে আসেননি। তারা উপযুক্ত মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন। সে মুহূর্ত আসার সঙ্গে সঙ্গেই তারা ছাত্রদের মাঝে ঢুকে পড়ে তাদের আসল উদ্দেশ্য সাধনের জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটিকে সন্ত্রাসী আন্দোলনে পরিণত করেন। তারা প্রথম ‘বাংলা ব্লক’ এবং পরে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ নামে গোটা দেশকে অচল করে দেন। বিপথে পরিচালিত হয়ে ছাত্রছাত্রীরা শুধু ঘণ্টার পর ঘণ্টা নয়, বরং দিনের পর দিন রাস্তাঘাট, রেলপথ, নৌ যোগাযোগসহ সব যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ করে জনজীবনে চরম দুর্ভোগ ঘটান। রাস্তাঘাট এবং সব ধরনের যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ করে জনজীবনে অশান্তি সৃষ্টি করাকে কোনোভাবেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বলা চলে না। তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রবেশ করে ভাঙচুরসহ বিভিন্ন ধরনের তাণ্ডবের সৃষ্টি করেন। দেশবাসীকে এ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য পুলিশের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল এসব রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়াদের ছত্রভঙ্গ করা। পুলিশ এ ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নিলেও, তারা কঠোরতা অবলম্বন করেননি। সে অর্থে পুলিশ নিশ্চয়ই অনেক ধৈর্য প্রদর্শন করেছেন। সরকার হাই কোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে দরখাস্ত করলে চেম্বার আদালত সেটি শুনানির জন্য ১৮ জুলাই দিন ধার্য করেন। কিন্তু ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে চেম্বার আদালত হাই কোর্টের রায় স্থগিত করার নির্দেশ না দিয়ে বিষয়টি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন ২১ জুলাই শুনানির জন্য। চেম্বার আদালতের একক বিচারপতি সাধারণত এ ধরনের আদেশই দিয়ে থাকেন। পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ প্রথম দিনের শুনানিতেই হাই কোর্টের আদেশটির ওপর স্থিতাবস্থা প্রদান করেন, যার ফলে বস্তুত ২০১৮ সালের জারি করা কোটা বিলুপ্তির সরকারি আদেশটিই কার্যকর হয়। হাই কোর্ট বিভাগের রায়ের অনুলিপি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাটর্নি জেনারেল পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সেখানে প্রক্রিয়াগত কারণের বাইরে কোনো বিলম্ব হয়নি। এটি দিবালোকের মতোই দৃশ্যমান ছিল যে, সরকার হাই কোর্টের রায় বাতিলের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করছেন। যারা বলার চেষ্টা করছেন যে, সরকার আপিল বিভাগে ত্বরিতগতিতে যাননি তারা হয় ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা প্রক্রিয়ার বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে এসব কথা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। সেদিন ডয়েচে ভেলির এক টকশোতে আলোচনাকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের এক অধ্যাপক না জেনেই বলে ফেললেন যে, আপিল বিভাগ যে কথাগুলো লিখেছেন সেগুলো আদিতে পরামর্শের পর্যায়ে থাকলেও পরে দেখা গেল অন্যরকম। অবশ্য এ ব্যাপারে অনুষ্ঠানের পরিচালক খালেদ মহিউদ্দিন ওই অধ্যাপকের ভ্রান্তি ঠিক করে দেওয়ার পর সেই অধ্যাপক চুপসে গিয়েছিলেন, যদিও তিনি লজ্জিত হয়েছিলেন কি না তা বোঝা যায়নি। এ ধরনের ব্যক্তিদের উচিত কিছু বলার আগে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া। বর্তমান সরকারের কট্টর বিরোধী বলে পরিচিত ওই অধ্যাপক ইচ্ছাকৃতভাবেই জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য এমনটি বলেছিলেন বলে অনেক বিজ্ঞজনের ধারণা। তাদের ভাবনায় অবশ্যই যুক্তি আছে। ছাত্রদের উল্লিখিত কয়েকজন সমন্বয়ক আপিল বিভাগের রায়ের দিকে নজর না দিয়ে বরং দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য বিএনপি-জামায়াত-শিবির গোষ্ঠীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে যে ধ্বংসযজ্ঞের আশ্রয় নেন, তা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করারই শামিল বিধায় তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে অপরাধী, যার জন্য, এমনকি যুক্তরাজ্যসহ সেসব দেশেও মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে, যেসব দেশের সাধারণ আইনে মৃত্যুদণ্ডের প্রথা নেই। তারা রাষ্ট্রের নিজস্ব সম্প্রচার সংস্থা বিটিভিতে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে শুধু ভবনটিই নয় বরং বহু মূল্যবান দলিলপত্র নষ্ট করে দিয়েছেন, আগুন লাগিয়েছেন টোল প্লাজায়, ধ্বংস করেছেন দুর্যোগ প্রতিরোধ মন্ত্রণালয় ভবন, সেতু ভবন, ধ্বংস করেছে বহু রাস্তাঘাট, নরসিংদী জেলার কেন্দ্রীয় কারাগার ধ্বংস করে সেখানে বন্দি জঙ্গিদের মুক্ত করে দিয়েছেন, ধ্বংস করেছেন বহু থানা, প্রচুর সংখ্যক গাড়ি, বাস। যে মেট্রোরেলের প্রতীক্ষায় ঢাকাবাসী বহু বছর কাটিয়েছেন, যা ঢাকা শহরের যানজট সমস্যা সমাধানে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে, ’৭১-এর পরাজিত অপশক্তি অর্থাৎ এসব রাষ্ট্রদ্রোহীর দল ধ্বংস করেছে মেট্রোরেলের কয়টি স্টেশন, যা দেখে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। এসব গড়তে বহু বছর সময় লেগেছে, সরকারকে প্রচুর বিদেশি ঋণ নিতে হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্টের পেছনে দেশকে দেউলিয়া বানানো ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই ছিল না এবং এসব ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে কোটা আন্দোলনের নিশ্চয়ই কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। এগুলো সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা করেননি, তারা সেভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তও নন। বিগত কয়েক দশকের অঘটনগুলো বিশ্লেষণের পর এটি জোর দিয়েই বলা যায় যে, এসব জামায়াত-শিবিরেরই কাজ। এ বিষয়ে তারা দেশে-বিদেশে বহু যুগ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন, যার প্রমাণ মিলেছিল ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট যখন তারা দেশের ৬৩ জেলায় একই সময়ে বোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটিয়েছিল, যখন তাদের লোক বাংলা ভাই গোটা দেশে তাণ্ডব চালিয়েছিল, যখন তারা হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় বিভীষিকার সৃষ্টি করেছিল। এ দলটি ১৯৭১-এ আমাদের মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে ছিল। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পরেও তারা এখনো দেশকে পাকিস্তানে পরিণত করার, দেশে তালেবানি সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় ব্যস্ত। আমাদের দক্ষ পুলিশ এ ধ্বংসকারীদের অনেককেই সিসি টিভি অনুসরণ করে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের জামায়াত-শিবির পরিচয় জানতে সক্ষম হয়েছেন। চট্টগ্রামে এক ভবনের ছাদ থেকে কয়েকজনকে নিচে ফেলে দেওয়ার ঘটনার কারণে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা যে জামায়াত-শিবিরের লোক তা তাদের পরিচয় থেকেই জানা গেছে। জুয়েল নামক এক ছাত্রকে হত্যা করে তার লাশ গাছে যারা টানিয়েছে, তাদের গ্রেফতারের পরও তাদের জামায়াত-শিবির পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা রাস্তায় যেসব স্লোগান দিয়েছে তার অনেকগুলোই জামায়াতের স্লোগান।
যেসব ছাত্রছাত্রী বিভ্রান্ত হয়ে রাস্তায় নেমেছেন, তারা সবাই রাজাকারদের বংশধর এমনটি বলা যাবে না। কিন্তু এদের মধ্যে যারা নিজেরাই বলছেন ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার’, ‘বাংলাদেশের মাটি রাজাকারের ঘাঁটি’, তারা যে রাজাকারদের বংশধর সে কথা ভাবা অযৌক্তিক হবে না। তারা মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অনেক আপত্তিকর কথা বলে তাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পরিচয় নিশ্চিত করেছেন। আপিল বিভাগ তাদের বিশ্বমানের, যুগান্তকারী রায়ে এটি উল্লেখ করতে ভোলেননি যে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছিলেন বিধায় তাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতে হবে।
প্রতিটি জীবনই অমূল্য। এ ব্যাপারে কার কী দায় রয়েছে, সে কথা একজন হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিশন নির্ধারণ করবেন। তবে আপাতদৃষ্টিতে এটি বলা ভুল হবে না যে, এর দায় তাদেরই নিতে হবে যারা এ ধরনের পরিস্থিতি ইচ্ছাকৃতভাবেই সৃষ্টি করেছেন। তাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হলে এতগুলো জীবন ঝরে পড়ত না। সারা পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের বহু উদাহরণ রয়েছে। রাস্তায় সরব মিছিল শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের একটি অতি উত্তম উদাহরণ। মাঠে-ময়দানে বসেও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করা যায়। বর্তমানে গাজায় ইসরায়েলিদের নির্মমতার প্রতিবাদে বহু দেশেই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ হচ্ছে। কয়েক মাস আগে দিল্লিতে অগণিত সংখ্যক কৃষক সমবেত হয়ে যে আন্দোলন করেছিলেন, সেখানেও তারা শান্তি ভঙ্গ করেননি। এখনো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তাদের পেনশন নিয়ে আন্দোলনরত রয়েছেন, তাদের আন্দোলনও শান্তিপূর্ণ রয়েছে। তাছাড়া কোটাবিরোধী আন্দোলনও প্রথম সাত দিন শান্তিপ্রিয়ই ছিল। সহিংসতার সঙ্গে যে বিএনপি জড়িত তা তাদের নেতৃবৃন্দের বিবৃতি থেকেই স্পষ্ট। দলটি গত কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করে আসছে অসাংবিধানিক পন্থায় সরকারের পতন ঘটাতে, যে কথা তারা রাখঢাক না রেখেই বলে বেড়াচ্ছেন। গত বছরের ২৮ অক্টোবর তারা রাস্তায় নেমে সরকার পতনের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা তো কারও অজানা নেই। তাদের নেতা মির্জা ফখরুল, রিজভী, আমীর খসরু সর্বদাই এ কথা বলছেন। তারা যে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের পন্থা হিসেবে লাশ দেখতে চান, সে কথাও তারা প্রতিনিয়ত বলে থাকেন। যে কটি অমূল্য জীবন ঝরে গেল তার পেছনে বিএনপি-জামায়াতের লাশের রাজনীতি তত্ত্ব নিশ্চিতভাবে কাজ করেছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন শহীদুল আলম নামক এক ক্যামেরাম্যান যিনি মহারাজাকার সবুর খানের ভাগনে। আরও যুক্ত হয়েছেন জিল্লুর রহমান নামক সেই ব্যক্তি যিনি বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনি খন্দকার আবদুর রশিদকে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে উপস্থাপিত করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন, যুক্ত হয়েছেন এমন কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় প্রভাষক মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী হিসেবে যাদের পরিচয় সর্বজনীন। নুরুল হক নূর নামক এক প্রাক্তন ছাত্রনেতা, যিনি ইসরায়েলি গোয়েন্দা বাহিনীর চর হিসেবে প্রমাণিত, স্বীকার করেছেন যে এক রাজনৈতিক নেতা তাকে ৪ লাখ টাকা প্রদান করেছেন সরকার পতনের আন্দোলন জোরদার করার জন্য। তিনি আরও স্বীকার করেছেন যে, নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজিব ভুইয়া, আবু বাকের মজুমদারের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে সরকার পতনের আন্দোলন জোরদার করার পরিকল্পনায় অংশ নেন, অথচ অন্য সমন্বয়করা সন্ত্রাসের পথে পা বাড়ানোর বিরুদ্ধে ছিলেন। এ তিন সমন্বয়কের সঙ্গে আগে থেকেই বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যান্য ধর্মান্ধ দলগুলোর সম্পর্ক ছিল। আরও দুজন সমন্বয়কের নাম সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ। এরা দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ লাভ করেছেন সাধারণ ছাত্রদের কাঁধে ভর করে। গোয়েন্দারা এ মর্মে গোপন তথ্য উদ্ঘাটন করতে পেরেছেন যে, লন্ডনে পালিয়ে থাকা তারেক জিয়া বাংলাদেশে তার অনুগতদের এই মর্মে নির্দেশ দিয়েছেন যে, পুলিশ হত্যা করা হলে ১০ হাজার এবং ছাত্রলীগ হত্যা করলে ৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে। গত ১৫ জুলাই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার চরম মিথ্যাচারের ওপর ভিত্তি করে বলে ফেলেছিলেন যে, বাংলাদেশে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ সেদিন কোনো নিহত হওয়ার ঘটনাই ঘটেনি। মিলার সাহেবের ওই মিথ্যানির্ভর উক্তি তথাকথিত আন্দোলনকারীদের হিংসাত্মক পন্থা অবলম্বনের জন্য উসকানি হিসেবে কাজ করেছে। বক্তব্যস্থলে খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা মুশফিকুল আনসারী যে সারাক্ষণ বসে থেকে মিলার সাহেবকে প্রতিনিয়ত কুপরামর্শ দিয়ে থাকেন তা কারোরই অজানা নয়।
গত ২১ জুলাই আপিল বিভাগ তাদের ঐতিহাসিক রায় প্রদান করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মাত্র ৫% এবং অন্য দুই শ্রেণির জন্য ২% কোটা রেখে ৯৩% কোটামুক্ত করে দেন। কিন্তু তার পরও সন্ত্রাসীরা ধ্বংসাত্মক কার্য চালিয়ে গেলে অবশেষে আমাদের গৌরবের সেনাবাহিনী দেশরক্ষার পবিত্র দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নামার পর পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত হয়েছে। সিসি টিভি দেখে দেখে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো রাষ্ট্রদ্রোহিদের অনেককেই গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। সবার দাবি, তাদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে বিচার করা হোক।
মহামান্য আপিল বিভাগ তাদের রায় যথোপযুক্ত করার জন্য সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন। এটি এমনই এক ক্ষমতা যার আশ্রয় নিয়ে আপিল বিভাগ আইনের বাইরে গিয়েও নির্দেশনা প্রদান করতে পারেন। আপিল বিভাগ মনে করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ৫% এবং অন্য দুটি শ্রেণির মানুষদের জন্য ২% কোটা থাকা বাঞ্ছনীয়, আর সে বিবেচনায়ই আপিল বিভাগ ১০৪ অনুচ্ছেদের আশ্রয় নিয়েছেন অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে। আপিল বিভাগের এ রায়কে অনন্য সাধারণ হিসেবে আখ্যায়িত করে বিজ্ঞজনরা মন্তব্য করেছেন। এটি নিশ্চিতভাবে একটি বিশ্ব মানের রায়। এ রায়ের পরে সাধারণ ছাত্রছাত্রী এবং মানুষ বুঝতে পেরেছেন যে, বিষয়টি আসলেই সরকারের ক্ষমতার মধ্যে ছিল না। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি চলে গেছেন। সাধারণ মানুষও সরব হচ্ছেন ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানো স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার চেয়ে। যারা এখনো মাঠে রয়ে গেছেন তারা যে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের অনুসারী এবং তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ পেয়ে মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন, সেসব তথ্য গোয়েন্দারা পেয়েছেন। সাধারণ ছাত্ররা এবং জনগণ প্রথম দিকে কিছুটা বিভ্রান্ত হলেও এখন তারা তথাকথিত সমন্বয়কদের আসল উদ্দেশ্য টের পেয়ে খেপে উঠেছেন। তারাও চাচ্ছেন ধ্বংসযজ্ঞকারীদের কঠোর সাজা। যে দেশের গোটা জনসংখ্যা ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করতে গিয়ে ৩০ লাখ লোক হারিয়েছিলেন, যে দেশের ৫ লক্ষাধিক নারী চরমভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন, সে দেশের মানুষ কখনো বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের প্রত্যাশিত তালেবানি তত্ত্ব মেনে নেবেন না, দেশকে আবার পাকিস্তানে রূপান্তরিত হতে দেবেন না। তারা জাগ্রত হয়েছেন বলে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের কুচক্রীরা আস্তে আস্তে পালাতে শুরু করেছেন যেমনটি তারা ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পরে করেছিলেন।
তারা শুধু ধ্বংসই করেননি, দেশের আন্তর্জাতিক ব্যবসাকেও ঠেলে দিয়েছেন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। এ আর্থিক অনটন থেকে মুক্তি পেতে কত সময় লাগবে তা নির্ধারণ করা অসম্ভব। তবে গোটা জনসংখ্যাই যে এর ভুক্তভোগী হবেন তা বলাই বাহুল্য। তাদের ব্যাপারে কঠোরতার কোনো বিকল্প নেই। তাদের বিচার করতে হবে, কবিগুরুর সে ভাষ্য অবলম্বন করে যেখানে গুরুদেব বলেছেন- ‘ক্ষমা যেথায় ক্ষীণ দুর্বলতা, হে রুদ্র কঠোর যেন হতে পারি তথা।’
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি