বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক অবস্থান এটিকে দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগতভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর সামুদ্রিক অঞ্চলে পরিণত করেছে। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ছাড়াও এশিয়ার অন্যান্য বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক প্রভাবশালী রাষ্ট্র দ্বারা বেষ্টিত বিশাল এলাকা এই সমুদ্রকে কেন্দ্র করে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্ব বাণিজ্য ও বৈশ্বিক সামগ্রিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ অঞ্চলে বিশ্বের জনসংখ্যার এক বিশাল অংশের আবাসস্থল এবং বঙ্গোপসাগর পূর্ব ও পশ্চিম গোলার্ধের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী মূল সামুদ্রিক প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্বের জাহাজযোগে বহন করা সিংহভাগ কনটেইনার এই সমুদ্র অঞ্চলের মধ্য দিয়ে পরিবহন করা হয়। এর অববাহিকায় থাকা সমুদ্রবন্দরগুলো বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থান, অত্যাবশ্যকীয় এবং ব্যস্ত সমুদ্রপথ ও অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক করিডর হিসেবে গুরুত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ভারতের মতো বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, সামরিক আধিপত্য বিস্তার ও কৌশলগত অংশীদারিকে ভিত্তি করে বেশ কিছুদিন ধরেই বঙ্গোপসাগর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এই বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনাপূর্ণ ও সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং ও সংবেদনশীল অঞ্চলের কেন্দ্রস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। জটিল ল্যান্ডস্কেপের মাঝে ভূরাজনৈতিক সুবিধাজনক অবস্থান বিবেচনায় এই দেশটিকে প্রায়শই বিভিন্ন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই বিশাল সমুদ্রের উপকূলবর্তী এশিয়ার অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক বিবেচনায় শক্তিশালী দুই দেশ চীন ও ভারত উভয়ই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আধিপত্য বিস্তার ও সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার লক্ষ্যে উদীয়মান অন্যান্য রাজনৈতিক মিত্রের সন্ধানে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মাঝে বিশাল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, কাঠামোগত ও তথ্যগত আদানপ্রদান নিশ্চিত করার জন্য সচেষ্ট হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়াকেন্দ্রিক চীনের ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ পলিসি
চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনসিয়েটিভ (বিআরআই) প্রজেক্টের মাধ্যমে এ অঞ্চলের সমুদ্রকেন্দ্রিক অবকাঠামো খাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে, যা প্রকারান্তরে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী দেশসমূহের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলো চীনের এই পদক্ষেপকে ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ কৌশলের অংশ হিসেবে বিবেচনা করছে, যা পারতপক্ষে বে অফ বেঙ্গলকে ঘিরে থাকা দেশের মাঝে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার আলোকে চীনের নিজস্ব সরব উপস্থিতি বা ভূরাজনৈতিক প্রাধান্য বিস্তারের চিত্র তুলে ধরে। বঙ্গোপসাগর ও এর মহীসোপানসংলগ্ন দেশগুলোর ভূমি বৈচিত্র্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সর্বোপরি জাতিগত পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তিশালী দেশগুলোর প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা প্রতিনিয়ত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। চীনের এই ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ পলিসি যে কোনো মানদণ্ডেই এ অঞ্চলে চীনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান আরও বেগবান এবং শক্তিশালী করেছে।
বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকাকেন্দ্রিক ভারতের চতুর্মুখী পররাষ্ট্রনীতি
বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে ভারতের অবস্থান, এই দেশটির বিশাল সমুদ্রসীমাকেন্দ্রিক ভূমিবৈচিত্র্য, বিশাল সামুদ্রিক সম্পদ এবং ক্রমবর্ধমান সামুদ্রিক অর্থনৈতিক ব্যাপ্তি তার কৌশলগত প্রভাব প্রসারিত করার অবারিত সুযোগ করে দিয়েছে। বঙ্গোপসাগরে ভারতের নিজস্ব সামরিক উপস্থিতি এবং অন্যান্য সহযোগী গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রসমূহের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সহ-অবস্থান তার নিজস্ব জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গোপসাগরের জলসীমা ভারতকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির জন্য সরাসরি সমুদ্রপথে প্রবেশাধিকার প্রদান করে, যা এই দেশটির জ্বালানি নিরাপত্তা ও নির্ভরতার অন্যতম মাধ্যম। ভারত পূর্ব ও দক্ষিণ এশীয় দেশসমূহের সঙ্গে অংশীদারি জোরদার করা, ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিপক্ষীয় হাইওয়ে এবং কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের মতো প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে সংযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। ভারত প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে তার সম্পর্ক গভীর করে এবং আঞ্চলিক অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করে বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানে অন্য দেশসমূহের প্রভাব মোকাবিলা করছে। এ ছাড়া নিজস্ব কৌশলগত পদচারণা বজায় রাখার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট রয়েছে।
বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক ভূরাজনৈতিক বর্তমান প্রেক্ষাপট
চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উপস্থিতির বিপরীতে অন্য দেশগুলো চতুর্মুখী নিরাপত্তা সংলাপ কোয়াডলি লেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগের (কোয়াড) মতো উদ্যোগের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছে। কোয়াড দেশগুলোর লক্ষ্য ইন্দোপ্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যে কোনো একক রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলা করা এবং অবাধ ও উন্মুক্ত সামুদ্রিক অবস্থান নিশ্চিত করা। বিশ্বের অন্যান্য মহীসোপান অঞ্চলের মতোই বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের মহীসোপান এলাকা এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক গতিশীলতাকে আরও বেগবান করে তুলেছে এবং অদূর ভবিষ্যতে আরও সমৃদ্ধিশালী করে তুলবে। বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশগুলো নিজ অর্থনৈতিক পটভূমিতে বঙ্গোপসাগরের ওপর কৌশলগত আধিপত্য বজায় রাখার বিষয়ে নতুন নতুন আঞ্চলিক সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট তৈরি করতে পারে বলে ধারণা করা যায়। এশিয়া দূর-প্রাচ্য, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রাধান্য বিস্তারকারী বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহ এ অঞ্চলকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও সামরিক করিডর হিসেবে এর বিকাশমান গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়ে এ অঞ্চলকে যে কোনো একক সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির একচ্ছত্র আধিপত্য থেকে দূরে রাখতে চায় বলে ধারণা করা হয়।
বঙ্গোপসাগরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার পটভূমিতে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ
বঙ্গোপসাগরের উত্তর প্রান্তে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতি ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রয়োজনে চীন, ভারতসহ যে কোনো আঞ্চলিক অথবা বৈশ্বিক শক্তিসমূহের সঙ্গেই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী। বাংলাদেশ তার ভূপ্রাকৃতিক অবস্থানগত সুবিধায় প্রতিযোগী আঞ্চলিক শক্তিসমূহের স্বার্থের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রসম্পর্কীয় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। প্রশ্নাতীতভাবে চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার এবং দেশের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোতে মূল বিনিয়োগকারী দেশ। পক্ষান্তরে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই ভৌগোলিক অবস্থানে বিশাল স্থলসীমা ভাগ করে পাশাপাশি অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, এই ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশ দুটি কিছু ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সম্পর্ক শেয়ার করে, যা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপারে উভয় দেশকেই সুবিধাজনক বাস্তবতা প্রদান করে।
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বাংলাদেশের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে এ অঞ্চলে দেশটির উজ্জ্বল সম্ভাবনা উপস্থাপন করেছে। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলসংযোগের মতো প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংযোগ ও সামষ্টিক বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা বহু গুণ বাড়িয়ে রাখার অবকাশ রেখেছে। এই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বাস্তবতায় বাংলাদেশকে অবশ্যই পররাষ্ট্র ও কূটনৈতিক অঙ্গনে যথেষ্ট সচেতন হতে হবে, কারণ বিআরআই-তে বাংলাদেশের আগ্রহ, অংশগ্রহণ এ অঞ্চলের রাজনৈতিক দিক থেকে নতুন মেরুকরণ ও উন্নয়নের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।
একই সময়ে বাংলাদেশ ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির (আইপিএস) একটি অংশগ্রহণকারী দেশ, যা অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি ভিন্নধর্মী উদ্যোগ। আইপিএসের লক্ষ্য সামুদ্রিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা, নৌ চলাচলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন জোরদার করা। আইপিএসে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা এটিকে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার পাশাপাশি এর কৌশলগত অংশীদারিকে বৈচিত্র্যময় করেছে।
বঙ্গোপসাগরের সামগ্রিক অর্থনীতি ও বাংলাদেশের কৌশলগত নন-অ্যালাইনমেন্ট পলিসি
বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে স্বার্থ জড়িয়ে থাকা এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যের দেশসমূহের প্রভাব ও ক্ষমতার লড়াইয়ে বাংলাদেশের সর্বোত্তম কর্মপন্থা হলো কৌশলগত নন অ্যালাইনমেন্ট নীতি গ্রহণ করা। নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখে এবং বিশ্বের তাবৎ বড় বড় সামরিক শক্তির মহড়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারে এবং ভূরাজনৈতিক জটিল পরিমণ্ডলে অন্য যে কোনো শক্তির অনুগত হওয়া এড়াতে পারে। এ পন্থা বাংলাদেশকে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক লাভজনক শর্তে যুক্ত হতে দেবে, এটি কোনো শক্তির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন বা বৈরিতা সৃষ্টি না করে এই কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন করা সম্ভব, যা এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্যও আশীর্বাদ হিসেবে দেখা হবে। একই সময়ে বাংলাদেশকে অবশ্যই বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক্যাল কো-অপারেশন (বিমসটেক) এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) মতো সংস্থাগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এবং গুরুত্বের সঙ্গে এটা অনুধাবন করতে হবে যে আঞ্চলিক জোটসমূহ ভবিষ্যতে আরও জোরালো এবং অর্থবহ ভূমিকা রাখবে। এ সংস্থাসমূহের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার বাংলাদেশকে আঞ্চলিক সংযোগ বাড়াতে, অর্থনৈতিক একীকরণ উন্নীত করতে এবং দারিদ্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তার মতো সাধারণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে।
সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতি এবং বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনা
বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের জন্য বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি করেছে। বিশেষ করে সামুদ্রিক অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান বিকাশের মাধ্যমে এ বিস্তৃতি আরও জোরালো হওয়ার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। সামুদ্রিক অর্থনীতির ধারণাটি কোনো বিশেষ অঞ্চলের, দেশের বা জাতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নত জীবিকা এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বের জন্য সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারকে ইঙ্গিত করে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সমুদ্রসীমা দাবির পক্ষে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়, বঙ্গোপসাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান, মৎস্যসম্পদ, পর্যটন এবং বন্দর উন্নয়নের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সামুদ্রিক অর্থনীতি অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ তার সামুদ্রিক অর্থনীতির কার্যক্রম থেকে বছরে ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে বলে অনুমান করা হয়েছে। এ আয়ের মূল খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ, জলজ সম্পদ, পর্যটন, জ্বালানি শক্তি এবং শিপিং ব্যবসা। এসব শিল্পের বিকাশে লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে, দ্রুত দারিদ্র্য হ্রাস করতে পারে এবং বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বিশাল অবদান রাখতে পারে।
বঙ্গোপসাগর এবং তৎসংলগ্ন জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের করণীয়
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে তার উপকূলীয় এলাকাগুলো রক্ষা করতে বাংলাদেশকে অবশ্যই টেকসই অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে সমুদ্রের কোলঘেঁষে বাঁধ নির্মাণ, পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা উন্নত করা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য আগাম সতর্কতা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন। বাংলাদেশের উচিত টেকসই মৎস্য ব্যবস্থাপনা এবং সামুদ্রিক সংরক্ষণের দিকে মনোনিবেশ করা। অতিরিক্ত মাছ ধরা, দূষণ এবং আবাসস্থল ধ্বংস বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য প্রধান হুমকি। কঠোর পরিবেশগত বিধিবিধান বাস্তবায়ন, পরিবেশবান্ধব পর্যটনের প্রচার এবং মাছ ধরা ও সংরক্ষণে টেকসই পদ্ধতি গ্রহণ করা বঙ্গোপসাগরের সুফল জলজ অর্থনীতি নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে।
বিকাশমান সামুদ্রিক অর্থনীতি ও বাংলাদেশের করণীয়
‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মূলনীতি সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সামুদ্রিক অর্থনীতি ও ভূপ্রাকৃতিক সুবিধাকে বৈশ্বিক বৃহৎ শক্তিসমূহের সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দরকষাকষি এবং একই সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নবদিগন্তের সূচনা করেছে। সামুদ্রিক ভূপ্রাকৃতিক কর্তৃত্বের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির সঙ্গে, বাংলাদেশকে অবশ্যই এমন নীতি গ্রহণ করতে হবে, যা পরিবেশগত অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান এবং সঙ্গে সঙ্গে সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারকে উন্নত করবে। একই সময়ে সামুদ্রিক শাসনকাঠামো বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা নির্ধারণ করবে যে, এটি দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধির জন্য তার কৌশলগত অবস্থান কতটা ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অবশ্যই তার একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল রক্ষা করতে এবং জলদস্যুতা, অবৈধ মানব পাচারসহ নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা করার জন্য তার নৌ সামরিক শক্তি ও সামুদ্রিক নজরদারি ক্ষমতা জোরদার করতে হবে, যা এ অঞ্চলে সামরিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রে নতুন মেরুকরণ হতে পারে।
বাংলাদেশের উচিত তার অংশীদারি বহুমুখী করার দিকে নজর দেওয়া। এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রাখার সময় বাংলাদেশকে অন্যান্য আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তিসমূহের সঙ্গে জোট গড়ে তুলতে হবে, যাতে নিশ্চিত করা যায় যেন কোনো একক দেশ তার সামুদ্রিক অঞ্চল ও কৌশলগত অংশীদারি নিয়ে কোনোরকম আধিপত্য না করে। জাতিসংঘ, আসিয়ান এবং আইওআরএর মতো বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা কেবল বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশের অবস্থানকে সুদৃঢ় করে তুলবে না বরং সামুদ্রিক বিরোধ মোকাবিলার উদ্যোগসমূহের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন নিশ্চিত করতে সুবিধা প্রদান করবে।
বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ঝুঁকি নিঃসন্দেহে বেশি। এর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জাতীয় নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক প্রভাব এ গতিশীল অঞ্চলে তার কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার ওপর নির্ভর করে, বাংলাদেশকে অবশ্যই তার স্বার্থ রক্ষার জন্য কূটনৈতিক ভারসাম্যমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে, যা হতে হবে একটি অগ্রগতি-চিন্তামূলক জোট নিরপেক্ষ নীতি, যা আঞ্চলিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করবে। সামুদ্রিক কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশকে অবশ্যই অত্যন্ত সাহসী এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশ যাতে তার অবারিত সামুদ্রিক অর্থনৈতিক অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে পরিবেশগত উদ্বেগগুলো মোকাবিলা করা, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন এবং সম্পদের অত্যধিক শোষণের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। জ্বালানি শক্তি বৃদ্ধি করে এবং উন্নয়নের একটি টেকসই গতিপথ বজায় রাখার জন্য কূটনৈতিক ভারসাম্যমূলক পদক্ষেপ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে।
উপসংহার
বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বিপুল অর্থনৈতিক সুযোগের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। বৈশ্বিক শক্তিগুলো বঙ্গোপসাগরের মূল সামুদ্রিক সম্পদ এবং কৌশলগত করিডরের ওপর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। সামুদ্রিক অর্থনীতির ক্রমবিকাশমান সম্ভাবনা ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা থেকে বৈশ্বিক শক্তিসমূহের প্রতিযোগিতা এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে নতুন মেরুকরণ করেছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিহিত রয়েছে তার সামুদ্রিক নীতিগুলোকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারি জোরদার এবং নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই গতিশীলতাগুলোকে দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করার ক্ষমতার ওপর অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই থাকবে। এ নীতির মূল অগ্রাধিকার হবে সামুদ্রিক অর্থনীতির অনুশীলনগুলো একীভূত করা, যা কেবল সম্পদ তৈরিই করে না বরং সামুদ্রিক বস্তুতান্ত্রিক সমৃদ্ধি নির্ধারণ করে এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তিও প্রচার করে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শক্তিশালী প্রতিবেশীদের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক ধরে রাখার ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে এবং বঙ্গোপসাগরের সম্পদের ওপর কারও একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রোধ করে বৈশ্বিক শক্তির বিস্তৃত সারির সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। সাগর মোহনার এ বিকশিত শক্তির গতিশীলতায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তার নিজস্ব কৌশলগত, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত লক্ষ্যগুলো সুরক্ষিত করার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগী বৈশ্বিক স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক বিকাশ ও নিজস্ব বলয়ে সার্বভৌমত্ব রক্ষাকে সামনে রেখে যে নীতি গ্রহণ করে, তা আগামী দিনের প্রভাব ও সমৃদ্ধি নির্ধারণে নিয়ামক হবে। বিশ্বশক্তির পরিবর্তনশীল জোয়ারের মধ্যে বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে উন্নতি করতে পারবে কি না, তা নিশ্চিত করবে দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতি। কৌশলগত দূরদর্শিতা এবং সক্রিয় কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ তার সমৃদ্ধির ভিত্তিপ্রস্তরে বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশির আছড়ে পড়া বিশাল সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার ও আগামী বছরগুলোতে জাতির জন্য একটি স্থিতিশীল এবং নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার ক্ষমতা রাখে।
লেখক : কর্নেল আব্দুল্লাহ মোর্শেদ, পিএসসি, অ্যাডহক মিলিটারি, পুলিশ পরিদপ্তর, সেনা সদর