চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবহন বিভাগের প্রধান হয়ে সীমাহীন দুর্নীতি শুরু করেন তিনি। পণ্য খালাস থেকে শুরু করে কনটেইনার হ্যান্ডলিং, বার্থিং, নতুন যন্ত্রপাতিকে স্ক্র্যাপ বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ, টেন্ডারবাজি এবং অবৈধ অর্থ লেনদেনের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। এই ‘তিনি’ হচ্ছেন চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবহন বিভাগের প্রধান এনামুল করিম। বন্দরে তাঁকে পরিবহন দুর্নীতির বরপুত্র বলে অভিহিত করা হয়।
বন্দর ব্যবহারকারী, ব্যবসায়ী ও বন্দরের একাধিক কর্মকর্তার অভিযোগ, তাঁর কারণে চট্টগ্রাম বন্দর আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে। সম্প্রতি দুদক তাঁর বিরুদ্ধে কয়েক কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে। সূত্র জানান, বন্দরের জেটি, শেড, ইয়ার্ড, মুরিং, অ্যাংকরেজসহ বিভিন্ন টার্মিনালের কার্যক্রম তদারকি করে চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবহন বিভাগ। এ ছাড়া আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী জাহাজ থেকে মালপত্র খালাস এবং জাহাজে মালপত্র বোঝাই করার পুরো প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় কি না তা নিশ্চিত করে। বন্দরে আসা-যাওয়া সব ধরনের পণ্য এবং কনটেইনারের ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ পরিবহন বিভাগের দায়িত্বে থাকে। বন্দরের ভিতরে ট্রাক, লরি ও অন্যান্য যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে, যেন টার্মিনালের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত না হয়। বন্দর ব্যবহারের জন্য ট্রাফিক ম্যানুয়াল এবং বিভিন্ন নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়ন করে। এর মাধ্যমে বন্দরের সার্বিক কার্যক্রমের শৃঙ্খলা বজায় থাকে। পণ্যের শুল্ক ছাড়পত্র, ব্যাংক লেনদেন, জাহাজের সময়সূচি এবং অন্যান্য সম্পর্কিত তথ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও এ বিভাগ পালন করে। এসব কাজের প্রধান দায়িত্বে রয়েছেন এনামুল করিম। তিনি ১৭ বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত। বন্দরসংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি পণ্য নিয়ে জাহাজ বার্থিংয়ের পর শুরু হয় ঘুষের দৌরাত্ম্য। পণ্য খালাস, রিলিজ এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য প্রতি ধাপে একাধিক খাতে অর্থ আদায় করা হয়। পণ্য আমদানির পর খালাসের জন্য ৩১ খাতে, বন্দর থেকে রিলিজ নিতে ১৮ খাতে এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ১১ খাতে বাড়তি অর্থ দিতে হয়। এনামুল করিমের বিরুদ্ধে বন্দরের যন্ত্রপাতি কেনাকাটা ও স্ক্র্যাপ বিক্রিতে বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে। বন্দরের সেন্ট্রাল ওয়ার্কশপে সামান্য ক্রুটিযুক্ত যন্ত্রাংশ ‘স্ক্র্যাপ’ হিসেবে চিহ্নিত করে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করা হয়। অভিযোগ রয়েছে এসব স্ক্র্যাপ টেন্ডার প্রক্রিয়ায় নিজেদের লোকদের মাধ্যমে কিনে আবার নতুন হিসেবে বন্দরে ব্যবহার করা হয়। বন্দরের একাধিক কর্মকর্তার মতে এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি। উদাহরণস্বরূপ সম্প্রতি কালমারের সামান্য নষ্ট হওয়া চাকাগুলো স্ক্র্যাপ হিসেবে প্রতিটি ১৫ লাখ এবং বার্থওভারের স্পাইডার ৩৫-৪০ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। এসব কাজে সেন্ট্রাল ওয়ার্কশপের মান্না ও তাঁর সহযোগী আবদুল হক এবং কাসেম ওরফে ‘চাক্কা কাসেম’ এনামুল করিমের হয়ে কাজ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বন্দরের এক আমদানিকারক বলেন, এনামুল করিম চট্টগ্রাম বন্দর থেকে শুরু করে নৌপরিবহন পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ থাকার পরও নিজপদে বহাল রয়েছেন। এ ছাড়া কোনো আমদানিকারক কিংবা ব্যবসায়ী অভিযোগ করলে তাঁরা কয়েক কোটি টাকার পণ্য আটকে রাখেন। মূলত লোকসানের ভয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলেন না। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পোর্ট ক্লিয়ারেন্স সংগ্রহের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। পরে জাহাজ বন্দরে বার্থিংয়ের পর অন বোর্ড কাস্টমস বুকিংয়ের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৫০০ টাকা দিতে হয়। পুনরায় জাহাজে অন বোর্ড পরীক্ষণ শেষে স্টোর লিস্ট তৈরি, বন্ড সিলসহ বিভিন্ন কাজ শেষে প্রতিবেদন প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কাস্টম কর্মকর্তাকে ন্যূনতম তিন কার্টন বিদেশি সিগারেট বা সমপরিমাণ বিদেশি অ্যালকোহলের বোতল দিতে হয়। বন্দরের নিয়মানুসারে বহির্নোঙর থেকে জাহাজ বন্দরে আনা ও ছেড়ে যাওয়ার জন্য পাইলটের সহায়তা নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে পাইলটকে দুই কার্টন সিগারেট বা সমপরিমাণ বিদেশি অ্যালকোহলের বোতল ঘুষ দিতে হয়। জাহাজের ড্রাফট বা দৈর্ঘ্য অনুমোদিত সীমার বেশি হলে প্রতি ইঞ্চি অতিরিক্ত ড্রাফটের জন্য ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়। এ ঘুষের একটি অংশ চলে যায় চট্টগ্রাম বন্দর পরিবহন বিভাগের প্রধানের কাছে-এমন অভিযোগ রয়েছে। কারণ তিনি এসব দেখভাল করে থাকেন। ব্যবসায়ীদের আরও অভিযোগ, জাহাজ থেকে দ্রুত পণ্য নামাতে, পছন্দমতো স্থানে কনটেইনার রাখতে বা ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টারে নথিপত্র যাচাই করতে কর্মকর্তারা অর্থ দাবি করেন। চাহিদামতো অর্থ না দিলে নথিপত্রে ত্রুটি আছে বলে হয়রানি করা হয়। কনটেইনার স্ক্যানিং বা কায়িক পরীক্ষার সময়ও দ্রুত কাজ সম্পন্ন করার জন্য অর্থ দেওয়া বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে। বিভিন্ন ধরনের পণ্যের জন্য অর্থের পরিমাণ ভিন্ন হয়। টেক্সটাইল মেশিনারিজ, কাগজ, কসটিক সোডা, প্লাস্টিক মোল্ডিং কম্পাউন্ড, হার্ডবোর্ড, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ইত্যাদির ক্ষেত্রে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থ দিতে হয়। তুলনামূলক কম মূল্যের পণ্য যেমন লিফট, তেল, তুলা, খাদ্যশস্য ইত্যাদির ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। মূলত একটি কনটেইনার বন্দর থেকে খালাস করতে ব্যবসায়ীদের দালিলিক প্রমাণ ছাড়া ২ লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা বেশি অর্থ দিয়ে ছাড় করতে হয়। না হলে ওসব কনটেইনার বন্দরে দিনের পর দিন পড়ে থাকে। এ বাড়তি অর্থ বিভিন্ন জনের হাত ঘুরে চলে যায় পরিবহন বিভাগের প্রধানের পকেটে-এমন অভিযোগ বন্দর ব্যবহারকারীদের। এনামুল করিমের বিরুদ্ধে শুধু ঘুষ নয়, বন্দরের টাকা আত্মসাতেরও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তিনি ডেপুটি ট্রাফিক ম্যানেজার (অপারেশন) থাকাকালে মেসার্স ইউনিবেঙ্গল কনটেইনার ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড নামে একটি শিপিং এজেন্টের রিভলভিং হিসেবে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকা সত্ত্বেও বিধি লঙ্ঘন করে তাদের ছাড়পত্র দেন। এর ফলে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটির কাছে পাওনা ১০ কোটি ৩২ লাখ টাকা আদায়ে সংকটে পড়ে। দুদক এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে এবং চিঠিতে স্পষ্ট উল্লেখ করেছে, এনামুল করিম শিপিং এজেন্টের সঙ্গে যোগসাজশ করে বন্দরের এ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বন্দরের বিভিন্ন পদে শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও বড় অঙ্কের ঘুষ লেনদেন হয়। প্রতি নিয়োগের জন্য ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দরের ওয়েবসাইটে থাকা তাঁর ফোন নম্বরটি বন্ধ রেখেছেন। ফলে বারবার চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।