এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে বিপ্লবীরা না হলে জুলাই বিপ্লব হতো না। জাতির ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অভ্যুত্থানও ঘটত না। ১৬ বছরের জগদ্দল পাথর জাতি সরাতে পারত না। বিপ্লবীদের কারণে সব রাজনৈতিক দল আজ নিজেদের মতো করে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছে। সেজন্য দেশবাসী তাদের কাছে নিশ্চয় কৃতজ্ঞ। কিন্তু অপ্রিয় হলেও কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, গত এক বছরে তারা দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। তাদের নামে চব্বিশের জুলাইতে যারা উল্লাস করেছে, তাদের অনেকেই এখন চুপচাপ হয়ে গেছে। অনেকেই মানসিকভাবে বিমর্ষ হয়ে গেছে। কারণ তারা যা প্রত্যাশা করেছিল, তা পায়নি। প্রত্যাশা আহত হলে পৃথিবীর সব মানুষই কষ্ট পায়। কেউ প্রকাশ করে, কেউ করে না। তবে সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। বিপ্লবীদের প্রতি মানুষের ভালোবাসা এখনো শূন্যের কোঠায় নামেনি। সর্বশেষ সুযোগ তাদের সামনে এখনো আছে। আগামী নির্বাচন কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে বিভাজন, দেশবাসীর মধ্যে যে উৎকণ্ঠা তা ইচ্ছা করলে বিপ্লবীরা নিমেষেই দূর করতে পারে। তারা আবার ফিরে পেতে পারে দেশবাসীর ভালোবাসার সিংহাসন। সবার মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় তাদের উদ্যোগে বিমর্ষ জাতি ফিরে পেতে পারে নতুন উদ্যম। আর এটাই হলো বিপ্লবীদের হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার সর্বশেষ সুযোগ। দেশের মানুষ জন্মগতভাবেই জাতিগত সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী। একই পাড়ায় পূজাও হয়, মসজিদে আজানও হয়। পূজার ঢাকঢোল, শঙ্খ বাজে, কোরআন তেলাওয়াতও হয়। এমন এক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের মাঝে প্রতিবেশী দেশ আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রধান উপদেষ্টার অবয়বে তৈরি করেছে অসুরের মূর্তি। তাদের এ ধরনের আচরণের নিন্দা করার ভাষা নেই। তারা ধর্মপালনের নামে প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরিতার সম্পর্ক তৈরির অপচেষ্টা করছে। এ ধরনের হীনমন্যতার জন্য তাদের প্রতি করুণা প্রদর্শন ছাড়া আর কোনো শুভাশিস নেই। তাদের এমন কুরুচিপূর্ণ আচরণ পারস্যের কবি শেখ সাদির কবিতা মনে করিয়ে দেয়, যা ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অনুবাদ করে ‘উত্তম ও অধম’ কবিতাটি রচনা করেছেন। সেই কবিতার চারটি লাইন উদ্ধৃত করা যায়, ‘কুকুরের কাজ কুকুরে করেছে/কামড় দিয়েছে পায়,/তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে/মানুষের শোভা পায়?’
চব্বিশের অভ্যুত্থানে ৩ আগস্ট বিপ্লবী নাহিদ ইসলাম যখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ৯ দফার পরিবর্তে ১ দফার কর্মসূচি ঘোষণা করেন, তখন জনতার স্রোত তাকে পূর্ণাঙ্গ সমর্থন দিয়েছিল। আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া যখন আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করেছিলেন, তখন একইভাবে জনতা তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিল। পরবর্তীতে ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্টের পতন হলো, বিপ্লবীরা হয়ে উঠল আমাদের অহংকার। কিন্তু অনেক কারণে সেই বিপ্লবীরাই আজ নানান আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু। পাশের দেশ নেপালেও আমাদেরই মতো বিপ্লব হয়েছে। দেশটির সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে প্রথমে তিনজন মন্ত্রী নিয়োগ করেন। পরে আরও পাঁচজনকে নিয়োগ দেন। বর্তমানে মন্ত্রিসভার সদস্য আটজন। সুশীলা দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই বিবৃতিতে ২০২৬ সালের ৫ মার্চ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে তাঁর সরকার দুর্নীতি প্রতিরোধ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সরকারি কাজগুলোর স্বচ্ছতা ও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন। জেন-জির এ আন্দোলনকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি সবাইকে যার যার কাজে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ছাত্রদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি তাঁর মন্ত্রিসভায় বা সরকারের কোনো পর্যায়ে কোনো বিপ্লবীকে বসাননি। আমাদের দেশে হয়েছে ঠিক এর উল্টো। আমরা এখনো নির্বাচনের তারিখই ঘোষণা করতে পারলাম না। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে বিপ্লবীদের সরকারের উপদেষ্টা বানিয়ে ক্ষমতার ভাগ দিলেন। বিপ্লবীরা মহানন্দে ন্যায্য হিস্সা বিবেচনা করে ক্ষমতার ভাগ নিয়ে নিল। এটাই ছিল বিপ্লবীদের সবচেয়ে বড় ভুল। তারা ক্ষমতার ভাগ না নিয়ে যদি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে ক্ষমতার বাইরে থেকে সরকারকে সহযোগিতা করত, তাহলে দেশের অনেক বেশি উপকার হতো। তারপর কিছু সুযোগসন্ধানী, মায়ে তাড়ানো বাপে খেদানো কিছু টাউট বৈষম্যবিরোধী পরিচয়ে সারা দেশে নানান অপকর্ম করতে শুরু করে। সেই সঙ্গে চলতে থাকে মব ফ্যাসিজম। এ উচ্ছৃঙ্খল দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় সাধারণ মানুষ আস্তে আস্তে বৈষম্যবিরোধীদের প্রতি বিরক্ত হতে শুরু করে। এরপর গঠন করা হয় রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। সেই সঙ্গে বিপ্লবীদের কয়েকজন সেনাবাহিনী, সেনাপ্রধান, নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যমের প্রতি চোখ রাঙানো শুরু করে। একপর্যায়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেনাবাহিনী ইস্যুতে নানান কটূক্তির জবাবে বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘যারা এসব করছে, তাদের বয়স কম। তারা আমাদের সন্তানের বয়সি। তারা বড় হলে নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে। তখন নিজেরাই লজ্জিত হবে।’ আরও অনেক ইস্যুতে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে তাদের অনেক শত্রু তৈরি হয়। যত দিন যাচ্ছে, তত বেশি নেতিবাচক ইস্যু বিপ্লবীদের ইমেজ ক্রমেই মøান কর দিচ্ছে। বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতেও তারা এখন নানাভাবে আলোচনায়। সরকার যেখানে সবাইকে নিয়ে একটি জুলাই সনদ করতে যাচ্ছে, তখন বিপ্লবীরা যদি সরকারকে ধমকের সুরে কথা বলে, তাহলে তা শোভন হয় না। প্রতীক না দিলে নির্বাচন করতে দেব না, এমন উদ্ধত আচরণও কাম্য নয়। কারণ অনেক ভুলের মাঝেও দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী বিপ্লবীদের প্রতি এখনো আস্থা রাখতে চায়। আচরণগত কোনো বৈকল্যে তাদের ইমেজ নষ্ট হোক, এটা প্রত্যাশিত নয়।
রাজনীতির পথ চিরকালই পিচ্ছিল। এ পথে চলতে গিয়ে একবার হোঁচট খেলে আর সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না। দেশবাসী চায় এনসিপি শক্তভাবে পথ চলতে শিখুক। ভুল তাদের হতেই পারে, তাই বলে তাদের সবই ভুল এমনও নয়। মনে রাখতে হবে, তাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো তারা দেশ ফ্যাসিস্টমুক্ত করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের দল এনসিপি বিচক্ষণতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে রাজনীতির স্টিয়ারিং আবারও তাদের হাতে চলে আসতে পারে। এখন সব রাজনৈতিক দলের একমাত্র এজেন্ডা ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতা তারেক রহমান হয়তো খুব শিগগিরই দেশে ফিরবেন। নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে প্রতিটি আসন ধরে ধরে দলটি প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ করছে। আনুষ্ঠানিক প্রার্থী ঘোষণার পর শুরু হবে মাঠপর্যায়ের নির্বাচনি যুদ্ধ। আরেক শক্তিশালী দল জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনি কৌশলে একটু এগিয়ে আছে। প্রতিটি আসনে তারা একজন করে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির ডাকসু ও জাকসুতে বিশাল বিজয় অর্জন করেছে। এর ফলে তাদের মনোবল অনেক চাঙা হয়েছে। জামায়াত জুলাই সনদ কার্যকর এবং পিআরের পক্ষে শক্ত অবস্থানে আছে। আর বিএনপি পিআরের বিপক্ষে। এ দুটি দল দীর্ঘদিন মিত্র হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছে। কখনো মান, কখনো অভিমান দুই দলের মধ্যে ছিল। এখনো আছে। এ মান-অভিমান হলো রাজনীতির অঙ্কের হিসাবে যোগ-বিয়োগের খেলা। অন্য দলগুলোও নির্বাচনি নানান কৌশল নিয়ে দেনদরবার করছে। মোটকথা নির্বাচনি ট্রেনে চাপতে কেউ বসে নেই। এখন চলছে নির্বাচনি দৌড়ের জন্য প্রস্তুতি পর্ব। এ পর্বে দৌড়ের মাঠ কার জন্য কেমন তা নিয়ে চলছে হিসাবনিকাশ, দেনদরবার। এ অবস্থায় দেশের বৃহত্তর কল্যাণে এনসিপির নেতারা ইচ্ছা করলে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে আবার ফিরে পেতে পারেন রাজনীতির স্টিয়ারিং। সব রাজনৈতিক দলকে বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতের দূরত্ব কমিয়ে, নিজেদের দাবির প্রতিও অনড় না থেকে যদি কল্যাণকর সমঝোতায় ভূমিকা রাখেন, তাহলে তারা আবার সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন। এটা তাদের জন্য সর্বশেষ সুযোগ। কারণ সবাইকে বুঝতে হবে, দেশের মানুষ নির্বাচন চায়। দেশের মানুষ শান্তি চায়। নিয়ন্ত্রিত আইনশৃঙ্খলা চায়। সমৃদ্ধ অর্থনীতি চায়।
দুর্গাপূজা সনাতনধর্মাবলম্বী বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। এর ইতিহাস অনেক প্রাচীন। পুরাণমতে মহিষাসুর নামে এক দানব পৃথিবী, স্বর্গ-মর্ত্য দখল করে নিয়েছিল। তখন দেবতারা একত্র হয়ে মহাশক্তিশালী দেবী দুর্গাকে সৃষ্টি করেন। তিনি দশভুজা অর্থাৎ দশ হাত নিয়ে আবির্ভূত হন এবং মহিষাসুরকে হত্যা করেন। এ ঘটনাই দুর্গাপূজার মূলভিত্তি। ইতিহাসবিদদের মতে রাজা কংসনারায়ণ বর্তমান রাজশাহী জেলার তাহেরপুরে প্রথম দুর্গাপূজা শুরু করেন। পরে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কয়েক দিনব্যাপী জাঁকজমকভাবে সর্বজনীন দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। আজ পূজার দশমী। অর্থাৎ আজ দেবী কৈলাসে ফিরে যাবেন। এ বছর দুর্গা হাতির পিঠে চড়ে মর্ত্যে এসেছিলেন এবং দোলায় চড়ে কৈলাস যাবেন। দেবীর আগমন হাতির পিঠে হলে তা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়, যা পৃথিবীকে শস্যশ্যামলা ও সমৃদ্ধ করে তোলে। তবে গমন দোলায় হলে তা মহামারি বা মড়কের মতো অশুভ ইঙ্গিত বহন করে। এ বছর বাংলাদেশে ৩৩ হাজার ৩৫৫টি মণ্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার মণ্ডপের সংখ্যা বেশি। এর কারণ বাংলাদেশে যে দল অর্থাৎ যে মতের সরকারই ক্ষমতায় থাক না কেন, প্রতিবেশী ভারতের তুলনায় এ দেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি বেশি। আমরা ঐতিহ্যগতভাবেই আমাদের সম্প্রীতি রক্ষা করেছি। পূজার উপহার হিসেবে আমাদের সরকার ভারতে ইলিশ মাছ পাঠিয়েছে। কিন্তু ভারত ঐতিহ্যগতভাবেই সম্প্রীতি নষ্ট করেছে। ভারতের বিভিন্ন মন্দির ও মণ্ডপে আমাদের প্রধান উপদেষ্টার মুখাবয়বে অসুর বানিয়ে জঘন্য নীচতা ও হীনতার পরিচয় দিয়েছে। জাতিগত বিভেদের উসকানি দিয়েছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটা নষ্ট করেছে। অবশ্য এটাই সত্য, ভারত যার বন্ধু তার অন্য কোনো শত্রুর দরকার নেই। প্রতিবেশী হয়ে একটা পবিত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যেও ভারত সেটাই আবার প্রমাণ করল।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
ইমেইল : [email protected]