ইচ্ছা ছিল ঘেডি নিয়ে কিছু লিখব। ঘেডির সঙ্গে এক বেডির গল্পও মনে পড়ে গেল। আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের চরফ্যাশনের ঘটনা। সংগতিপূর্ণ জনৈক ভদ্রলোকের ঘরে দুই বিবি। একজন সুন্দরী আর অন্যজন গুণবতী। দুজনই স্বামী সোহাগী কিন্তু নিজেদের মধ্যে বেজায় রেষারেষি। বড় বিবির কন্যার গৃহশিক্ষক একদিন জ্যামিতি পড়াচ্ছিলেন। যেখানে তিনি শেখাচ্ছিলেন ABD=OBD অর্থাৎ এবিডি সমান ওবিডি। স্বামী সোহাগী সুন্দরী ছোট বিবি যার লেখাপড়া হয়তো প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত ছিল। তিনি শিক্ষক ও ছাত্রীর মুখে কয়েকবার এবিডি সমান সমান ওবিডি শুনে মেজাজ হারালেন। তারপর যেভাবে অগ্নিশর্মা হয়ে গৃহশিক্ষকের দিকে তেড়ে এলেন, সে কথা নিয়ে একটু রঙ্গরস করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু দেশের জটিল রাজনীতির কারণে মানুষের মনে যে জগদ্দল পাথর চেপে বসেছে তাতে করে ঘেডি বেডির কাহিনি শোনার ধৈর্য কজনের আছে, তা আমার জানা নেই।
আমার শৈশবের একটি অংশ কেটেছে ফরিদপুরে। ওখানে মানুষের ঘাড়কে ঘেডি বলা হয়। তার পেটের চর্বিকে বলা হয় নুন্তি। এটা অবশ্য সত্তর দশকের গ্রামবাংলার কথা। কারও জিদ প্রবল হলে অথবা কেউ বেয়াড়া প্রকৃতির হলে বলা হতো ওর ঘেডি বাঁকা কিংবা ওর ঘেডিতে চর্বি জমেছে। কিন্তু হঠাৎ করে কারও টাকাপয়সা হলে বিশেষত আঙুল ফুলে কলা গাছ হলে তার শরীরে সাধারণত মেদভুঁড়ি দেখা দিত আর গ্রামবাসী ওসব মানুষকে টিটকারি করার জন্য বলত দ্যাখো দ্যাখো টিডিক্ক্যার পোলার নুন্তি হয়েছে। সমাজে অনাহূত কিছু ঘটলে আমজনতা সেই সময়ে যে প্রতিক্রিয়া দেখাত, তা উপেক্ষা করার ক্ষমতা ঘাড় বাঁকা প্রকৃতির বেয়াড়া অথবা অবৈধ উপার্জনের মেদভুঁড়িওয়ালাদের ছিল না। ফলে এসব মানুষ প্রায়ই গ্রাম ছেড়ে ভিন্ন এলাকায় বসতি গড়ত।
আবহমান বাংলার উল্লিখিত দৃশ্য এখন নেই বললেই চলে। ঘাড় বাঁকা এবং শক্ত মেরুদণ্ডের মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে এবং মেদভুঁড়ি নিয়ে টিটকারি করার দুঃসাহস এখন আর অবশিষ্ট নেই। পরিবর্তে নতজানু হয়ে স্বার্থের জন্য অথবা ভয়ে মাথার খুলি প্রভাবশালীদের পায়ের ওপর রেখে মস্তিষ্কের ভিতরের সারবস্তু অর্থাৎ ঘিলু বের করে তার সঙ্গে কালো রং মেখে ক্ষমতাধর লোকজনের জুতো পলিশ করে শূন্য মস্তিষ্ক নিয়ে লম্ফঝম্ফ করাকে অনেকে মানবধর্ম হিসেবে ধ্যানজ্ঞান করেন। আজকের দিনে অসহায় দুর্বল দরিদ্র এবং হতাশ প্রকৃতির লোকজন বেকার হয়ে পড়লে রোগশোকে তারা স্থূলকায় হয়ে পড়ে। ঘি-মাখন, মাছ-মাংসের তেলচর্বি এবং সুরসংগীত ও বাইজির নাচে মুগ্ধ নাগরের শরীরের নুন্তি আধুনিককালে কল্পনাও করা যায় না।
সমাজে দুর্নীতিবাজদের স্বাস্থ্যসচেতনতা প্রবল। নারী-পুরুষ উভয়েই জিরো ফিগারের জন্য শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে। নিজেদের কামভাব এবং শরীরের কমনীয়তার জন্য অনেকে অস্ত্রোপচার পর্যন্ত করে। বিশেষ অঙ্গ ছোট বড় করতে গিয়ে যেসব লঙ্কাকাণ্ডের খবর মাঝেমধ্যে ফাঁস হয়ে যায় তাতে করে আমাদের মতো প্রাচীনপন্থি মানুষ ভেবেই পায় না- ওসব কাণ্ডকারখানা করার কী দরকার। নগর-মহানগরে ধনীদের চিত্তবিনোদনের বিচিত্র-বাহারি এবং বিকৃত ধরন প্রকৃতির সঙ্গে মাদক-জুয়া-যৌনতা এবং এতদসংক্রান্ত কাজকারবার সন্ত্রাস যেভাবে বাড়ছে সেগুলোর উত্তাপে সাধারণ মানুষের নুন্তি যে কখন পানি হয়ে ঝরে পড়েছে তা লক্ষ করার আগেই চলতি বছরের সম্ভাব্য জিডিপি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মনমস্তিষ্কে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছর জিডিপি নেমে আসতে পারে সাড়ে তিন শতাংশে। অথচ ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময়টিও জিডিপির পরিমাণ ছিল সাড়ে ছয় শতাংশ। সারা বাংলাদেশের মানুষ সবাই মিলে যে কাজকর্ম করে তার গড় হিসাব উঠে আসে জিডিপির মাধ্যমে। আমাদের দেশের জিডিপির বিরাট অংশ নির্ভর করে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ওপর। অর্থাৎ সরকারি বাজেটে যে পরিমাণ অর্থ রাস্তাঘাট, পুলকালভার্ট, ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্পে যে অর্থ ব্যয় হয় তার ওপর জিডিপির স্থিতি নির্ভর করে। সাধারণ জনগণের বিনিয়োগ বিশেষ করে শিল্প-বাণিজ্য-গৃহায়ন-নগদ অর্থ ব্যাংক-বিমায় বিনিয়োগ কর্মসংস্থান এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতার পাশাপাশি আমদানি ও রপ্তানির সঙ্গেও জিডিপি জড়িত।
উল্লিখিত জিডিপির ক্ষেত্র অধিক্ষেত্র এবং আওয়ামী লীগ পরবর্তী বছরের অর্থনীতির হালচাল এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যা কি না, দেশের সামগ্রিক সুখানুভূতি, হতাশা, আতঙ্ক, অর্শিক্ষা, কুশিক্ষা, শ্রমশক্তি বিনাশ, ব্রেন ড্রেন অর্থাৎ বুদ্ধিসুদ্ধি নর্দমায় পড়ে যাওয়াসহ মানুষের সহজাত হাসিকান্না, চিন্তা করার ক্ষমতা, ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি অধঃপতনের অতলান্তে নিয়ে গেছে। ফলে আমাদের সন্দেহ বেড়ে যাচ্ছে। কাজ করার পরিবর্তে অলস বসে পরনিন্দা অপরের সর্বনাশ করার ফন্দিফিকির বেড়ে যাচ্ছে। আমরা সহজাত মানবিক পরিশ্রম-উদ্ভাবনী শক্তি এবং প্রতিযোগিতা করার পথ পরিহার করে অপরের সহায়সম্পদ-ব্যবসাবাণিজ্য সুনাম-সুখ্যাতি হরণের জন্য মব সন্ত্রাসে ক্রমেই দক্ষ হয়ে উঠেছি।
গত এক বছরে দেশের শীর্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং মাঝারি আকারের কলকারখানা থেকে কম করে হলেও ১০ লাখ লোক চাকরিচ্যুত হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের যেসব বড় বড় শিল্প গ্রুপ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে সেগুলোতে কম করে হলেও ৫ লাখ লোকের চাকরি গেছে। অন্যদিকে যারা এখনো ধুক ধুক করে চলছে, তাদের কেউ কেউ শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে অথবা বেতন-ভাতা ঠিকমতো না পেয়ে অনেকে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। কত প্রতিষ্ঠান যে রুগ্ণ হয়েছে কিংবা কত প্রতিষ্ঠান যে দেউলিয়া হয়েছে তার নির্ভুল পরিসংখ্যান নেই। তবে ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের যে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে, তা সমসাময়িককালে এশিয়ার অন্য কোনো দেশে নেই।
আওয়ামী জমানার শেষ দিকে কাগজকলমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল কমবেশি সোয়া লাখ কোটি টাকা, যা হয়তো প্রকৃতপক্ষে ছিল ২ লাখ কোটি টাকা। গত এক বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র ৩ লাখ কোটি টাকার ঋণ নতুন করে খেলাপি হয়েছে।
আমাদের দেশে দেউলিয়া আইনের উপস্থিতি না থাকায় এই ঋণ আদায় বা সমন্বয় বলতে গেলে অসম্ভব। এই বিশাল অঙ্ক যা কি না, আমদের এক বছরের জাতীয় বাজেটের প্রায় কাছাকাছি। অন্যদিকে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে মোট আমানতের কত অংশ এবং মোট বিনিয়োগের কত অংশ তা যদি বিনিয়োগকারীরা জানতেন এবং বর্তমান খেলাপি ঋণ কীভাবে সমন্বয় হবে তা যদি জানার চেষ্টা করতেন তবে সারা দেশে কী যে কান্নার রোল পড়ত তা ভাবলে আতঙ্কে সারা শরীর অবশ হয়ে যায়।
উপরিউক্ত দৈন্য থেকে কীভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায়- কীভাবে কত দিনের মধ্যে সংকট নিরসন সম্ভব এসব নিয়ে হর্তাকর্তা আমলা কামলা রাজনৈতিক পান্ডাদের কোনো আলোচনা আমাদের কানে আসেনি। উল্টো রাষ্ট্র, সরকার এবং রাজনীতির অত্যাচারের বিশাল বিশাল গদা যেভাবে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, বিরুদ্ধমতের লোকজনের মাথায় আঘাত করার জন্য চরকির মতো ঘুরছে, তাতে করে খুব তাড়াতাড়ি আরও ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান, চাকরিবাকরি রসাতলে যাবে এবং খেলাপি ঋণ বেড়ে কোথায় পৌঁছবে তা আসমানের মালিক ছাড়া কেউ জানে না। সর্বনাশের উল্লিখিত হালহকিকতের মধ্যেও কিছু মানুষের ঘেডির নড়াচড়া থামছে না। ঘেডিসংক্রান্ত জিদ-অহংকার বহু সম্ভাবনাকে কবরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আর অসহায় মানুষের আহাজারি আর্তচিৎকারকে পুঁজি করে কিছু মানুষের নুন্তি বেড়েই চলেছে। এ অবস্থার চাপে মাঝেমধ্যেই জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতার ছন্দে হারিয়ে যাই সুদূর অতীতে। কবির মতো কাব্য প্রতিভা না থাকার কারণে আমি নাটোরের বনলতা সেনের খোঁজ পাই না। আমার নির্বোধ মন-মস্তিষ্ক চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশার পরিবর্তে ABD=OBD সূত্রের কাব্যগাথা স্মরণ করেই খুশিতে লুটোপুটি খাই।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক