আগে রাজনৈতিক স্লোগান ছিল শিষ্টাচারের মধ্যে। স্লোগান সৃজনশীল, অর্থবহ ও শ্রুতিমধুর সংগীত ও কবিতার মতো ছিল। পাকিস্তান আমলে কৈশোরে আমরা সবচেয়ে গুরুতর স্লোগান দিয়েছি এবং অন্যদের মুখে উচ্চারিত হতে শুনেছি : ‘আইউব-মোনায়েম ভাই ভাই, এক রশিতে ফাঁসি চাই।’ ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো।’ স্বাধীনতার পর দেশে তখন অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি ছিল। বড় বড় কবির কবিতায় সন্ত্রাসের চিত্রের স্ফুরণ ঘটত। যেমন আল মাহমুদ তাঁর এক কবিতায় লিখেন : ‘আবার গুলির শব্দ -- বাঁচাও বাঁচাও,/বানাও শালাকে ছিঁড়ে ফেলো,/--- ট্যাট - ট্যাট - ট্যাট/খোল শালী চোরের চোদানী শাড়ি খোল।’ চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় কবি রফিক আজাদ লিখেন : ‘ভাত দে হারামজাদা/তা না হলে মানচিত্র খাব।’
পঁচাত্তরের পরিবর্তনের পর রাজনীতি যখন নতুন করে শুরু হলো তখন পাকিস্তানি আমলের স্লোগান পাল্টে নতুন স্লোগান যোগ হয়েছিল- ‘একটা একটা লীগ ধরো সকাল-বিকাল নাশতা করো।’ ওই সময় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ছাত্রলীগ ছিল বেকায়দায় এবং জাসদ ছাত্রলীগের দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। একে অন্যকে ধরে নাশতা করার স্লোগানই মুখ্য স্লোগান হিসেবে টিকে ছিল দীর্ঘকাল।
২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির। এই দীর্ঘ সময়ে তাদের প্রধান স্লোগান একটাই ছিল : ‘একটা একটা শিবির ধরো, ধইরা ধইরা জবাই করো।’ এটা যে কেবল তাদের রাজপথের স্লোগান ছিল না, বরং ছাত্রলীগ তা বাস্তবে রূপ দিয়েছিল তার ভয়াবহ প্রমাণ ২০১২ সালে পুরান ঢাকায় শিবির কর্মী ভেবে বিশ্বজিৎ দাস নামে এক হিন্দু যুবককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা এবং ২০১৯ সালে আবরাব ফাহাদ নামে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা। দেশের অনেক স্থানে একই ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ।
এরপর স্লোগানে যুক্ত হতে শুরু করেছিল অকথ্য, অশ্রাব্য শব্দ, গালিগালাজ। অল্প দিনেই গালিবিদ্যায় বাঙালি চৌকশ হয়ে ওঠে। পতিতালয়ে ব্যবহৃত গালিগালাজের ভাষা রিজিয়া রহমানের ‘রক্তের অক্ষর’সহ অনেক বাংলা উপন্যাস ও ছোটগল্পে পাওয়া যায়। সেসব অনার্য শব্দাবলি এখন শিক্ষিত এবং চেহারা-ছবিতে পোশাকপরিচ্ছদে ভদ্র-দর্শন কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীর মুখে অবলীলায় উচ্চারিত হচ্ছে। তাদের হাতে ধরা প্রতিবাদী ব্যানার-ফেস্টুনে শোভা পাচ্ছে গালি। ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় সড়ক অবরোধের সময় রাস্তাজুড়ে আলপনা আঁকার মতো লেখা স্লোগানের ভাষা গালিগালাজে ব্যবহৃত শব্দসম্ভারে নব সংযোজন ছিল। চ-বর্গীয় যাবতীয় গালি ফুলেফলে সুশোভিত হয়েছিল গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের সময়। ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ (?) খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রোকেয়া হলের সামনে সমবেত ছাত্রীদের মুখে, হ্যাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে শিক্ষার্থীদের মুখে ‘হাসিনা রে হাসিনা, তোরে আর “-দি” না’ ধরনের হৃদয়-বিখণ্ডকারী স্লোগানও দেশবাসীকে শুনতে হয়েছে। কোন লিঙ্গের ব্যক্তি কোন লিঙ্গের ব্যক্তির উদ্দেশে গালিবর্ষণ করছে, সেই ভেদাভেদও বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
জুলাই অভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ বর্তমানে অশ্লীল, অমার্জিত শব্দ রাজনৈতিক গালির অভিন্ন পরিভাষায় পরিণত হয়েছে। খোদ শিক্ষিত ছাত্রীরা তাদের নিজেদের শরীরের গোপনাঙ্গ সেøাগানে তুলে আনছেন। সেসব অঙ্গের নামোৎকীর্ণ ফেস্টুন বহন ও প্রদর্শন করছেন। তাদের স্লোগানে ‘শা-য়া’ শব্দটির ব্যবহার যেন কমন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘স্ত্রী বহির্জননাঙ্গ’ অথবা শুধুই ‘জননাঙ্গ’। তারা কি না জেনে না বুঝে এ শব্দ ব্যবহার করছেন? কেন শিক্ষার্থীরা অশালীন কথাবার্তাকে রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত করছেন। এসব কী স্বতঃস্ফূর্ত অথবা পরিকল্পিত?
গোপালগঞ্জে জুলাই আন্দোলনের সমন্বয়কদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার পর এ আন্দোলনের অন্যতম নেতা ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বিন হাদী, যিনি একসময় মাদরাসাছাত্র ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স করে কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত, তিনি তার এক জ্বালাময়ী বক্তৃতায় বলেন, ‘শা-য়া মাউয়া ছিররা ফালাইতে হবে খানকির পোলাগোর। বাংলাদেশে গোপালগঞ্জের অস্তিত্ব থাকবে না।’ এক টেলিভিশন টক শোতে শরীফ ওসমান হাদীর কাছে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এগুলো স্ল্যাং (গালি বা অপভাষা) নয়, মুক্তির মহাকাব্য। রাজপথের স্লোগানের একটি ভিন্ন জজবা আছে।’ গালিবাজরা তাদের অশ্লীল গালির অনুকূলে যে ব্যাখ্যাই দিন না কেন, গালিতে বাঙালির পারদর্শিতা ও দক্ষতার ইতিহাস অতি প্রাচীন। হালে তা উচ্চমার্গীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। বাংলা ভাষায় আমি গালির কোনো সংজ্ঞা না পেলেও অনেক ব্যাখ্যা পেয়েছি। ব্যাখ্যাগুলোও আমার কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি।
বাংলাদেশে অনেক বিজ্ঞজন মনে করেন, ‘সমাজ শিশু-কিশোর তৈরি করে না, গালিও তারা সৃষ্টি করে না! আমাদের কিশোররা ক্ষোভ প্রকাশে যেসব ভাষা ব্যবহার করছে এগুলো তাদের সৃষ্ট নয়! গালি সমাজ সৃষ্ট! আমাদের সমাজে গালির ভাষার সৃষ্টি হয়েছে নিপীড়নকারীর আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে এবং সমাজে প্রচলিত শব্দকে কেন্দ্র করে। মজলুমরা অশ্লীল শব্দ প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করে। আর মজলুমের ওপর জালেমরা অশ্লীল শব্দ আক্ষরিক অর্থেই প্রয়োগ করে।’ তাদের মতে, ‘ভাষার প্রতীকী প্রয়োগ যদি অন্যায় হয়ে থাকে নিপীড়নকারীর প্রায়োগিক ও ব্যবহারিক অশ্লীলতাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যাবে? জালেমের প্রতি গালির আকারে মনস্তাত্ত্বিক আঘাত হানতে পারলে সমাজ শুদ্ধ হবে, অশ্লীল গালিও দূর হবে। তারা বলেন, ‘পুলিশ কোন চ্যাটের বাল’ এই ভাষা মজলুমের, ক্ষমতাহীনের। এই ভাষার শ্লেষ সহ্য করার শক্তি ক্ষমতাবানের নেই। বিপ্লব কোনো মিলাদ মাহফিল নয়- এখানে লজ্জাশরম থাকতে নেই। বিপ্লবের ‘প্রথম রক্ত’ নির্গত হয় ভাষা দিয়ে। ছাত্রদের স্লোগানের ভাষা এক নতুন বিপ্লবের জন্ম দিচ্ছে। এই ভাষা সুন্দর, এই ভাষা শৈল্পিক, মোটেই অশ্লীল নয়।
আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনো কাউকে গালি দিই না। বন্ধুমহলে আলোচনায় অনেকে পুরুষ ও নারীদেহের প্রাইভেট পার্টস বা একান্ত অঙ্গের উল্লেখ করেন কারও ওপর ক্ষোভ ঝাড়তে। আমি সেগুলোও উচ্চারণ করি না। আমি শব্দসচেতন, অতএব আমার মুখ থেকে সেসব নির্গত হয়নি, হয় না এবং বাকি দিনগুলোতেও হবে না। আমি যা শুনি তা ধারণ করে রাখি এবং গালির ভাষা দিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিবর্তন উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। সমাজবিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে গবেষণা করতে পারেন। ভারতের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘গালি বন্ধ ঘর অভিযান’ অর্থাৎ বাড়িকে গালিমুক্ত করার অভিযানে ২০১৪ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ১১ বছরে ভারতের ৫ হাজার গ্রাম ও শহরে ৭০ হাজার লোকের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে গালির সূচক তৈরি করেছেন। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী ৫৫ শতাংশ ভারতীয় গালিগালাজ করতে অভ্যস্ত। সবচেয়ে বেশি গালি চর্চা হয় রাজধানী দিল্লিতে, প্রায় ৮০ শতাংশ। উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোর তুলনায় দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে গালি ব্যবহারের মাত্রাও কম। সবচেয়ে কম গালি প্রয়োগ করা হয় কাশ্মীর ও লাদাখে, মাত্র ১৫ শতাংশ।
গালিগালাজের ওপর সামান্য পড়াশোনা করে যা জানতে পারলাম, তাতে দেখা যায়, আর্যদের দেশ প্রাচীন পারস্য বা বর্তমান ইরানি সমাজে অশ্লীল কোনো গালি নেই। ইরানিরা কী রাগান্বিত হয় না? অবশ্যই হয়। আমাদের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করা হলে আমরা ভাবতেই পারি যে কাউকে গালি না দিয়ে ওদের দিন কাটে কীভাবে? ভালোই কাটে। ইরানিদের সবচেয়ে অশ্লীল গালি ‘গুম শো’ ইংরেজিতে যা প্রকাশ করা হয়, ‘GET LOST,’ এ ছাড়াও খারাপ গালি আছে ইরানিদের। যেমন : ‘পেদার সুকতে’ যার বাংলা অর্থ ‘তোর বাপ আগুনে পুড়ুক!’ এমনকি চূড়ান্ত ক্রোধ প্রকাশেও তারা এ ভাষা ব্যবহার করে! অভদ্র ভাষায় কথা বললে প্রতিপক্ষের মুখে বড় জোর বের হয়, ‘আপনি “বদজবান” বা আপনি “বাজে কথা” বলেন।’
বাঙালি জাতি ভিন্ন, সমাজ ভিন্ন। বাঙালি মিশ্র জাতি, বাঙালির ভাষা ততোধিক মিশ্র। বাঙালির গাত্রবর্ণের মা-বাপ নেই। থাকবে কীভাবে? কোনো জাতিগোষ্ঠীর শৌর্যের সঙ্গে প্রচুর বীর্যও এখানে প্রবাহিত হয়নি? যারা আসেনি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়লেই মনে হয়, আমাদের পূর্বপুরুষেরা কেবল নয়, পূর্বনারীরাও ডেকে ডেকে নানা জাতির লোকজনকে এখানে জড়ো করেছিলেন : ‘এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু-মুসলমান/এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খ্রিস্টান।’ এমন ডাক শুনে কে না আসবে? এবং আসবে তো পুরুষরা, নারীরা তো আর নদী-সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত, সীমাহীন মরু, শ্বাপদসংকুল বনজঙ্গল পেরিয়ে আসবে না। অতএব রবিঠাকুরের আহ্বানে ‘দ্রাবিড় চীন, শক-হুন-পাঠান-মোগল’ ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীর ভদ্র-অভদ্র, উচ্চ-নীচ লোক যার পক্ষে দুনিয়ার যেখান থেকে সম্ভব দৌড়ে এসে যা যা করার তা করেছে। এমন মিশ্র বাঙালি জাতির গালির ভান্ডার সমৃদ্ধ হলে কাকে দোষ দেওয়া যাবে? কিন্তু আমাদের আশপাশের অনেক ভাষায় গালির সংজ্ঞা আছে। সেসব ভাষায় গালি শিল্পমানে উন্নত, সাহিত্য মানে উত্তীর্ণ এবং গালির প্রয়োগ মনে প্রশান্তির প্রলেপ দানকারী মনে হয়েছে।
হিন্দি ভাষায় গালির সংজ্ঞা : ‘অত্যধিক ক্রোধ আনে পর শারীরিক রূপ সে হিনসা না করতে হুয়ে শাব্দিক রূপ সে কারওয়াই করণে কে লিয়ে চুনিন্দা শব্দ কে উচ্চারণ কে বাদ মন কো অসীম শান্তি মিলতে হ্যায়, উসে গালি কেহতে হ্যায়।’
এর বাংলা অর্থ হচ্ছে : ‘প্রচণ্ড রাগান্বিত হলে শারীরিকভাবে সহিংস আচরণ করার পরিবর্তে শব্দ দ্বারা রাগ প্রশমিত করার জন্য বাছাই করা শব্দ উচ্চারণের পর মনে সীমাহীন আনন্দবোধ করাকে গালি বলা হয়।’
উর্দু ভাষায় গালির সংজ্ঞা আরও মার্জিত, যেমন : ‘ইন্তেহায়ি গুসসে কি হালাত মে জিসমানি তউর পর তাশাদ্দুদ কি বাজায়ে জবানি তউর সে কি জানে ওয়ালি লফজি কারওয়াই কে লিয়ে মুন্তাখিব আলফাজ-এ গালিজা, আন্দাজ-এ-বাসিতা, লেহজা-এ-কোরিহা আউর আসরাত-এ-সাফিহা কে মজম্মু ইস্তেমাল কে বাদ ইতমিনান আউর সুকুন কি না কাবিল-এ-বায়ান কাইফিয়াত সে দিল বেহরাওয়ার হো জাতা হ্যায় উসে গালি কাহা জাতা হ্যায়।’
এই সংজ্ঞাকে বাংলা অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় : ‘রাগ চরম সীমায় পৌঁছে গেলে শারীরিকভাবে সহিংস আচরণের পরিবর্তে মৌখিকভাবে কটূক্তি করার জন্য সহজসরলভাবে, সুনির্দিষ্ট অর্থবহ ও সুদীর্ঘ প্রভাব সৃষ্টিকারী সংগৃহীত শব্দাবলি প্রয়োগ করার মধ্য দিয়ে বর্ণনাতীত আনন্দ ও পরিতৃপ্তি লাভ এবং হৃদয়-মন প্রশান্তিতে ভরে গেলে সেটিকে গালি বলা হয়।’
আমাদের প্রতিবেশী দেশের উত্তর প্রদেশের ঐতিহাসিক শহর এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র লখনউ-এর লোকজন তাদের পরিশীলিত ভাষা এবং মার্জিত ও বিনয়ী আচরণের জন্য খ্যাত। সেখানে কেউ রেগে কাউকে গালি দিলেও প্রতি উত্তরে গালির শিকার ব্যক্তি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে সাড়া দেন : ‘আপ বাখওয়াজ ফরমা রাহে হ্যায়!’ অর্থাৎ ‘আপনি খুব নিম্নমানের কথা বা বাজে কথা বলছেন।’ ওই শহরে উপমহাদেশে তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত ‘তুই, তোকারি’ নেই। অবোধ শিশুকেও সম্বোধন করা হয় ‘আপ’ (আপনি) বলে।
লখনউ-এর গালিগালাজও গালির মতো মনে হয় না। সেখানে কেউ ক্রুদ্ধ হলেও ক্রোধের প্রকাশ উচ্চমানের সাহিত্যচর্চার মতো হয়। যেমন কেউ যদি কাউকে গালি দিয়েও ফেলে, সে ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ সাড়া দেয় : ‘দেখিয়ে মুহতারাম, আগার আপনে হামারে শায়ানে শান মে এক ভি নাজেবাহ খেয়াল পেশ কিয়া তো হাম আপকি আম্মিজান কি শান মে গুস্তাখি কর কে আপকে জজবাত কো মজরুহ কর দেঙ্গে।’
অর্থাৎ ‘দেখুন মাননীয়, আপনি যদি আমার সম্মানের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে আর একটি উচ্চ ধারণা পোষণকারী শব্দ উচ্চারণ করেন, তাহলে আমি আপনার শ্রদ্ধেয় মায়ের মর্যাদার প্রতি বেয়াদবি করে আপনার আবেগ-অনুভূতির ওপর আঘাত করব।’ কেউ যদি গালির পরিবর্তে গালি না দিয়ে এমন চমৎকার শালীন, মার্জিত শব্দের প্রয়োগ করে, তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের পক্ষ থেকে যদি ‘মুকাররার! মুকাররার!’ অর্থাৎ ‘বলুন, আরেকবার বলুন!’ ধ্বনি উঠে তাতে অবাক হওয়া কিছু থাকবে না। উত্তর প্রদেশের অনেক স্থানে হিন্দিতে যদি বলা হয় : ‘এক চাটে (চাড্ডে) মে তারে দিখা দুঙ্গা,’ অর্থাৎ ‘এক থাপ্পড়ে আসমানের তারা দেখিয়ে দেব।’
এই কথাটিই লখনউ-এর বিনয়ী উর্দুতে বলা হবে : ‘জনাব, আপ আগার আয়েন্দা ইয়ে হিমাকত কি তো হামারা আপকে রুখসার কো ইস কদর সুরখ কর দেগা কি আপকো আফতাব কি মওজুদগি মে সিতারো কা দিদার হো জায়েগা। লেহাজা হদ মে রাহে।’ এর বাংলা অর্থ দাঁড়াবে : ‘মহোদয়, আপনি যদি ভবিষ্যতে এমন বোকামির কাজ করেন, তাহলে আমি আপনার সুন্দর মুখকে এমন লাল করে দেব যে আপনি চাঁদের আলোতেও তারা দেখতে পাবেন। অতএব আপনি সীমার মধ্যে থাকুন।’ অনেক চ্যাংড়া পোলাপান তাদের ক্ষমতাবান বাপের নাম ভাঙিয়ে অন্যকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে, ‘তুই জানিস, আমার বাপ কে?’ উর্দু ভাষায় এ কথাকেই কাব্যিক ঢংয়ে বলা হয় : ‘তোমহারা ইলম হ্যায় কে মেরা ওয়ালিদ সাব কো?’ অর্থাৎ ‘আমার পিতৃ মহোদয়ের ব্যাপারে তোমার কি কোনো ধারণা আছে?’
ইংরেজি ভাষায় গালির সংজ্ঞা মোটামুটি এমন : ‘গালি একধরনের স্পর্শকাতর মৌখিক অপব্যবহার। কেউ যখন প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে ঘায়েল করতে, তার ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে, উপহাস করতে, নীচু দেখাতে এবং অপমানিত করার উদ্দেশ্যে দৈহিক শক্তি প্রয়োগের পরিবর্তে সমাজে অপ্রচলিত ও আপত্তিকর শব্দ সহযোগে আক্রমণ না করে ভাষা দিয়ে আক্রমণ করে সেটি গালি হিসেবে বিবেচিত হয়।’ পাশ্চাত্যে গালিগালাজের ভান্ডার তেমন সমৃদ্ধ নয় বলেই মনে হয়। অথবা পাশ্চাত্যে ইতর ধরনের কারও সঙ্গে আমার ওঠাবসা হয়নি বলে সব গালি সম্পর্কে জানি না। তবে পথে-যানবাহনে চলাফেরায় কিছু কমন গালি কানে এসেছে : ‘অ্যাসহোল,’ ‘মাদার ফাকার,’ ‘পিস অফ শিট,’ ‘ফাকিং ইডিয়ট,’ ‘ফাকিং বিচ,’ ‘কান্ট,’ ‘বাস্টার্ড’ ইত্যাদি।
নানা ধরনের মানুষ নিয়েই সমাজ। প্রত্যেক্যের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। প্রত্যেকের মাঝে রাগবিরাগ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। শারীরিক সহিংসতার পরিবর্তে গালি দিয়ে যদি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এড়ানো যায়, তাহলে গালিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কিন্তু গালির ভাষা কীভাবে সৃজনশীল ও মাধুর্যপূর্ণ করা যায়, সমাজবিদরা তা ভেবে দেখতে পারেন।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক