এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, মানবাধিকার কমিশনের ১৫ বছরের যাত্রায় একাধিক চেয়ারম্যান এলেও কমিশন কার্যকরভাবে দাঁড়াতে পারেনি। বরং অনেক সময় এটি পরিণত হয়েছে ‘নখদন্তহীন’ প্রতিষ্ঠানে। ভবিষ্যৎ কমিশনের নেতৃত্বে মেরুদণ্ডহীন ‘ভালো মানুষ’ বসানো যাবে না। দরকার এমন নেতৃত্ব, যারা নীতিবান, সৎ এবং সাহসের সঙ্গে ক্ষমতার অন্যায় কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবেন।
গতকাল রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে আয়োজিত নাগরিক সংলাপ তিনি এসব কথা বলেন। ‘খসড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ ২০২৫’ শীর্ষক এ সংলাপের আয়োজন করে বাংলাদেশ রিফর্ম ওয়াচ। সহযোগিতায় ছিল এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ। অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, যে প্রতিষ্ঠান মানুষের মানবাধিকার সংরক্ষণ করতে পারে না, এমন একটি নখদন্তহীন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দেখতে চাই না। বিগত সময়ে বাংলাদেশ নখদন্তহীন ও মেরুদণ্ডহীন মানবাধিকার কমিশন পেয়েছে। এবার যেন সেই ভুল আর না হয়।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এ আইনের খসড়া তৈরি হয়। পরবর্তীতে সেই আইনের ভিত্তিতেই কমিশন গঠিত হয় এবং একাধিক চেয়ারম্যান নিয়োগ পান। তবে ২০২৪ সালের ৭ নভেম্বর অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার কমিশনটি বাতিল করে দেয়। এর ফলে প্রায় এক বছর ধরে দেশে মানবাধিকার কমিশন নেই, যদিও এ সময়ে অন্যান্য কমিশন গঠন করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এক বছরের বেশি সময়েও মানবাধিকার ও তথ্য কমিশন গঠন না হওয়া সরকারের জন্য লজ্জাজনক। কেউ বলবে সদিচ্ছা, সৎ সাহসের অভাব ছিল। আবার কেউ বলবে এখানে কোনো কিছু লুকানো হচ্ছে বা সরকারের পেছনের শক্তি, সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি যারা চাচ্ছেন না, তারা করতে দেয়নি, ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এর সঠিক জবাব সরকারকে দিতে হবে।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সভাপতি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ২০০৯ সালের মানবাধিকার কমিশন আইনের কার্যকারিতা নেই। নতুন খসড়ায় উন্নতি হলেও বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। বিশেষত অনুসন্ধান ও তদন্ত শব্দের সংজ্ঞা নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞাও অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরিন পারভীন হক বলেন, নারী কমিশনের রিপোর্ট বিদেশে আগ্রহ কুড়ালেও দেশে তা কার্যকরভাবে ছড়ানো হয়নি। এ কমিশনের আদৌ কিছু হবে কি না সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান। আমরা আশা করেছিলাম এটা একটি ঐতিহাসিক সুযোগ অন্তর্বর্তী সরকারের। কিন্তু সেটা হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, কমিশনের কার্যক্রমে বাস্তবতা ও আন্তর্জাতিক মানের মধ্যে ফারাক রয়েছে। তাই আমাদের প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত করা জরুরি, আর ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা বোঝা প্রয়োজন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, মানবাধিকার কমিশন বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম বা পুলিশি নির্যাতনের মতো গুরুতর বিষয়ে অনেক সময় কিছুই করেনি। এতে ভিক্টিমরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। নতুন আইন প্রণয়নে এ অভিজ্ঞতা মাথায় রাখা জরুরি। ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, মানবাধিকার কমিশনে নখদন্তহীন কাউকে রাখা যাবে না। আগের কমিশনে আমলাদের বসানো ছিল প্যারিস চুক্তির লঙ্ঘন। সেটি পুনরাবৃত্তি হলে কার্যকারিতা নষ্ট হবে।
চাকমা সার্কেলের প্রধান রানী ইয়ান ইয়ান বলেন, কমিশনকে স্বাধীন, স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে, যাতে নারী, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ও আদিবাসীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। অভিযোগগুলো নিরাপত্তা বাহিনীসহ সব সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্তযোগ্য হওয়া উচিত।
সেন্টার ফর সার্ভিসেস অ্যান্ড ইনফরমেশন অন ডিসঅ্যাবিলিটির (সিএসআইডি) নির্বাহী পরিচালক খন্দকার জহুরুল আলম বলেন, ‘বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন’ শব্দটি অপমানজনক। আইনে নির্ধারিতভাবেই ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তি’ বলা উচিত। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।