স্ত্রী জেমিকে (১৯) বালিশচাপা দিয়ে হত্যার পর স্বামী রাকিব হাসান জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীকে মেরে ফেলেছি। আমি ঘরে আছি, আত্মসমর্পণ করব। আপনারা আমাকে নিয়ে যান।’ ৮ আগস্ট রাত ৮টার দিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাশিমপুর থানাধীন ২ নম্বর ওয়ার্ডের চক্রবর্তী এলাকার ঘটনা এটি।
১৯ এপ্রিল, কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্ত্রী মৌসুমী আক্তাকে (২৯) গলা টিপে হত্যা করে স্বামী বাছির উদ্দিন (৩৫) নিজেই থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। বিপরীত ঘটনাও আছে। গত ১৮ জুন সিলেটের গোলাপগঞ্জে আনু মিয়ার (৩৫) বিরুদ্ধে স্ত্রী সাবিনা বেগমকে (৩০) হত্যা করে লাশ পুকুরে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ৮ এপ্রিল আরেক ঘটনায়, পারিবারিক কলহের একপর্যায়ে ইয়াছিন আলী নামের এক ব্যক্তি স্ত্রী লামিয়া আক্তার (২৩), সন্তান আবদুল্লাহ রাফসানকে (৪) শ্বাসরোধ ও স্ত্রীর বড় বোন স্বপ্নাকে গলা কেটে হত্যা করে লাশ তিনটি বস্তাবন্দি করে মাটিচাপা দেন। ঘটনাটি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার। দেশের সর্বত্রই স্বামী-স্বজনদের হাতে এমনি ধরনের মর্মান্তিক নৃশংস ঘটনা, বলা যায় প্রতিদিনই ঘটছে। ঘরের ভিতরের এই সহিংসতা শুধু ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ট্র্যাজেডি বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ ধরনের ঘটনাবলি বরং সামাজিক ও পারিবারিক অস্থিরতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এ বছর দেশে পারিবারিক নারী নির্যাতনের উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯/৯৯৯, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, সরকারি জরিপসহ একাধিক সূত্রে। আসকের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৩৬৩টি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৩২২ জনের। এর মধ্যে ২০৮ জন নারী ও শিশু। আত্মহত্যা করেছেন ১১৪ জন। আসকের তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি হত্যার ঘটনা ঘটেছে স্বামীর হাতে স্ত্রীর। স্বামীর হাতে নিহত হয়েছেন ১৩৩ জন নারী। স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন ৪২ জন। আর ৩৩ জন হত্যার শিকার হয়েছেন নিজ পরিবারের সদস্যদের হাতে। অন্যদিকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় নারী সুরক্ষা হেল্পলাইন ‘১০৯’-এর তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার নারীর জন্য সহায়তা চেয়ে কল এসেছে ৪৮ হাজার ৭৪৫টি। জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এর তথ্য অনুসারে, গত জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত নারী নির্যাতনের ঘটনায় ১৭ হাজার ৩৪১টি কল আসে। এর মধ্যে পারিবারিক নির্যাতনের অভিযোগে কল আসে ৯ হাজার ৭৪৬টি। এসব কলের মধ্যে শুধু স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ ৯ হাজার ৩৯৪টি।
একটু পেছনে ফিরলেই দেখতে পাব ২০২৪ সালের জানুয়ারি-জুন পর্যায়ের তুলনামূলক চিত্র। সেই সময়ে আসকের প্রকাশিত পরিসংখ্যানে পারিবারিক সহিংসতার ২৬৯টি ঘটনার রেকর্ড রয়েছে। এর মধ্যে স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ৮৪ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৯৪ জন। দেশের অন্যতম প্রাচীন নারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের মাসওয়ারি (জুলাই ২০২৫) নির্যাতন-চিত্র দেখায়, মাসজুড়ে নারী ও কিশোরীর ওপর সহিংসতার অভিযোগের সংখ্যা কয়েক শতে পৌঁছেছে। জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশে বিভিন্ন রকম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৫৫৫ জন নারী ও কন্যাশিশু। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২২ জন নারী। আর হত্যা করা হয়েছে ৩২০ জন নারীকে।
বিশ্বাস করতে মন না চাইলেও বাস্তবতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে দেশে বা বিদেশে নারীরা কোথাও নিরাপদ নয়। নারীদের জন্য নিশ্চিন্তের নিরাপদ আবাস হওয়ার কথা ছিল নিজ বাড়ি। সেই আবাস আজ সবচেয়ে অনিরাপদ হয়ে গেছে। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারী ও মেয়েদের জন্য বাড়ি সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ও স্বজনদের হাতে বিশ্বে প্রতিদিন গড়ে ১৪০ জন নারী খুন হয়েছেন।
বিশ্বজুড়ে ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৮ হাজার ৮০০। বলা হয়েছে, বিশ্বের সব অঞ্চলেই নারীদের ওপর এমন সহিংস ঘটনা ঘটছে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে- নারী তাহলে দাঁড়াবে কোথায়?
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী