বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় মুখ পপি। যিনি নব্বইয়ের দশকে রুপালি পর্দায় যাত্রা শুরু করে নিজের সপ্রতিভ অভিনয়, সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্ব দিয়ে জয় করে নিয়েছেন অগণিত দর্শকের মন। তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী এই অভিনেত্রী শুধু নায়িকা নন, বরং নিজেকে প্রমাণ করেছেন একজন পরিপূর্ণ শিল্পী হিসেবে। দীর্ঘ বিরতির পর আজও তাঁকে ঘিরে কৌতূহল আর আগ্রহের শেষ নেই। গতকাল তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে সংসার জীবন, স্বামী-সন্তান, চলচ্চিত্র, ব্যক্তিজীবন নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন। এই বিশেষ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন- পান্থ আফজাল
কেমন আছেন?
আছি ভালো। আলহামদুলিল্লাহ! বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসায় অনেক ভালো আছি। যারা আমাকে সর্বদা ভালোবাসতেন, মিডিয়ায় সাপোর্ট করতেন, শুভাকাক্সক্ষীর মতো পাশে থেকেছেন- সবার দোয়ায় সুন্দর সময় কাটছে এখন। সত্যি কথা বলতে কি, আমি তো মরেই গিয়েছিলাম। বলতে গেলে, সেখান থেকে পুনর্জীবন পেয়েছি। বেঁচে থাকার মতো অক্সিজেন পেয়েছি। নতুনভাবে জীবন শুরু করেছি। আলহামদুলিল্লাহ, স্বামী-সন্তান নিয়ে অনেক ভালো আছি।
সন্তানের নাম কি? শান্ত না দুষ্টু? স্বামী-সন্তান নিয়ে ঘোরাঘুরি কেমন চলছে?
ওর নাম আয়াত। বয়স মাত্র ৪ বছর এখন। ও শুধু শান্ত না, অনেক দায়িত্বশীল। বাবার মতো আমাকে আগলে রাখে। মাথায়, পায়ে তেল দিয়ে দেয়। এতটুকু বেবি যে আমাকে এতখানি টেক কেয়ার করে, সেটা অবাক করার মতো। সর্বদা ভরসা দিয়ে সে বলে, ‘আম্মু আমি তো আছি। কেউ লাগবে না।’ তখন আমি মা-ভাই-বোনের কাছে থেকে পাওয়া সব কষ্ট ভুলে যাই। ৩০ বছর যাদের (ভাই-বোন) কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছি, এত কষ্ট করেছি। তারা কখনো আমার গলা জড়িয়ে ধরে ভরসা দিয়ে বলে নাই, ‘আমি আছি তোমার সঙ্গে।’ যেই ভরসাটা এখন আমি আমার সন্তানের কাছ থেকে এখন পাই। সবই মহান আল্লাহর নেয়ামত। বাচ্চা না হলে বুঝতেই পারতাম না, জীবন কতটা সুন্দর। আর হ্যাঁ, স্বামী-সস্তান নিয়ে ঘোরাঘুরি করি। ঘুরতে খুবই পছন্দ করি। কিছুদিন আগে ব্যাংককে গিয়েছিলাম। ১০-১৫ দিন ছিলাম। সামনেও ঘুরতে যাব।
পুরোদস্তুর সংসারী হবেন, কখনো কি ভেবেছিলেন?
কখনো কল্পনাও করতে পারিনি সংসার জীবন শুরু করব। এমন একজন মানুষ পাব- যে আমাকে আগলে রাখবে, পথ দেখাবে, পাশে থাকবে ছায়ার মতো। সামনে দাঁড়িয়ে পথ দেখানোর মতো একজন লোক পেয়েছি। আমাকে যখন আমার পরিবারের সবাই মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিল, সে সময় আমার এই ভালোবাসার মানুষ আমাকে ভরসা দিয়ে জীবন বাঁচাইছে। সুন্দর একটি জীবন দিয়েছে। আর কখনো ভাবিনি আমার জীবনে এমন সুন্দর একটি ফুটফুটে বেবি আসবে। আমি সত্যিই সৌভাগ্যবতী। সারা জীবন যেখানে আমি পরের ঘর সাজাইছি, পরের সন্তানের স্কুলের বেতন দিয়েছি, অন্যের আহার, চিকিৎসার বিল দিয়েছি, নিজে না খেয়ে সবকিছু উজাড় করে দিয়েছি। বিনিময়ে কী পেয়েছি? অপবাদ, প্রতারণা আর লাঞ্ছনা। আমি ভালোবাসার কাঙাল। কিন্তু ভালোবাসা কি পেয়েছি নিজের পরিবারের কাছ থেকে? সবার কাছে দোয়া চাই, যেন স্বামী-সন্তান নিয়ে ভালো থাকতে পারি। আমার স্বামী হাজি মানুষ। হজ করে এসেছেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। নিয়ত আছে আমিও সামনে হজ করতে যাব।
মা-বোনের সঙ্গে পারিবারিক সমস্যার কি সমাধান হয়নি?
না, সমস্যার সমাধান এখনো হয়নি। যদিও আমি কখনো বলি নাই, সে আমার সৎমা; আজ বলছি। আমার এই সৎমা, আমার ভাই, আমার ৩ নম্বর বোন খেয়ালী ও আমাদের বাসায় একসময় ভাড়া থাকত (জায়গির মাস্টার) যে এখন ব্যাংক কর্মকর্তা-সবাই একসঙ্গে পরিকল্পনা করে আমার কষ্টার্জিত টাকায় কেনা জমি দখল করেছে। এ জমি কিন্তু আমি আমার বাবার কাছ থেকে বা অন্যের কাছ থেকে দান পাই নাই। নিজের ঘামের টাকা দিয়ে সাফ কবালা রেজিস্ট্রি করে বাবা ও চাচার কাছ থেকে কিনেছি। সেইখানে আমি এখন যেতেও পারি না। সৎমা-ভাই-বোন মিলে ভোগদখল করে আছে। আমি সেখানে গেলে তাদের লোকজন, সাংবাদিকদের দিয়ে মব সৃষ্টি করছে। যেখানে দলিল-রেকর্ড সবই আমার। কেউ তো আমাকে কিছুই দেয়নি সারা জীবনে। উল্টো খারাপভাবে তারা আমাকে দেশের মানুষের কাছে উপস্থাপন করছে। মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে। আমার হক আমাকে দেয়নি। নিজের হক চাওয়া-পাওয়া কি আমার অপরাধ? আমি সবাইকে অনুরোধ করব, কেউ যেন আমাকে ছোট না করে। আমাকে নিয়ে মিথ্যা কথা না লেখে। আমি সারা জীবন সম্মানের পেছনের ঘুরেছি। বাবা, মা, ভাই-বোনের পেছনে সারা জীবন সব উজাড় করে দিয়েছি। কিন্তু তারা কেউ কোনো দিনও আমাকে সাপোর্ট দেয়নি। আমার আয়ের পুরোটাই তারা নিয়েছে। তার পরও তারা আমাকে অপবাদ দিয়ে, বাজে কথা বলে আমার সম্মানহানি করছে। এটা কি ঠিক? ফিল্ম করে বা মিডিয়া থেকে যত টাকা ইনকাম করেছি, সব মা-বাবাকে দিয়েছি। নিজের ভবিষ্যতের কথা কখনো চিন্তা করি নাই। তারা আমার সব টাকা আত্মসাৎ করেছে। অন্য নায়িকাদের মা-বাবাকে দেখি মেয়ের জন্য বাড়ি-গাড়ি কত কিছু করে। কিন্তু আমার কী ভাগ্য, আমার সব টাকা আত্মসাৎ করে একটি বাড়ি পর্যন্ত করেনি। সব টাকা নিজেদের ভোগবিলাসিতার পেছনে ব্যয় করেছে। এত কিছুর পরও আমি মরিনি। ফিল্ম-মিডিয়ার মানুষ ও শুভাকাক্সক্ষীদের কারণে এখনো বেঁচে আছি। অনেকবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি। সবার ভালোবাসা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
আপনার পরিবার অপবাদ দিয়ে বলেছে, কাউকে না জানিয়ে আপনি নাকি গোপনে বিয়ে করেছেন...
তারা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমাকে সবার কাছে ছোট করেছে। জীবনে কখনো প্রেম করি নাই। কোনো হিরোর সঙ্গেও কোনো প্রেম ছিল না। সত্য কতটুকু, সেটা আমিই জানি। সারাজীবন পরিবারের পেছনেই সবটুকু ব্যয় করেছি। আমার সৎমা ওনার বিলাসিতার জন্য আমাকে নায়িকা বানিয়েছিলেন। পৃথিবীতে এমন কোনো মা আছে কি না আমার জানা নেই যে তার মেয়ের বিয়ে আসলে ভেঙে দিত। কারণ আমার বিয়ে হয়ে গেলে ওনাদের সহজভাবে টাকা জোগাড়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। আমার মা আমাকে তাবিজ-কবজও করত। যেন বিয়ে না হয় আমার। আর যখন বিয়ে করলাম অফিশিয়ালি, তখন আমার বিয়ে সে মানতে পারেনি। নানারকম অপবাদ দেওয়া শুরু করল। বলল, আমার সন্তান নাকি নাজায়েজ। এগুলোর প্রমাণ কি সে দিতে পারবে? জানি পারবে না। ২০০৪ থেকে আমার ও আদনানের পরিচয়। আমাদের বাসায় যাওয়া-আসা চলত। এরপর সম্পর্কের পরিণতি পায় ২০১১ সালের নভেম্বরে, আমার বিয়ে হয় বাবা-আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের উপস্থিতিতে। আর বাচ্চা হয় ২০২২ সালের ২ তারিখে। হয়তোবা আমি মিডিয়ার মানুষজনকে জানাতে পারিনি। তাই বলে গোপনে কীভাবে বিয়ে করলাম? সব বাজে কথা রটিয়ে আমাকে ছোট করতে চেয়েছে তারা। কী দুর্ভাগ্য আমার, যেই বাবাকে তারা (মা, ভাই-বোন) মারধর করত, সেই বাবাই কিন্তু আমার ইনকামের সব টাকা তাদের কাছে জমা দিত। কিন্তু আমি সেই বাবাকেই ছয় বছর ধরে আমার কাছে রেখে চিকিৎসা করিয়েছি। দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা ব্যয় করে তার ট্রিটমেন্ট করিয়েছি। হসপিটাল বিল দিয়েছি। অথচ সবাই আমাকে ঠকিয়েছে। আমাকে কখনো ভালো থাকতে দেয়নি; এখনো না।
জায়েদের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলেও রটিয়েছে...
সবই মিথ্যা। তার সঙ্গে কাজের প্রয়োজনেই সম্পর্ক। তার সঙ্গে কখনোই প্রেম কিংবা বিয়ে হয়নি। জায়েদ কেন, কোনো হিরোর সঙ্গে কখনোই প্রেম ছিল না। বিয়ে তো দূরের কথা। প্রেম-বিয়ে করার সময় পাইনি। টার্গেট ছিল কাজ।
অন্য প্রসঙ্গে আসি, ফিল্মে ফিরবেন কি?
ভবিষ্যতের কথা বলতে পারি না। আপাতত ইচ্ছা নেই। আমি এখন সংসার নিয়েই ব্যস্ত। সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করতে চাই। মৃত্যু পর্যন্ত সংসার যেন করতে পারি, সেই দোয়া চাই। আসলে আমি যখন যেই কাজ করেছি ১০০ পার্সেন্ট ইফোর্ট দিয়ে করেছি। পড়াশোনা যখন করেছি, সর্বোচ্চ দিয়ে করেছি। ফিল্ম যখন করেছি, তখনো করেছি। অনেকে বাজে কথা বললেও আমি কিন্তু রাষ্ট্র থেকে তিনবার সর্বোচ্চ সম্মাননা পেয়েছি।
কিছু ফিল্মের শুটিং করেছেন, সেগুলো আসবে কবে?
সাদেক সিদ্দিকীর ‘সাহসী যোদ্ধা’ (ডাইরেক্ট অ্যাকশন), রাজু আলীমের ‘ভালোবাসার প্রজাপতি’, আর ‘কাঠগড়ায় শরৎচন্দ্র’ তো অনেক আগেই করেছি। সেগুলো সামনে আসবে কি না জানা নাই।
ফিল্মের অফার তো পাচ্ছেন?
ফিল্মের কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই। সংসার নিয়েই এখন সব ব্যস্ততা।
ভবিষ্যতে পপিকে কীভাবে পাবে দর্শক?
ইচ্ছা রয়েছে আমার জীবনী নিয়ে কোনো কাজে প্রযোজনা করব। দেখা যাক।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নেই...
হুমম... আমি সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ডি-অ্যাকটিভ করেছি। এসব ভালো লাগে না।
ভক্তদের জন্য কি কিছু বলতে চান?
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বলব, আমি প্রতিটি মানুষের জন্য বাঁচতে চাই। আর কেউ যেন আমার মতো ভুল না করে। নিজের সর্বস্ব দিয়ে কাউকে (পরিবারকে) ভালোবাসা, শেষ করা উচিত নয়; যদি সে আপনার ভরসা বা অবলম্বন না হয়।