খাদ্য। মানবজীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। খাবার ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনা করাও কষ্টকর। সুস্থ ও নিরাপদ জীবনযাপনের জন্য উত্তম ও পরিমিত খাবারদাবারের বিকল্প নেই। খাবারে সংকট দেখা দিলে, খাদ্যাভ্যাসে এলোমেলো অবস্থা তৈরি হলে আমাদের যাপিত জীবনে নানাবিধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। কোনো কিছুতেই মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। মানবজীবনের মৌলিক অপরিহার্য এই দিকটিতে স্বভাবধর্ম ইসলামের রয়েছে অসাধারণ কার্যকরী নির্দেশনা। সুস্থ দেহ ও প্রাণ নিয়ে তৈরি হয় পূর্ণাঙ্গ মানুষ। তাই সুন্দর ও সুস্থ জীবনের জন্য প্রয়োজন দেহ ও প্রাণের উপযুক্ত খাবার। আত্মার পরিচর্যার মাধ্যমে যেমন সুস্থ মন-মস্তিষ্ক গড়ে ওঠে, তেমনি পর্যাপ্ত খাবারের মাধ্যমে দেহ হয়ে ওঠে সজীব ও সবল। আল্লাহর বিধিনিষেধ লঙ্ঘনের মাধ্যমে মানুষের অন্তরে দানা বাঁধে দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, হিংসা, ভয়, লোভলালসা ছাড়াও আত্মার অন্যান্য রোগব্যাধি। তাই ইসলামে রুগ্ণ আত্মার যেমন প্রতিষেধক আছে, তেমনি সুস্থ ও সুন্দর জীবনের জন্য আছে খাবারের সুশৃঙ্খল নীতিমালা। মানুষের জীবন গঠনে খাবারের ভূমিকা খুবই স্পষ্ট। আর আত্মা ও দেহ রুগ্ণ হয়ে উঠলে মানুষ হারিয়ে ফেলে নিজের আসল পরিচয়। জীবন হয়ে ওঠে মরীচিকাময়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হবে তার জীবন হবে সংকীর্ণ ও অস্থির, আমি তাকে কিয়ামতের দিন অন্ধ করে পুনরুত্থিত করব।’ (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ১২৪)
ইসলামপূর্ব যুগে মরুবেষ্টিত মক্কায় নিরাপদে খাদ্য আমদানি আল্লাহর বিশেষ রহমতস্বরূপ ছিল। আর মানবজীবনে খাদ্য ও ভৌগোলিক নিরাপত্তার গুরুত্ব অপরিসীম। এই গুরুত্বের দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতএব তারা যেন এই গৃহের মালিকের ইবাদত করে, যিনি তাদের ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং ভীতি থেকে তাদের নিরাপদ করেছেন।’ (সুরা : কুরাইশ, আয়াত : ৪)
পৃথিবীতে মানব বসতি গড়ে ওঠার পর থেকে খাদ্যের চাহিদা পূরণের চেষ্টা চলছে। তাই যে কোনো স্থানে বসবাসের উপযুক্ততা নির্ভর করে খাদ্যের পর্যাপ্ততার ওপর। আর উন্নত নগর-রাষ্ট্রে বিলাসী জীবন অসার হয়ে পড়ে খাদ্যনিরাপত্তার অভাবে। প্রাচীনকাল থেকে খাদ্যের অভাব পূরণে গড়ে ওঠে কৃষিব্যবস্থা। আর চাষাবাদের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে মজবুত অর্থনীতি। চাষাবাদের মাধ্যমে খাদ্যের অভাবের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ইসলামে। রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোনো মুসলিম গাছ রোপণ করলে বা চাষাবাদ করলে, তা থেকে কোনো মানুষ বা জীবজন্তু আহার করলে তার জন্য এটি সদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৫৫২)
মানবসভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিব্যবস্থারও উন্নতি ঘটে। খাদ্যের মানোন্নয়ন, উৎপাদন, সরবরাহ বৃদ্ধি ও সার্বিক নিরাপত্তায় নিত্যনতুন কাজ করা অতীব জরুরি। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য ভূপৃষ্ঠকে অধীন করেছেন, অতএব তোমরা এর ওপর চলাচল কর এবং তাঁর প্রদত্ত রিজিক গ্রহণ করো, তাঁর কাছেই তোমাদের ফিরে যেতে হবে।’ (সুরা : মুলক, আয়াত : ১৫)
খাবারসহ যে কোনো বস্তু ব্যবহারে অপচয় পরিহার অপরিহার্য। অপচয়ের মাধ্যমে জীবনে নেমে আসে অধঃপতন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা খাও এবং পান কর, অপচয় কর না, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩০)
ইবনে আব্বাস (রা.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা খাদ্য গ্রহণ হালাল করেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তা অপচয় বা অহংকারবশত না হবে।’ (তাফসিরে তাবারি, ৪৭২/৫)
খাবার দেহের প্রয়োজন অনুপাতে গ্রহণ করা জরুরি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম নীতিও এটি। আল্লামা ইবনে রজব (রহ.) নিচের হাদিসটিকে সব চিকিৎসার মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো মানুষ নিজের পেটের চেয়ে নিকৃষ্ট কোনো বস্তু ভর্তি করে না। সে চাইলে শুধু প্রয়োজন পূরণে পেট ভর্তি করতে পারে। আবার চাইলে সে পেটের এক-তৃতীয়াংশ পূর্ণ করবে। বাকি এক-তৃতীয়াংশ পানি পান করবে। বাকি এক-তৃতীয়াংশ নিজের জন্য বাকি রাখবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩৮০)
খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়ে সুরা ইউসুফে ইউসুফ (আ.)-এর গৃহীত পদক্ষেপ ছিল ইতিহাসের যুগান্তকারী একটি ঘটনা। তৎকালীন মিসরের বাদশাহর স্বপ্নযোগে দেখা দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে তিনি এক অনবদ্য নীতিমালার উদ্ভাবন করেন। ওই সময়ে পরিকল্পিতভাবে পর্যাপ্ত চাষাবাদের মাধ্যমে আসন্ন খাদ্যের ঘাটতি ও অভাব দূর করেছিলেন তিনি। তাঁর উদ্ভাবিত খাদ্যের জোগান, ব্যবহার ও সুষম বণ্টননীতি আজও অনুসরণযোগ্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সাত বছর একাধারে চাষ করবে, আর ফসল কাটার সময় খাওয়ার সামান্য পরিমাণ ছাড়া বাকিগুলো শিষের ভিতরে রাখবে। এরপর কঠিন সাত বছর আসবে, তখন মানুষ তোমাদের জমা করা খাবার খাবে, তবে এর থেকে সামান্য তোমরা সংরক্ষণ করবে।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৪৭-৪৮)।
লেখক : খতিব- আউচপাড়া জামে মসজিদ টঙ্গী, গাজীপুর