গাজাবাসীর জন্য ত্রাণসামগ্রী বহনকারী নৌবহর ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ ইসরায়েলি বাধায় পণ্ড হয়েছে। একটি বাদে সব নৌযান আটক করেছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েল। বহরে থাকা সুইডেনের জলবায়ু ও অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গসহ প্রায় ৫০০ মানবাধিকারকর্মীকে আটক করা হয়েছে। এদিকে নৌবহরে ইসরায়েলি বাধায় সারা বিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠেছে। ইসরায়েলের সব কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে কলম্বিয়া। পাশাপাশি রোম, মাদ্রিদ, ইস্তাম্বুলসহ বিশ্বের বড় শহরগুলোতে বিক্ষোভে জড়ো হয়েছে হাজারো মানুষ।
গতকাল ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করা বা আইনসম্মত নৌ-অবরোধ লঙ্ঘন করার চেষ্টা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে। আরেকটি জাহাজ রয়েছে। সেই জাহাজ যদি সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করে অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করে, তবে সেটিকেও আটক করা হবে। ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি, সব যাত্রী নিরাপদ ও সুস্থ আছেন। তাদের নিরাপদে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে তাদের ইউরোপে ফেরত পাঠানো হবে।
ফ্লোটিলা আয়োজকদের বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ইসরায়েলি নৌ কমান্ডোরা এখন পর্যন্ত ৩৯টি জাহাজ আটক করেছে। কিন্তু একটি জাহাজ এখনো গাজার দিকে যাচ্ছে।
ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ওপর ইসরায়েলের আরোপিত অবরোধ ভাঙার লক্ষ্যে ৪৫টি জাহাজ নিয়ে গঠিত ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ নৌবহর গত মাসে স্পেন থেকে গাজার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। এতে সুইডিশ জলবায়ু আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফিলিস্তিনপন্থি পাঁচ শতাধিক রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকারকর্মী অংশ নেন। গত বুধবার রাতে প্রথমবারের মতো ইসরায়েলি নৌবাহিনীর বাধার মুখে পড়ে নৌবহরটি। গাজার উপকূল থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে ভূমধ্যসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায় বহরের জাহাজগুলোতে উঠে পড়ে ইসরায়েলি নৌসেনারা। এর আগে তারা যোগাযোগব্যবস্থা কেটে দেয় এবং সিগন্যাল জ্যাম করে। এতে নৌযান থেকে বিপদসংকেত পাঠানো ও লাইভ সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় আলমা, সুরিয়াস, আদার, স্পেক্টারসহ অন্তত ১৩টি জাহাজ আটক করে ইসরায়েলি সেনারা। সেই জাহাজগুলোতে ৩৭টি দেশের ২০১ জন কর্মী ছিলেন। বাকি জাহাজগুলোকে গতকাল বৃহস্পতিবার আটক করা হয়। আটককৃত নৌযানে সুইডেনের জলবায়ু ও অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গসহ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচিত প্রতিনিধি, আইনজীবী, অধিকারকর্মী, চিকিৎসক ও সাংবাদিক রয়েছেন। ফ্লোটিলায় বাংলাদেশের অধিকারকর্মী শহীদুল আলম ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ মানবাধিকারকর্মী ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রুহি লোরেন আখতার অংশ নেন।
এদিকে আটকের পর তাদের ইসরায়েলের আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। বন্দরটি অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ইসরায়েল জানিয়েছে, আটক ব্যক্তিদের প্রক্রিয়া শেষে উড়োজাহাজে করে ইউরোপে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
ইসরায়েলের এই বাধাদানকে অবৈধ, হতাশাজনক ও নির্লজ্জ কাজ বলে বর্ণনা করেছেন ফ্লোটিলা আয়োজকরা। গতকাল সকালে তারা জানান, এটি স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে যে, দখলদাররা গাজাকে ক্ষুধার্ত এবং বিচ্ছিন্ন রাখতে কতটা চরম পদক্ষেপ নেবে। তারা একটি শান্তিপূর্ণ বেসামরিক মিশনে আক্রমণ করেছে। কারণ মানবিক সহায়তার সাফল্যের অর্থ তাদের অবরোধের ব্যর্থতা।
বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় : গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় ইসরায়েলি বাহিনীর বাধায় বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠেছে। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। পাশাপাশি বড় শহরগুলোতে বিক্ষোভে নেমেছে হাজারো মানুষ।
নৌবহর আটকের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান, কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, স্পেনের শ্রমমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী ইয়োলান্দা দিয়াজ ও আয়ারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস। পাশাপাশি ইসরায়েলের এই পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানিয়েছে যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, জার্মানি, কাতার, ভেনেজুয়েলা, বেলজিয়াম, ব্রাজিলসহ বেশ কয়েকটি দেশ। এ ঘটনার প্রতিবাদে গ্রিস, ইতালি, জার্মানি, স্পেন, আর্জেন্টিনা, তিউনিসিয়া, মালয়েশিয়া এবং তুরস্কে বিক্ষোভ করেছে হাজারো মানুষ। এ ছাড়া ইসরায়েলি বাধার প্রতিবাদে শুক্রবার সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে ইতালির শ্রমিক সংগঠনগুলো।
ইসরায়েলের সব কূটনীতিককে বহিষ্কার করল কলম্বিয়া : গাজামুখী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় ইসরায়েলি বাধার প্রতিক্রিয়ায় কলম্বিয়া থেকে ইসরায়েলের সব কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো। পাশাপাশি ইসরায়েলের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিও তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করেন তিনি।
গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক বার্তায় এ ঘটনাকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নতুন আন্তর্জাতিক অপরাধ বলে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে কলম্বিয়ার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিও তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করা হয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা করবে এবং আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের সহযোগিতা চাইবে।