১৯৬৪ সাল। বাংলাদেশে শুরু হয় টেলিভিশনের পথচলা। আর এ যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নাটকেরও রূপান্তর। সময়ের প্রবাহে নাটক যেমন বদলেছে, তেমনি বদলেছেন অভিনেত্রীরাও। কেউ সময়ের সঙ্গে মিশে গেছেন ইতিহাসে, কেউ হয়েছেন অমর চরিত্রে। এই দীর্ঘ পথচলায় আজ আমরা ফিরে তাকাই টিভি নাটকের সব প্রজন্মের অভিনেত্রীদের দিকে, যাদের অভিনয় আর নন্দনবোধে গড়ে উঠেছে আমাদের ছোটপর্দার সোনালি অধ্যায়। দর্শকের মনে রাজত্ব করা শত শত চরিত্র, তাদের প্রাণ দিয়েছেন যেসব অভিনেত্রী, তাদের নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল
প্রথম প্রজন্ম : সময়টা ১৯৬০-এর দশক। টিভি নাটকের যাত্রার শুরুতেই যে নামটি সব সময় প্রথম সারিতে থাকে, তিনি ফেরদৌসী মজুমদার। একতলা দোতলা দিয়ে যাত্রা শুরু করে ‘সংশপ্তক’-এ হুরমতির ভূমিকায় জাতির হৃদয়ে স্থায়ী আসন গড়ে তোলেন। তার সঙ্গে নাট্যদিগন্তে উঠে আসে ডলি আনোয়ার, শর্মিলী আহমেদ, আলেয়া ফেরদৌসী, আজমেরী জামান রেশমা, দিলারা জামান, দিলশাদ খানম প্রমুখের নাম। ওই সময়ে সুজাতা ও রোজী সামাদও টিভি নাটকে অভিনয় করেন। যদিও পরে তারা সিনেমায় ঝোঁকেন। ডলি আনোয়ারও সিনেমায় অভিনয় করেন। ডলি আনোয়ার যেমন ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ সিনেমায় আলো ছড়ান, তেমনি নাটকে ‘বকুলপুর কত দূর’ ও ‘জোনাকি জ্বলে’তে মুগ্ধতা ছড়ান। ‘নিধুয়া পাথার কান্দে’ নাটকে অভিনয় করে আলোচনায় আসেন আলেয়া ফেরদৌসী। শর্মিলী আহমেদ অভিনীত ওই সময়ের আলোচিত নাটক মালঞ্চ। শর্মিলী আহমেদ ছিলেন ধারাবাহিক নাটক ‘দম্পতি’র প্রথম অভিনেত্রীদের একজন। আজমেরী জামান রেশমা আলোচনায় আসেন মুখরা রমণী বশীকরণ, ধূপছায়া, বিষুবরেখা, শেষের কবিতাসহ আরও বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করে। দিলশাদ খানম ব্যাপক পরিচিতি পান রক্তকরবী নাটকে অভিনয় করে।
দ্বিতীয় প্রজন্ম : ১৯৭০-৮০ এর দশক হলো টিভি নাটকের দ্বিতীয় প্রজন্মের সময়কাল। এ প্রজন্মকে বলা হয় ‘টেলিভিশন নাটকের স্বর্ণযুগ’। সুবর্ণা মুস্তাফা একাই যেন একটি প্রতিষ্ঠান। ‘কূল নাই কিনার নাই’, ‘ইডিয়ট’, ‘জোহরা’-একটির পর একটি মাস্টারপিস নাটকে অভিনয় করে হয়ে ওঠেন দর্শকের প্রিয়মুখ। তার সমসাময়িক অভিনেত্রী মিতা চৌধুরী, রিনি রেজা, লুৎফুর নাহার লতা, শম্পা রেজা, সারা যাকের, প্রিসিলা পারভীন, আফরোজা বানু, তারানা হালিম, নায়লা আজাদ নূপুর, ডলি জহুর, কেয়া চৌধুরী, রেহনুমা-এরা প্রত্যেকেই নিজেদের অভিনয়ের মুনশিয়ানায় জায়গা করে নেন দর্শকের হৃদয়ে। এই সময়কার নাটক যেমন ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘রক্তে আঙুরলতা’, ‘বহুব্রীহি’, ‘এই সব দিনরাত্রি’ আজও অনন্ত স্মৃতি হয়ে আছে দর্শকমনে।
তৃতীয় প্রজন্ম : নব্বই দশকে টেলিভিশনে আগমন ঘটে একঝাঁক প্রতিভাময়ী অভিনেত্রীর। শমী কায়সার, আফসানা মিমি, বিপাশা হায়াত, বিজরী বরকতউল্লাহ, মুনিরা ইউসুফ মেমী, ত্রপা মজুমদার, ফারজানা অপি, তমালিকা কর্মকার, রুবিনা পারভীন রুনা, তানিয়া আহমেদ, সুরাইয়া হুদা রাত্রী, স্মৃতি ফাহমি, সাদিয়া ইসলাম মৌ, তানভীন সুইটি, দীপা খন্দকার। তাদের অনেকেই ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘যত দূরে যাই’, ‘বউ কথা কও’, ‘সুপ্রভাত ঢাকা’র মতো জনপ্রিয় নাটকের মাধ্যমে মানুষের মনে জায়গা করে নেন। এ প্রজন্মের অভিনেত্রীরা ছিলেন আত্মপ্রকাশেই আত্মবিশ্বাসী, অভিনয়ে গভীরতায় পারদর্শী।
চতুর্থ প্রজন্ম : এই সময়টায় টেলিভিশনের পর্দায় আবির্ভাব ঘটে তারিন, ঈশিতা, অপি করিম, রিচি সোলায়মান, শাওন, জয়া আহসানের মতো অভিনেত্রীদের। শিশু শিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু করে তারা পরে হয়ে ওঠেন টিভি নাটকের মূল মুখ। ‘পাত্রী সংবাদ’, ‘শীর্ষবিন্দু’, ‘সবুজ গ্রাম’, ‘সংশয়’-নাটকের মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রতিভা বারবার প্রমাণ করেছেন। বিশেষ করে জয়া আহসান পরবর্তীতে চলচ্চিত্রে দাপট দেখিয়ে প্রমাণ করেছেন ছোটপর্দার তারকারা বড়পর্দায়ও সফল হতে পারেন।
পঞ্চম প্রজন্ম : এ প্রজন্মের শুরু হয় সুমাইয়া শিমু, দীপা খন্দকার, নাদিয়া আহমেদ, সানজিদা প্রীতি, তানজিকা আমিন, শায়না আমিন, চাঁদনী, রুনা খান, গোলাম ফরিদা ছন্দা, সোহানা সাবার মতো মুখগুলোর মাধ্যমে। তাদের ধারাবাহিক কাজ নাটকে গভীরতা ও বিনোদনের ভারসাম্য বজায় রাখে। এরপর আসে এক অভূতপূর্ব নাম-নুসরাত ইমরোজ তিশা। ‘সিক্সটি নাইন’, ‘তিন পাতার ফিকির’সহ অসংখ্য নাটকে অভিনয় করে নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন তিশা।
ষষ্ঠ প্রজন্ম : এ সময়ে ছোটপর্দায় জায়গা করে নেন জাকিয়া বারী মম, শ্রাবস্তী তিন্নি, আজমেরী হক বাঁধন, নওশাবা, তমা মির্জা, ভাবনা, প্রভা, মুনমুন, সারিকা, ইপসিতা শ্রাবন্তী, বিদ্যা সিনহা মিম, নওশীন, হোমায়রা হিমু, রোবেনা জুঁই, নোভা, শখ প্রমুখ। এ প্রজন্মকে ঘিরে দর্শকের প্রত্যাশাও ছিল অনেক বেশি। কেউ কেউ সাফল্যের শিখরে পৌঁছান, কেউবা হারিয়ে যান সময়ের স্রোতে। বাঁধন আজও নিজের কাজ দিয়ে আলোচনায়, আর মম নিজেকে ধরে রেখেছেন দক্ষতায়।
সপ্তম প্রজন্ম : এ প্রজন্মে নাটকের পর্দায় সবচেয়ে আলোচিত নাম মেহজাবীন চৌধুরী। তিনি অসংখ্য নাটকে অভিনয় করে দর্শকের ভালোবাসায় সিক্ত। তার পাশে উঠে আসেন অর্চিতা স্পর্শিয়া। এ প্রজন্মের কাজের মান এবং জনপ্রিয়তা নাটকে নতুন ধারার সূচনা করে।
অষ্টম প্রজন্ম : এ প্রজন্মের অনেকেই নাটকে আলো ছড়িয়েছেন, কেউ কেউ আবার নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। সাবিলা নূর, টয়া, সাফা কবির, সালহা খানম নাদিয়া, তানিয়া বৃষ্টি, অহনা-তারা একসময় ছিলেন নাটকের নিয়মিত মুখ। বর্তমানে কেউ সিনেমার দিকে ঝুঁকেছেন, কেউ সীমিত পরিসরে কাজ করছেন।
নবম প্রজন্ম : সবচেয়ে নতুন প্রজন্মের অভিনেত্রীরা এখন দর্শকদের নজরে। তাসনিয়া ফারিণ নিজেকে নতুন ধারা নাটকের প্রধান মুখ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অন্যদিকে সাদিয়া আয়মান, সুনেরাহ বিনতে কামাল, হিমি, তটিনী, নিহা, কেয়া পায়েল, পারসা ইভানা, সারিকা সাবাহ, সামিরা মাহি, শারমিন সুমি প্রমুখরাও ভালো করছেন টিভি নাটকে।
দশম প্রজন্ম : এটি সর্বশেষ প্রজন্ম, যারা বর্তমানে টিভি নাটকে কাজ শুরু করেছেন। অনেকেই এ প্রজন্মের অভিনেত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ ইতোমধ্যে সম্ভাবনার ছাপ রেখে চলেছেন। মারিয়া শান্ত, রিয়া, নওবা তাহিয়া, মিহি, লামিয়া লাম, আরোহী মিম, জীম, নিশি, রোদশী প্রমুখ।
প্রজন্ম বদলেছে, রুচিরও পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কিছু বিষয় চিরন্তন-সেটি হলো গল্প বলার আকর্ষণ, চরিত্র নির্মাণের মুনশিয়ানা এবং দর্শকের ভালোবাসা। প্রজন্মের প্রতিটি অভিনেত্রীই ছিলেন সেই ভালোবাসার দাবিদার। তাদের অভিনয়, আবেগ এবং ব্যক্তিত্বের সম্মিলনেই গড়ে উঠেছে টিভি নাটকের অনন্য উত্তরাধিকার।