বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেছেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি অর্জন করেই ভবিষ্যতে বাংলাদেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাই। এতে যদি সরকার মাত্রাতিরিক্ত গড়িমসি করে অথবা কোনো রাজনৈতিক দল সরাসরি বিপক্ষে অবস্থান নেয়, তখন আমাদেরও তাদের বিপক্ষে মাঠে নামা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। গত বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে জামিয়া রহমানিয়া মাদরাসায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
মামুনুল হক বলেন, ‘যে কোনো সময় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম সচল করা হতে পারে’-প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্য তাঁর দুর্বল চিত্তের প্রকাশ।
সাক্ষাৎকারে মাওলানা মামুনুল হক সম্প্রতি তাঁর আফগানিস্তান সফর, আগামী জাতীয় নির্বাচন, অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা-ব্যর্থতাসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন। সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত নিচে দেওয়া হলো-
বাংলাদেশ প্রতিদিন : প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় দেড় বছরের শাসনব্যবস্থাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন।
মামুনুল হক : অন্তর্বর্তী সরকারের সময়টাকে মূল্যায়ন করলে সফলতা ও ব্যর্থতা উভয়ই সামনে আসবে। এর কারণ স্পষ্ট, সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন থাকলেও রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কেবিনেটে অনুপস্থিত। এটা সরকারের বড় একটা দুর্বলতা। যে কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী তারা সফলতা অর্জন করেছে-এ কথা বলতে পারব না। বিশেষ করে নতুন একটা বন্দোবস্তের প্রত্যাশা, জন-আকাঙ্ক্ষা অভ্যুত্থান-পরবর্তী মানুষের মধ্যে ছিল। সে জায়গায় সরকার প্রথম দিকে শক্ত অনড় ভূমিকায় থাকলেও অব্যাহত রাজনৈতিক চাপে সে প্রত্যাশা স্পর্শ করতে পারেনি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : এই অবস্থায় দেশ ভবিষ্যতে কোন দিকে যাচ্ছে।
মামুনুল হক : ভবিষ্যতে দেশ কোন দিকে যাচ্ছে তা এখনই পুরোপুরি অনুমান করতে পারছি না। তবে দুইটা সম্ভাবনাই আছে। প্রথমত গতানুগতিক দুই দলীয় বৃত্তের ধাপে দেশ ফিরে যাবে। দুর্বৃত্তায়ন, কালোটাকা, শক্তি, আধিপত্যবাদ ফিরে আসবে। আগের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্বহাল হবে।
দ্বিতীয়ত জুলাই বিপ্লবের যে জন-আকাঙ্ক্ষা তা কিছুটা হলেও বাস্তবায়িত হয়ে দেশের আগামী দিনের রাজনীতির পট পরিবর্তন হবে, সেই সম্ভাবনাও রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হয়েছে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি থেকে। প্রতিনিধিদলে আপনার দলসহ অনেক দলই নেই। বিষয়টি কীভাবে দেখেন।
মামুনুল হক : এটা মূল্যায়ন করতে গেলে আরও অনেক বিষয় উঠে আসবে। এখানে সরকার একটা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করেছে। বিএনপি ও জামায়াত বর্তমানে বৃহৎ রাজনৈতিক দল। অতীতে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম বিবেচনা করলে দুইটি দল বৃহৎ বিবেচনা হতে পারে। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী সংগঠনের নেতাদের রাজনৈতিক দল এনসিপি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সরাসরি জুলাই বিপ্লবীদের প্রতিষ্ঠিত সরকার বলা যায়। সে হিসেবে এই তিন দলকে অগ্রাধিকার দেওয়ার যৌক্তিক কারণ আছে।
সরকার রাজনৈতিক দলগুলো হ্যান্ডেল করার ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা তৈরি করেনি। যে কারণে প্রশ্ন তৈরি হয়। কোন কারণে নেওয়া হবে, কোন কারণে নেওয়া হবে না, কেন নেওয়া হবে না, তা স্পষ্ট থাকা দরকার। জুলাই ঘোষণাপত্র অনুষ্ঠানে স্টেজে কিছু দলের প্রতিনিধি থাকল। অনেক দলের প্রতিনিধি থাকল না। এই বিয়য়গুলো দৃষ্টিকটু। সেই তুলনায় প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘ সফরে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নির্বাচন সঠিক ছিল। এই তিন দল বর্তমান রাজনৈতিক বিবেচনায় অগ্রগণ্য। তবে সরকারের উচিত ছিল আরও আগে একটা সুন্দর নীতিমালার আলোকে বিষয়গুলো নিষ্পন্ন করা, যাতে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ না পায়। এটা সরকারের একটা দুর্বলতা।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে আগামী ফ্রেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন। এই ঘোষণায় জনমনে আস্থা সৃষ্টি হচ্ছে না কেন।
মামুনুল হক : জনমনে আস্থা না আসার বড় কারণ হতে পারে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি। আগামী নির্বাচনটা জুলাই সনদের ভিত্তিতে হবে কি না, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। এই প্রশ্নের সমাধান এখনো সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়নি। এই প্রশ্নের সমাধান যত দিন না করা হচ্ছে, জনমনে এই সংশয় দূর হওয়া সম্ভব না।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : জামায়াতে ইসলামী তিন শ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে, আবার জোট গঠনেরও চেষ্টা চালাচ্ছে। আপনার দলও ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। ভবিষ্যতে একক নাকি জোটগতভাবে ভোট করবেন?
মামুনুল হক : বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের পক্ষ থেকেও তিন শ আসনে নির্বাচন করার দলীয় প্রস্তুতি রয়েছে। ইতোমধ্যে ২৬৮টি আসনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন ঘোষণা করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী বা ইসলামী আন্দোলনসহ আরও কিছু ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে আছি। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি বা আইনগতভাবে বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আগামী নির্বাচনের যে মেরূকরণ তা চূড়ান্ত হবে না। যদি পিআর বাস্তবায়িত হয় তাহলে রাজনৈতিক বিবেচনার আরেক নতুন দুয়ার খুলবে। সে ক্ষেত্রে জোট করব, না এককভাবে নির্বাচন করব দলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দেখা দেবে। সেজন্য এখনই চূড়ান্ত কথা বলতে পারছি না। নির্বাচন সামনে রেখে বর্তমানে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সতর্কভাবে এগোচ্ছি। জনমনে একটা আকাঙ্ক্ষা আছে ইসলামপন্থিদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এক বাক্সে তাদের অংশগ্রহণ। আবার এটাও আছে যে বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তিকে সম্পূর্ণ ইসলামপন্থিদের মুখোমুখি ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কি না। এতেও আমরা সতর্কভাবে কাজ করে চলেছি। এককভাবে তিন শ, আবার পরিস্থিতি অনুযায়ী অ্যালায়েন্স করার প্রয়োজন পড়লে তা-ও করার মানসিক প্রস্তুতি রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : জুলাই সনদের অবিলম্বে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়ন, জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, আগামী নির্বাচনে প্রকৃত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা ও জুলাই গণহত্যার বিচার দৃশ্যমান করার দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন করে চলেছেন। কেন এই আন্দোলন। দাবি পূরণ না হলে কী করবেন।
মামুনুল হক : এই আন্দোলনে মুখ্য দাবি একটাই তা হলো জুলাই সনদের বাস্তবায়ন। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান। এই জুলাই সনদ দাবির প্রশ্নে আমরা খুবই সিরিয়াস। এই দাবি আদায়ে যত দূর পর্যন্ত সাধ্যে কুলায় তত দূর পর্যন্ত আন্দোলন নিয়ে যাওয়া আমাদের প্রত্যয়। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি অর্জন করেই ভবিষ্যতে বাংলাদেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাই। সরকার আইনি ভিত্তি নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত গড়িমসি করলে অথবা কোনো রাজনৈতিক দল যদি সরাসরি বিপক্ষে অবস্থান নেয় তখন আমাদের তাদের বিপক্ষে মাঠে নামা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নির্বাচনি সংকট কাটবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : জিটিওতে সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করিনি। এমনকি তাদের রেজিস্ট্রেশনও স্থগিত করা হয়নি। শুধু তাদের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। যে কোনো সময় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম সচল করা হতে পারে।’ তার এমন বক্তব্যে সমালোচনার ঝড় বইছে। আপনার মন্তব্য কী?
মামুনুল হক : এটা অবশ্যই ড. ইউনূস সাহেবের দুর্বল চিত্তের প্রকাশ। আওয়ামী লীগ সরকারের জুলাই গণহত্যা, তার আগে দীর্ঘ দেড় দশকের গুম, খুন, হত্যাকাণ্ড, প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলোকে দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামানোর মতো কার্যক্রম পরিচালনা করার পর-এই দলকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে আখ্যায়িত করার মতো সাহস ড. ইউনূস দেখাতে পারেননি। এটা ওনার চরম দুর্বলতা।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : সম্প্রতি আফগানিস্তান সফর করেছেন। হঠাৎ আফগানিস্তানে কেন। সফরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলবেন?
মামুনুল হক : মানবাধিকার সংগঠন প্রসপার আফগানিস্তান নামক যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটা সংস্থা থেকে একটি আমন্ত্রণ আসে। সংস্থার অধিকাংশ দায়িত্বশীল বাংলাদেশি বংশোদভূত। তারা বিভিন্ন জায়গায় মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করেন। সেই কাজের সুবাধে আফগানিস্তান একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, সেখানে মানুষের নানা ধরনের সংকট, অনেক সমস্যা। তারা মানবিক দিক থেকে সেই সংকট নিরসনে কাজ করে যাচ্ছেন। কাজের সূত্রেই তারা বিভিন্ন দেশের ডেলিগেটদের আফগানিস্তানের জনগণের বাস্তব পরিস্থিতি অবলোকন করার জন্য এ ধরনের প্রোগ্রামের আয়োজন করেন। ইতোমধ্যে তারা লন্ডন থেকে দুইটি প্রতিনিধিদল নিয়ে আফগানিস্তান ভ্রমণ করেছেন। পরে তারা চিন্তা করেছেন, বাংলাদেশের একটা প্রতিনিধিদল যদি যায় ভালো হবে। সে হিসেবে তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আফগানিস্তানের মতো একটা দেশ দেখার কৌতূহল তো আছেই। আমরা তাদের বলি, যদি আইনিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন আমাদের যেতে আপত্তি নেই। পরবর্তী সময়ে তারা আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাওয়ার ব্যবস্থা করলে সেখানে যাই। আফগানিস্তানে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। দুবাই ট্রানজিট হয়ে যেতে হয়। আমরা এখান থেকে একসঙ্গে ওমরা করে দুবাই হয়ে আফগানিস্তান চলে গেলাম। সেখানে যাওয়ার পর উল্লেখযোগ্য কিছু স্থান দর্শন করেছি। সেখানকার রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি দেশটা কীভাবে তারা পরিচালনা করছেন। অর্ধ শতাব্দীর যুদ্ধবিধ্বস্ত বিশাল অঞ্চলের একটা দেশ। সেখানকার সবাই প্রায় মুসলিম। এসব জনপদ কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, এই বিষয়গুলো আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আলোচনার মাধ্যমে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়েছে, সেখানে তারা অনেক ভালো কাজ করছেন। ২০২১ সালের আগস্ট থেকে কাজ করে চলেছেন। এই সময়ে তাদের অর্জন খুব কম নয়। আমাদের চোখে পড়েছে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত করা। দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সাধারণ মানুষের ইজ্জত আবরুর নিরাপত্তা-এটাকে অভূতপূর্বই বলতে হবে। স্বচক্ষে তা প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা নিজেরাই রাতের অন্ধকারে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা চার শ থেকে পাঁচ শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যাতায়াত করেছি। রাস্তায় অসংখ্য সাধারণ মানুষ ও যানবাহন রাতবিরাতে চলাচল করতে দেখেছি। ছিনতাই, লুটপাট বা ডাকাতি হবে এমন কোনো পরিবেশ নাই। প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে যারা রয়েছেন তারা আল্লাহভীরু মানুষ। যে কারণে গোটা দেশে কোথাও এক টাকাও ঘুষ লেনদেন হয়, এটা মনে হয়নি। তারা শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তুলতে পেরেছেন। নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিগত প্রায় চার-পাঁচ দশকে যে ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি শুধু পরিকল্পনাতেই ছিল তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের টার্গেট করেছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। বাকি ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যুৎ তারা দেশের বাইরে বিক্রি করবে। এজন্য অবকাঠামোগত কাজ অনেক এগিয়েছে। চার বছরের মধ্যে তারা সাড়ে ছয় লাখ বর্গকিলোমিটারের প্রতিটা বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার প্রত্যয় ও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে তারা বিচার বিভাগে যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেছে। ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক বিচার ১৫ দিনের মধ্যে নিম্ন আদালতে সম্পন্ন করতে হয়। এই সময়ের মধ্যে বিচার সম্পন্ন না করতে পারলে নিম্ন আদালতকেই উচ্চ আদালত থেকে সময় চেয়ে নিতে হয়। অল্প সময়ে মানুষ বিচার পাচ্ছে। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, মামলা-মোকাদ্দমা পরিচালনা করার জন্য উকিল, ব্যারিস্টারের খুব একটা প্রয়োজন হয় না। কেউ চাইলে প্রক্রিয়া অনুযায়ী আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন। বাস্তবতা হলো অর্ধেকের বেশি মামলা নিষ্পত্তি হয় শুধু বাদী এবং বিবাদী আর সাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমেই। সরাসরি বিচারক বাদীর বক্তব্য শুনে সাক্ষ্য গ্রহণ করেন-রায় হয়ে যায়। এ কারণে যে কোনো বিচার দুই সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন হচ্ছে। বিচারে আপত্তি থাকলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। আমাদের সবচেয়ে বেশি অভিভূত করেছে সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমাদের বানানো আইন, সমাজব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা সবকিছু পরিবর্তন করে ইসলামিককরণ করা হয়েছে। সরাসরি কোরআন ও হাদিসের শতভাগ বিধান তারা বাস্তবায়ন করেছেন। একজন মুসলিম হিসেবে বিশ্বাস করি, যেখানে আল্লাহর পরিধান পরিপূর্ণভাবে কার্যকর হয়, সেখানে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা বিশেষ রহমত থাকে। সেই রহমতটা জাতি এখন প্রাপ্ত হচ্ছে। এগুলো ছিল আমাদের দেখা পজিটিভ দিক।
একটা নেগেটিভ বিষয়ও আছে। তা হলো নারীশিক্ষা। নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। স্কুলে মাত্র ক্লাস সিক্স পর্যন্ত মেয়েরা পড়াশোনা করছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েদের শিক্ষা স্থগিত রেখেছে। আর ধর্মীয় ক্ষেত্রে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের বক্তব্য হলো যেহেতু শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, সেখানে ছেলেমেয়েসহ (একসঙ্গে) শিক্ষার বিধান নেই। তাদের বক্তব্য, ছেলেমেয়েদের পৃথক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিগত দিনগুলোতে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসি সময়ে ব্যাপকভাবে শিক্ষা সিলেবাসে পশ্চিমা জীবনধারা, চিন্তা-চেতনা অনুপ্রবেশ করানোর জন্য সব রকম ব্যবস্থা তারা করেছিল। যে কারণে গোটা শিক্ষা সিলেবাস বাতিল করে নতুনভাবে প্রণয়ন করতে হচ্ছে। এজন্য সময়ক্ষেপণ হয়েছে। আমাদের এই উদ্বেগ-আশঙ্কার কথা বলার পর তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, শিগগিরই এই অবস্থার অবসান ঘটবে। নারীরা জেনারেল ক্ষেত্রেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে। আমার ধারণা হয়তো বছরখানেকের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান তারা করতে পারবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : এই সফর ঘিরে কেউ কেউ আপনাকে তালেবানের সঙ্গে সম্পর্কের ট্যাগ দিচ্ছে। কীভাবে দেখেন?
মামুনুল হক : আমার সঙ্গে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয়ভাবে আগে বা পরের কোনো যোগাযোগ নেই। দূর থেকে ইসলামের সূত্রে তাদের ভালোবাসি। কারণ তারা কোরআন-সুন্নাহর শাসন কায়েম করেছে। মুসলমান হিসেবে জীবনের অন্য সব ক্ষেত্রের মতোই রাষ্ট্র এবং রাজনীতিতে আমরা মনে করি ইসলামি শাসনব্যবস্থাই সর্বশ্রেষ্ঠ। মানবতার একমাত্র কল্যাণ ইসলামে নিহিত। আমরা যে ধরনের কথা বলি, সে ধরনের শাসনব্যবস্থা তারা বাস্তবায়ন করেছে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা থাকবেই। এর বাইরে এখানে ট্যাগ দেওয়ার কিছু নেই। যারা ট্যাগ দিতে চায় আমি মনে করি তারা একধরনের হীনম্মন্যতার শিকার। পাশ্চাত্যরা চায় না কোথাও ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হোক, প্রতিষ্ঠিত হলে অন্য মুসলমানরা বিষয়টাকে ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করবে। পশ্চিমাদের আতঙ্ক হলো মুসলমানরা যদি ইসলামি শাসনব্যবস্থার সৌন্দর্য দেখে ফেলে, প্রতিটি জনপদে ইসলামি শাসনব্যবস্থা বাস্তবায়নের আওয়াজ উঠবে। সেই আওয়াজ তারা রুখতে পারবে না। সেই আতঙ্ক থেকেই পশ্চিমারা মুসলিম সমাজকে ইসলামি শাসনব্যবস্থার সৌন্দর্য দেখা থেকে বিরত রাখার জন্যই এ ধরনের একটা রিউমার ছড়িয়ে রেখেছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : হেফাজতে ইসলামের নেতাদের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেখা যাচ্ছে, বক্তব্য রাখছেন?
মামুনুল হক : হেফাজতে ইসলাম সাংগঠনিকভাবে অরাজনৈতিক সংগঠন। সংগঠনের সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ধর্মীয় ও আদর্শিক দিক থেকে হেফাজত নেতারা যেসব বিষয় লালন করে সে জায়গায় কোনো কোনো বক্তব্য জামায়াতে ইসলামীর মূল আদর্শিক জায়গায় মতবিরোধ আছে, থাকতে পারে। সেটা তার আপন জায়গায়। হেফাজতের রাজনৈতিক জায়গায় জামায়াত বা অন্য কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষে যাওয়ার সুযোগ নেই। হেফাজতের ব্যানারে বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের কোনো সুযোগ নেই। বিএনপির নেতারা আলেম হিসেবে মুরুবিব হিসেবে কারও কাছে যান, এটা হতেই পারে। সাক্ষাৎকারগুলো অধিকাংশই সৌজন্যমূলক। আরেকটা জায়গা থেকেও বিভ্রান্তি তৈরি হয়। হেফাজতের অনেকগুলো রাজনৈতিক দলভুক্ত নেতা রয়েছেন। সেখানকার কোনো কোনো সংগঠন নিজস্ব রাজনৈতিক ব্যানারে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে হয়তো লিয়াজোঁ করতে পারে। সেটা হেফাজতের বিষয় না। সেখানে হেফাজতের হয়ে বৈঠক করার কোনো সুযোগও নেই।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ৫ আগস্টের পর পুলিশকে রাজনীতিকরণমুক্ত করতে ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব ছিল এবং সরকার তা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল, আপনি কি মনে করেন পুলিশ কমিশন বা পুলিশ সংস্কারের কাজ সরকার করছে বা করতে আন্তরিক?
মামুনুল হক : এখন পর্যন্ত পুলিশে যে সংস্কার করার এবং পুলিশকে বিরাজনীতিকরণে যে জন-আকাঙ্ক্ষা ছিল, জুলাই বিপ্লবের প্রত্যাশা ছিল, তার কিছুই করেনি। ব্যাপকভাবে নিয়োগের দাবি ছিল, প্রয়োজনও ছিল। রাজনৈতিক বিবেচনায় পুলিশে ছাঁটাইয়ের প্রয়োজন ছিল। সরকার সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে করতে পারেনি। এটাও সরকারের একটা ব্যর্থতা।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : দেশবাসীর উদ্দেশে কী বলবেন?
মামুনুল হক : দেশবাসীকে বলব, দেশের সব নিপীড়িত অবহেলিত বঞ্চিত মানুষেরা মিলে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে নতুন বাংলাদেশ অর্জন করেছে। এই অর্জন অসংখ্য মানুষের রক্তের বিনিময়ে। কাজেই অন্তত শহীদদের প্রতি দায়বোধ থেকে আমাদের পুরোনো বন্দোবস্ত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া উচিত। নতুন বাংলাদেশ গড়তে আমরা সবাই যেন দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে, ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ বিবেচনা না করে দেশ ও জাতির স্বার্থকেই প্রাধান্য দিই। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে পারি। এটাই ইসলামি রাজনীতির সবচেয়ে বড় অর্জন হবে। বৈষম্যহীন সমাজ গড়াই ইসলামি রাজনীতির মুখ্য বিষয়।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মামুনুল হক : আপনাকেও ধন্যবাদ।