কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে যাওয়ার পথে বাহারছড়ার কচ্ছপিয়া পাহাড় যে কারো নজর কাড়ে। সূর্যাস্তের আলোয় ঝলমল করা পাহাড়টি যেন এক সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি। পর্যটকরা থেমে ছবি তোলে, কিন্তু এই পাহাড়ের অন্তরালে লুকিয়ে আছে ভয়ংকর মানবপাচার চক্রের গোপন আস্তানা।
সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একাধিক অভিযানে এই ‘রহস্য পাহাড়ের’ আসল চেহারা উন্মোচিত হয়েছে।
মালয়েশিয়ায় নৌপথে পাচারের উদ্দেশ্যে অপহৃত নারী-পুরুষ ও শিশুদের এই পাহাড়ে আটকে রাখা হয়। উদ্ধার হওয়া অনেকেই জানায়, দিনের পর দিন তাদের পাহাড়ের বিভিন্ন গোপন আস্তানায় বন্দি অবস্থায় থাকতে হয়েছে। গত দুই সপ্তাহে বিজিবি, কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনী ও র্যাবের পৃথক ও যৌথ অভিযানে কচ্ছপিয়া পাহাড় থেকে ১৯৩ জন ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা হয়েছে। সর্বশেষ গত বুধবার রাতে কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীর যৌথ অভিযানে কচ্ছপিয়া পাহাড়ের কাছে করাচিপাড়া এলাকার একটি ঘর থেকে ২১ জনকে উদ্ধার করা হয়।
পাচারকারীরা তাদের পাহাড়ের আস্তানায় নিয়ে যাওয়ার আগেই অভিযান চালানো হয়।
এর আগে বিজিবি ও র্যাবের যৌথ অভিযানে ৮৪ জন এবং কোস্ট গার্ডের পৃথক অভিযানে ৬৬ জনকে উদ্ধার করা হয়। অভিযানের সময় পাচারকারীদের কয়েকজন ধরা পড়লেও চক্রের মূল হোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
‘অপহরণ করে রাখা হয়েছিল’ : কোস্ট গার্ড সদর দপ্তরের মিডিয়া কর্মকর্তা লে. কমান্ডার সিয়াম-উল-হক বলেন, ‘গত বুধবার রাত ১১টায় কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীর যৌথ অভিযানে করাচিপাড়া ঘাট সংলগ্ন একটি ঘর থেকে নারী, শিশুসহ ২১ জনকে উদ্ধার করা হয়। পাচারকারীরা টের পেয়ে পালিয়ে যায়। তাদের ধরতে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে।’
কচ্ছপিয়ার স্থানীয় বাসিন্দা মো. আমিন বলেন, ‘পাহাড়ে পাচারকারীদের অন্তত ১০টি গোপন আস্তানা আছে। চিরুনি অভিযান চালালে আরো অনেক ভুক্তভোগী উদ্ধার সম্ভব। এতবার অভিযান হওয়া সত্ত্বেও আবারও লোকজনকে জড়ো করা হচ্ছে, এটা প্রমাণ করে পাচারকারীরা কতটা কৌশলী ও বেপরোয়া।
যেভাবে চলে অপারেশন : পাচারকারীরা মূলত স্থানীয় বাসিন্দা। অনুসন্ধান ও স্থানীয় সূত্র জানায়, চক্রটি কচ্ছপিয়া ও আশপাশের গ্রাম থেকে লোক জড়ো করে। তাদের মোবাইল ফোনে মালয়েশিয়ায় চাকরির প্রলোভন দেখানো হয়। এরপর জিম্মি করে রাখা হয় কচ্ছপিয়া পাহাড়ের আস্তানাগুলোতে। পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করে, তারপর ট্রলারযোগে সাগরে তুলে দেওয়া হয় পাচারকারীদের ট্রলারে।
নেতৃত্বে পরিচিত মুখ : মানবপাচারে নেতৃত্ব দেওয়া চক্রের মধ্যে অন্যতম টেকনাফ বাহারছড়ার কচ্ছপিয়া জুম্মাপাড়ার বাসিন্দা আব্দুল আলী। তিনি স্থানীয় বিএনপির ওয়ার্ড নেতা নসরত আলীর ছেলে। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মানবপাচার ও অপহরণ মামলার কথা জানায় স্থানীয় লোকজন।
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেও তাঁর নাম উঠে আসে। সে সময় টেকনাফ থানার পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ২৬ মে আটক হলেও জামিনে মুক্ত হয়ে আবার মানবপাচারে সক্রিয় হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁর ছেলে সাইফুল ইসলাম এই কাজে তাঁকে সহযোগিতা করছেন বলে স্থানীয় লোকজনের দাবি।
চক্রের সঙ্গে জড়িত আরো যাঁদের নাম উঠে এসেছে : রশিদ মেম্বার (হাবিরছড়া), মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, রেজাউল করিম, আয়াতুল তনজিদ, মুজিব উল্লাহ, জয়নাল, আব্দুল মজিদ, শাহজাহান, ফেরদৌস, আব্দুল গফুর (স্থানীয় নারী মেম্বারের স্বামী), কেফায়েত উল্লাহ, জসিম উদ্দীন, সোলতান আহমদ, জাফর আলম, সৈয়দুল হক, রিদুয়ান, ফারুক ও মো. জুবায়ের।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, এই চক্রকে আইনের আওতায় না আনলে কচ্ছপিয়া পাহাড় থেকে মানবপাচার বন্ধ হবে না।
সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ