গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংস্কারে এবার ছোটবড় প্রায় ৪৪টি পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। যেখানে একক প্রার্থীর আসনে ‘না’ ভোট এবং জোটের প্রার্থীকে নিজ দলের প্রতীকে ভোট করার কথাও বলা হয়েছে। এ ছাড়া আরপিও সংস্কারে ইভিএমের বিধান যেমন বাদ দেওয়া হয়েছে, তেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনী যুক্ত, অনিয়মে পুরোনো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা পুনর্বহালের প্রস্তাবও দিয়েছে ইসি।
তবে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও ঐকমত্য কমিশনের মতামতের পর একগুচ্ছ প্রস্তাব ইসি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠালেও শেষ পর্যন্ত কী কী সংস্কার চূড়ান্ত হবে, তা সরকারের ওপরই নির্ভর করছে।
আরপিও সংস্কারের বিষয়ে সোমবার নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘আরপিও সংশোধনের প্রস্তাবটা এখন আইন লেজিসলেটিভ বিভাগে অপেক্ষমাণ আছে। আমরা আশা করি অচিরেই এটা পেয়ে যাব।’
এদিকে প্রথম সংসদ নির্বাচনের আগে ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) প্রার্থীর নির্বাচনি ব্যয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয় ২০ হাজার টাকা। এরপর বাড়াতে বাড়াতে সবশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এ ব্যয় ধরা হয় সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা। কিন্তু ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের নির্দিষ্ট ব্যয়সীমা তুলে দিতে চায় নির্বাচন কমিশন। এর পরিবর্তে ভোটারপ্রতি ১০ টাকা ব্যয় বেঁধে দেওয়ার প্রস্তাব তুলেছে তারা। ইসির এ প্রস্তাব আরপিওতে যুক্ত হলে সাড়ে ৭ লাখ ভোটারের আসনে একজন প্রার্থী ৭৫ লাখ টাকা ব্যয় করারও সুযোগ পাবেন। নির্বাচনব্যবস্থা যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে এবার আরপিওতে নতুন অনেক বিষয় যেমন যুক্ত হতে যাচ্ছে, তেমন অনেক কিছু বাদও পড়ছে।
১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে আরপিও জারি হয়। এ নিয়ে অন্তত ১৪ বার নানান ধরনের সংস্কার এসেছে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনুচ্ছেদ, দফা, উপদফা বা করণিকসহ ২৪১টি বিষয়ে সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। সংখ্যা হিসাব বিবেচনায় নিলে এবার তৃতীয় সর্বোচ্চ সংশোধন আসতে যাচ্ছে আরপিওতে। সবশেষ ২০০৮-২০০৯ সালে আরপিওতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। বড় সংস্কার আসে ২০০১ সালেও।
এবার ছোটবড় প্রায় ৪৪টি পরিবর্তনের প্রস্তাব রেখে আরপিও সংশোধনের খসড়া ২ সেপ্টেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে এ এম এম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিশন। এতে একক প্রার্থীর আসনে ‘না’ ভোট চালু ও জোট করলেও প্রার্থীকে নিজ দলের প্রতীকে ভোট করার মতো প্রস্তাব রয়েছে। এসব প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে যাচাইবাছাই হয়ে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতি আরপিওর অধ্যাদেশ জারি করবেন।
আরপিও সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এবার বেশ কিছু নতুন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। আমরা আরপিও সংশোধন প্রস্তাব চূড়ান্ত করে পাঠিয়েছি। এখন আইন মন্ত্রণালয় যাচাইবাছাই করছে। এরপর উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন হতে হবে, তারপর অর্ডিন্যান্স করে পাঠাবে। সবটাই যে পাঠাবে, এটাও আমরা বলতে পারি না। যোগ-বিয়োগ দুটোই হতে পারে। এটা এখন সরকারের বিবেচনার বিষয়। প্রবাসীদের জন্য এবার পোস্টাল ভোটিংয়ের বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। অনলাইন নিবন্ধনসহ ভোটিং পদ্ধতির বিষয়গুলোও তুলে ধরা হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে ইভিএম।’
কেমন সংস্কার হচ্ছে সে বিষয়ে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য, ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কতগুলো সংস্কার হলো, সেটা বিষয় নয়। ব্যাপার হলো ব্যাসিক কী কী পরিবর্তন এসেছিল। ২০০১ সালে এসেছিল বড় পরিবর্তন, ২০০৮-২০০৯ সালে এসেছিল বেশ কিছু পরিবর্তন। এবার আরপিওতে কী সংযোজন হলো, কী বিয়োজন হলো তা অধ্যাদেশ হলে বুঝতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগ যুক্ত করা হয় প্রথমবার ২০০১ সালে। এ সময় রাজনৈতিক দল নিবন্ধন প্রথা শুরু হয়, কিন্তু অপশনাল ছিল। ২০০৯ সালে দল নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, ছবিসহ ভোটার তালিকা, এনআইডি কার্ড চালু, না-ভোট চালুসহ অনেক সংস্কার আসে।’ ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালের পর ২০২৫ সালে ভালো পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে বলে মনে করেন জেসমিন টুলী।
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের জন্য আচরণবিধি ছিল না, ১৯৯১ সালে একটা নীতিমালা করা হয়। ১৯৯৬ সালে আইনে ব্যাকআপ দেওয়া হয়। নির্বাচন করতে হলে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন নিতে হবে, এটা বড় বিষয়, যা ২০০৮ সালে বাধ্যতামূলক করা হয়।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনী ২০০১ সালের আরপিওতে থাকলেও ২০০৯ সালে বাদ দেওয়া হয়। এবার ফের প্রতিরক্ষা বিভাগ যুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ১৯৮৬ সালে প্রথমবারের মতো পাঁচটি আসনে একজনের প্রার্থী হওয়ার বিধান যুক্ত করা হয় জানিয়ে জেসমিন টুলী বলেন, ‘আরপিওতে আগে একজন কটি আসনে ভোট করবেন, তা উল্লেখ ছিল না, নতুন দফা যুক্ত করে ১৯৮৬ সালে পাঁচটি আসন সীমাবদ্ধ করা হয়। ২০০৮-২০০৯-এ এসে তা তিনটি আসনে সীমাবদ্ধ করা হয়।’
নির্বাচনি ব্যয়ের বিষয়ে ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, ‘শুরুতে ব্যয় নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও মাঝখানে তা ছিল না। আরপিওর বিধানটি বাদ দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালে ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ হয়। এরপর ১৯৮৭ সালে সীমা তুলে দেওয়া হয়। ফের নির্বাচন ব্যয়ের বিধান যুক্ত করা হয় ১৯৮৫ সালে। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে ৩ লাখ টাকা, ২০০১ সালে ৫ লাখ টাকা, ২০০৮ সালে ১৫ লাখ টাকা ও ২০১৩ সালে ২৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয় আরপিওতে।’
বর্তমানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনি ব্যয় সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা। সব সংসদীয় আসনের জন্য ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা একই। কিন্তু দেশে ২ লাখ ভোটারের নির্বাচনি আসন যেমন রয়েছে, তেমন ৭ লাখেরও আছে। ভোটার সংখ্যার তারতম্যের মধ্যে একই ব্যয়সীমাকে অনেকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করেন। এমন প্রেক্ষাপটে প্রার্থীর ব্যয় ভোটারপ্রতি ১০ টাকা করার কথা বলছে নির্বাচন কমিশন।