পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ নেই, যার কোনো দায়িত্ব নেই। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনই একজন ক্ষুদ্রতম দুর্বল মানুষেরও দায়িত্ব আছে। মহান আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন।
বোখারি ও মুসলিম বর্ণিত একটি হাদিসে রসুল (সা.) আমাদের প্রত্যেকের এই দায়িত্ব সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। শাসক দায়িত্বশীল, তিনিও নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন।’
অনেকে ভাবতে পারেন, এটা বোধ হয় শাসকদের হাদিস। তারা যেহেতু রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল তাই রসুল (সা.) তাদের সতর্ক করেছেন। আসল ব্যাপার তা নয়। রসুল (সা.) হাদিসের পরের অংশে বলেছেন, ‘পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল, সে তার দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’
এবার নারীরা ভাবতে পারে, এখানে যেহেতু পুরুষদের উদ্দেশে রসুল (সা.) সতর্ক করেছেন, তাই নারীদের বোধ হয় কোনো দায়িত্ব নেই। কিন্তু রসুল (সা.) হাদিসের পরের অংশে বলেছেন, ‘একজন নারী তার স্বামীর ঘর ও সন্তানের দায়িত্বশীল, সে তাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’
এ পর্যায়ে খেটে খাওয়া সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ ভাবতে পারে, তারা যেহেতু দুর্বল, তাদের বোধ হয় কোনো দায়িত্ব নেই। কিন্তু রসুল (সা.) তাদের ব্যাপারেও বলেছেন, ‘একজন দাস তার প্রভুর সম্পদের দায়িত্বশীল, সে তার ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’
এভাবে রসুল (সা.) সব শ্রেণির মানুষের দায়িত্ব সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। হাদিসটির বাংলা অনুবাদে আমরা যত জায়গায় ‘দায়িত্বশীল’ অনুবাদ করেছি, রসুল (সা.) সব জায়গায় সরাসরি ‘রাখাল’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ আমরা সবাই রাখাল। আমাদের রাখালি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। প্রশ্ন হতে পারে, রসুল (সা.) দায়িত্বশীল শব্দের পরিবর্তে সরাসরি রাখাল শব্দ কেন ব্যবহার করলেন। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। প্রথমত রাখালি এমন এক কাজ, যেখানে মালিক সঙ্গে থাকে না। তারপরও এ কাজে ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফাঁকি দিলেই মালিকের ছাগল-ভেড়ার ক্ষতি অনিবার্য হয়ে ওঠে। হয়তো তারা অন্যের খেতে মুখ দেয় কিংবা হিংস্র পশুর আক্রমণের শিকার হয় অথবা পথ হারিয়ে ফেলে। এজন্য মালিক সঙ্গে না থাকলেও রাখালকে মালিকের সম্পদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হয়।
তা ছাড়া রাখালি করা প্রচুর পরিশ্রমসাধ্য ও ধৈর্যের কাজ। যারা এক দিনের জন্যও ছাগলের রশি ধরেছেন, তাদের অভিজ্ঞতা থাকার কথা। ছাগলকে আপনি যদি উত্তর দিকে নিয়ে যেতে চান, সে দক্ষিণে যেতে চাইবে। আবার দক্ষিণে নিতে চাইলে সে উত্তরে টান ধরবে। এটাই ছাগলের প্রকৃতি। তাই একজন রাখালকে চরম ধৈর্যশীল ও সহনশীল হতে হয়। রসুল (সা.)-এর রাখাল শব্দ ব্যবহারের কারণ, একজন রাখাল যে ধৈর্য ও একনিষ্ঠতা নিয়ে ছাগল চরায়, সেই একই রকম ধৈর্য ও একনিষ্ঠতা নিয়ে প্রত্যেককে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। আর ধৈর্যের এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করার জন্যই আল্লাহ সব নবী-রসুলকে জীবনের কোনো না কোনো পর্বে রাখালি করিয়েছেন। যেন তারা উম্মতের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেন।
আমরা অধিকাংশ মানুষ দায়িত্ব গ্রহণ বা ক্ষমতার জন্য লালায়িত থাকি। ক্ষমতার চাবি হাতে নেওয়ার জন্য নানা রকম চেষ্টা-তদবির-ঘুষ এমনকি জুলুম পর্যন্ত করি। অথচ ক্ষমতা লোভনীয় কোনো বিষয় নয়, ক্ষমতা ভয়ের বিষয়। আবদুর রহমান ইবনে সামুরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল (সা.) একদিন আমাকে বললেন, হে আবদুর রহমান ইবনে সামুরাহ, ক্ষমতা চাইবে না। কেননা তুমি যদি তা চাও এবং তা তোমাকে দেওয়া হয় তবে তা তোমার ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে (অর্থাৎ আল্লাহর সাহায্য পাবে না)। আর যদি তা না চেয়ে দেওয়া হয়, তবে তুমি সে বিষয়ে সাহায্যপ্রাপ্ত হবে (বোখারি)।
এ কারণে সাহাবি থেকে শুরু করে বড় বড় মনীষী ক্ষমতা তো চাইতেনই না, বরং অনেকে ক্ষমতাকে ভয় পেতেন। ইসলামের ইতিহাসের অনেক মনীষী জেলে পর্যন্ত গেছেন তারপরও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজি হননি। খলিফা ওমর (রা.) বলতেন, যদি ফোরাতের তীরে ক্ষুধার কারণে একটি ছাগলও মারা যায়, ধারণা করি এর জন্য আমি জিজ্ঞাসিত হব।
মনে রাখতে হবে, ক্ষমতা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত। এই আমানতের মর্যাদা রক্ষা করলে ক্ষমতা আমার জন্য মুক্তির কারণ হতে পারে। আবার খেয়ানত করলে এই ক্ষমতার কারণেই আমি জাহান্নামি হতে পারি।
জুমার মিম্বর থেকে
গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ