বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত জাতীয় শিশু অধিকার সপ্তাহ পালন করা হয়, যা শিশুদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। শিশু অধিকার বলতে শিশুদের শারীরিক, মানসিক, আত্মিক ও সামাজিক সুস্থ বিকাশের জন্য মানবাধিকারের একটি অংশকে বোঝায়, যা তাদের সুরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন এবং নির্যাতন ও শোষণ থেকে মুক্তি লাভের নিশ্চয়তা দেয়। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ হলো এ অধিকারগুলোর মূল ভিত্তি, যা ১৯৮৯ সালে গৃহীত হয় এবং বাংলাদেশসহ প্রায় সব দেশই এতে স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করে।
ডিজিটাল শিশু বলতে সাধারণত সেই শিশুদের বোঝানো হয়, যারা জন্মের পর থেকেই ডিজিটাল প্রযুক্তি, যেমন মোবাইল, কম্পিউটার, ট্যাবলেট ইত্যাদিও সঙ্গে পরিচিত এবং এগুলো ব্যবহার করে বেড়ে উঠছে। এরা জন্মগতভাবেই প্রযুক্তিনির্ভর এবং ডিজিটাল যুগে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা ও ডিজিটাল মাধ্যমে বিভিন্ন দক্ষতা অর্জন করে থাকে। এদের মধ্যে ডিজিটাল আসক্তির ঝুঁঁকি থাকে এবং ডিজিটাল ডিভাইসের অতিরিক্ত ব্যবহার একটি সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে। ডিজিটাল শিশুর কিছু বৈশিষ্ট্য : ১. জন্ম থেকেই প্রযুক্তিনির্ভর : এরা ডিজিটাল ডিভাইস ও ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বেড়ে ওঠে, যা তাদের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়। ২. দ্রুত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারদর্শী- খুব অল্প বয়সেই এরা ডিজিটাল ডিভাইস যেমন মোবাইল, কম্পিউটার, ট্যাবলেট ইত্যাদি ব্যবহারে দক্ষ হয়ে ওঠে। ৩. ডিজিটালমাধ্যমে পড়াশোনা- বর্তমান সময়ে ডিজিটাল শিক্ষা ও ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহার করে শিশুরা পড়াশোনা করছে, যা তাদের শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও এতে আছে অনেক সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ, যেমন : ১. ডিজিটাল আসক্তি- শিশুদের মধ্যে ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ বা আসক্তি একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে। ২. অনলাইন নিরাপত্তা- ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে শিশুরা বিভিন্ন ঝুঁঁকির মুখে পড়ে, তাই তাদের অনলাইন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। ৩. শারীরিক ও মানসিক প্রভাব- ডিজিটাল ডিভাইসের অতিরিক্ত ব্যবহার শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তিনির্ভর এবং ডিজিটাল বিপ্লব সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে, তাই শিশুরাও এই পরিবর্তনের বাইরে নয়। আজকের শিশুদের বলা হয় ডিজিটাল শিশু- যারা জন্ম থেকেই প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত। এ প্রেক্ষাপটে শিশুদের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং শিশুরা যাতে প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিখতে পারে, সৃজনশীল হতে পারে এবং নিরাপদে ডিজিটাল জগতে বিচরণ করতে পারে, তার জন্য প্রাথমিক পর্যায় থেকেই তাদের তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। একজন শিশুর কৌতূহল তার শেখার বড় উৎস। যদি তাকে সঠিকভাবে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা দেওয়া হয়, তাহলে সে প্রযুক্তিকে উপভোগ করতে শেখে এবং সেটাকে শিখন প্রক্রিয়ার অংশ বানাতে পারে। যেমন অঙ্ক শেখার জন্য গেম, ভাষা শেখার জন্য ইন্টারঅ্যাকটিভ অ্যাপ, কিংবা প্রকৃতি বোঝার জন্য ইউটিউব ভিডিও-সবকিছুই শিশুর শেখার আগ্রহ বাড়ায়। এ প্রযুক্তিনির্ভর শেখার পদ্ধতি তাকে পাঠ্যবইয়ের বাইরে চিন্তা করতে শেখায়। শিশুকে যখন ডিজিটাল আর্ট অ্যাপ, লেগো রোবট, কোডিং গেম বা অ্যানিমেশন সফটওয়্যার শেখানো হয়, তখন তার সৃজনশীলতা ও বিশ্লেষণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। শিশুরা এসবের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খুঁজতে শেখে, যৌক্তিক চিন্তাভাবনা গড়ে তোলে এবং নিজে কিছু তৈরি করার আনন্দ উপভোগ করে। এ প্রক্রিয়ায় শিশু শুধু প্রযুক্তির ব্যবহারকারী হয় না, বরং প্রযুক্তিকে নিজের চিন্তা প্রকাশের হাতিয়ার বানায়। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৮০ ভাগ চাকরিতেই কম্পিউটার স্কিল অপরিহার্য। আগামী দিনে এ হার আরও বাড়বে। তাই প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা শিশুর ছোটবেলা থেকেই নিশ্চিত করা গেলে সে ভবিষ্যতে কোনো চাকরি বা কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকবে না। যারা শৈশবে তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শেখে তারা পরবর্তী সময়ে সহজেই প্রোগ্রামিং, রোবটিকস, ডিজিটাল কমিউনিকেশন, মাল্টিমিডিয়া কিংবা এআই টেকনোলজি আয়ত্ত করতে পারে। এভাবে স্মার্ট শিশু হিসেবে তারা নিজেকে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। প্রযুক্তি যতই দরকারি হোক তা যদি সঠিকভাবে শেখানো না হয় তাহলে বিপদ বাড়তে পারে। তাই ডিজিটাল লিটারেসি বা ডিজিটাল শিক্ষার পাশাপাশি অনলাইন নিরাপত্তা শিক্ষা দেওয়াও জরুরি। শিশুরা যেন ভুয়া ওয়েবসাইটে প্রবেশ না করে, ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার না করে এবং অনলাইন বুলিংয়ের শিকার না হয়- এসব বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। সে সঙ্গে তাদের শেখাতে হবে কীভাবে ভালো কনটেন্ট খুঁজে বের করতে হয়, কীভাবে গুগলে সঠিকভাবে অনুসন্ধান করতে হয় ইত্যাদি। তবু বিশ্বায়নের এ যুগে তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের মধ্যে অভিভাবকদের অন্যতম দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে ছেলেমেয়েদের মোবাইল ফোন, ট্যাব বা কম্পিউটার ব্যবহারে আসক্ত হওয়ার বিষয়টি, যা নিরসন হওয়া কাম্য। তাহলেই কেবল শিশুর অধিকার এবং ডিজিটাল শিশুর ভবিষ্যৎ মসৃণ হবে।
♦ লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়