সনাতন ধর্মের বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। প্রকৃতির গ্রহ-চক্রের বিধান মতে, শরৎকালে পূজার আয়োজন করতে হয় বলে এটাকে শারদোৎসবও বলা হয়। বাঙালি হিন্দুদের ঐতিহ্যের অঙ্গীকার দুর্গাপূজা আবহমানকাল থেকে গৌরবের জায়গা দখল করে আছে। পূজাকে ঘিরে যে উৎসব অনুষ্ঠিত হয় তা সার্বজনীন হয়ে উঠেছে। ধর্মীয় রীতিনীতি ও আচার হিন্দুদের হলেও উৎসবটি সবার জন্য উন্মুক্ত। পৌরাণিক কাহিনির আলোকে দুর্গাপূজার আধ্যাত্মিক ভাবটি রসমঞ্জুরি বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছে। সেজন্য পূজার আদ্যোপান্ত বা ইতিহাস তুলে না ধরে এর সাহিত্যিক মূল্য নিয়ে কিছু কথা বলা অপরিহার্য মনে করছি।
দুর্গাপূজা একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত উৎসব। এর কাহিনিতে শৈল্পিক গুণ উচ্চতর। সমকালীন সমাজ ও জীবনের প্রতিচ্ছবি এবং চিরন্তন আবেদনের মতো বিষয়গুলো দুর্গাপূজার কাহিনিতে বর্ণিত রয়েছে। আমার দৃষ্টিতে দুর্গাপূজা হচ্ছে- একটি অনুভূতি জীবন ও সামাজিক বাস্তবতাকে আধ্যাত্মিকভাবে বিকাশের পথ। এই পথ প্রশস্ত হয়েছে উৎসবের মাধ্যমে। সাহিত্যের যেমন ভাষা রয়েছে তেমনি পূজারও একটি ভাষা আছে। মাটির মূর্তির যে অলংকারিক কৌশল তা যেন বিশ^সৃষ্টিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ঐতিহাসিক এবং সামাজিক গুরুত্বকে অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে পূজা কাহিনি। সাহিত্যে যেমন চিরন্তন আবেদন রয়েছে, তেমনি দুর্গাপূজাতে চিরন্তন আবেদন বিদ্যমান। এ কথা নিশ্চয় স্বীকার্য যে, বাংলা সাহিত্য অনেকটা ধর্মীয় মাইথোলজিনির্ভর। যেমন- চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন, যার সাহিত্যিক মূল্য কেবল এর কাব্যসৌন্দর্য নয়; তৎকালীন সমাজচিত্রও চর্যাপদে চিত্রিত হয়েছে। চর্যাপদ সনাতনী নানা দেব-দেবীর মাহাত্ম্যকে প্রধান করে রচিত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ু চণ্ডীদাসের একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থটি রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনির ওপর রচিত। মধ্যযুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ এই গ্রন্থে প্রেমের রসবোধকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রেমই যে ধর্ম, তা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ঠিক দুর্গা দেবীও প্রেম ও ভালোবাসার অনবদ্য রূপ। দুষ্টে প্রেম থাকে না তাই দেবী দুর্গা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে আবির্ভূত হয়েছেন। ধরণিতে মনুষ্য সমাজের অসুর দমনে দুর্গা দেবী ১০ হাত দিয়ে যুদ্ধ করেছেন। যে অসুর তিনি বধ করেছেন সে অসুরও জীবন যাওয়ার প্রাক্কালে দেবীকে মা বলে ডেকেছে এবং নিজেকে সৌভাগ্যবান হিসেবে মনে করে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। জগতের প্রাণিকুল দেবীর চরণে ভক্তিভাবে লুটিয়ে পড়ে। এই মহাবিশ্বে অব্যক্ত ব্রহ্মবস্তু রয়েছে। মনের শুদ্ধতা না থাকলে ব্রহ্মবস্তু অনুভূত হয় না। এসব গবেষণার বিষয়। প্রকৃতির রহস্যে যে শক্তি বিদ্যমান সেই শক্তির আরাধনা হিসেবে সম্মুখে অবয়ব প্রয়োজন। বিশুদ্ধ জ্ঞানরূপের অনুষঙ্গ হিসেবেই দুর্গামূর্তিকে উপস্থাপন করা হয়। দুর্গাপ্রতিমা শক্তির প্রতিভূ। এই শক্তিকে নিয়ে বহুমাত্রিক সাহিত্য রচিত হয়েছে। এক মহতী পরিকল্পনার উৎস ধারায় দেবী দুর্গা দেদীপ্যমান। শক্তি ও প্রেমদায়িনী দেবীর স্বরূপ অনুসন্ধানে রচিত সাহিত্যকর্ম মানব হৃদয়ের উচ্চতর দ্বার খুলে দিয়েছে। সেজন্যই দুর্গাপূজাকে ঘিরে উৎসব মঞ্চস্থ হয়ে আসছে। যে উৎসবে সবাই নির্বিঘ্ন চিত্তে অংশগ্রহণ করে থাকে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মশাস্ত্র বেদ; বেদে বহু দেবতার কথা পাওয়া যায়। বিভিন্ন নামে ও পরিচয়ে এরা আরাধিত। বেদ হচ্ছে বৈদান্তিক দর্শনের রূপরেখা। যে দর্শনে কেবলই প্রেমময় জগতের বিচিত্র কথাকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যা মানুষের গণ্ডির দেয়াল টপকে রহস্যময় জগতের পথকে প্রশস্ত করেছে। দুর্গাপূজার কাহিনিও জীবনকে ছন্দময় করে শক্তির পথকে মসৃণ করেছে। বৈদিক দর্শনে উপাসনার কথাও রয়েছে। এই উপাসনায় শক্তির আরাধনাই প্রধান হিসেবে বর্ণিত। প্রাচীনকাল থেকেই শক্তির আরাধনা চলে আসছে। বৈদিক শাস্ত্রে যেমন শক্তির আরাধনা, তেমনি তন্ত্রে বা আগমশাস্ত্রে শক্তির উপাসনার প্রাধান্য লক্ষণীয়। শক্তি সাধনার এই ধারাটি তন্ত্রে পরিব্যপ্ত। অতি প্রাচীনকালে বৈদিক ঋষিপুরুষরা শক্তিকে প্রত্যক্ষ করেছেন প্রকৃতির নানা বিষয়ের মধ্যে। বড় বড় গাছ, পাহাড়-পর্বত, গিরিশৃঙ্গ প্রকৃতির এসব বিভিন্ন স্থাপনায় শক্তির আরাধনা করে নিজেরাই শক্তিমান হয়েছেন। তান্ত্রিক সাধকরা প্রকৃতি সাধনা করেই ঈশ^রের স্বরূপ দর্শন করেছেন। সাধনা করতে করতে নিজের মধ্যেই মহাশক্তির স্বরূপ রূপে প্রত্যক্ষ করেছেন। অন্যদিকে সনাতন ধর্মাবলম্বী সাধারণ মানুষ সমাজ জীবনের গতি ধারায় নিজেদের সম্পৃক্ত করে বিভিন্ন মূর্তিপূজার মাধ্যমে বিশেষ সময়ে শক্তির সাধনা করে থাকে তার প্রধান একটি হচ্ছে দুর্গাপূজা।
লেখক : কলাম লেখক