নবী-রসুল-সাহাবিদের পরে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত ওলামায়ে কেরাম। বিশেষ করে যারা কিতাবের এলেমের অধিকারী। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাসী এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের উচ্চমর্যাদা দান করবেন।’ (সুরা মুজাদালাহ, আয়াত ১১) কিতাবের এলেমের কারণে একজন মানুষের মর্যাদা কত ওপরে উঠে এ সম্পর্কে ইমাম ইবনে কাসির (রহ.) মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদের সূত্রে একটি চমৎকার হাদিস বর্ণনা করেছেন। হাদিসটি এরকম- ওমর (রা.) তার খেলাফতের সময় প্রখ্যাত কারি নাফে ইবনে হারেসকে (রহ.) মক্কার প্রশাসক নিযুক্ত করেছিলেন। একদিন মক্কার বাইরে আসফান নামক জায়গায় নাফের সঙ্গে খলিফা ওমরের সাক্ষাৎ হয়। ওমর (রা.) প্রথমেই জানতে চাইলেন মক্কাবাসীকে কার দায়িত্বে রেখে আসা হয়েছে? নাফে (রহ.) বললেন, ‘ইবনে ইবজিকে (রহ.) মক্কার ভারপ্রাপ্ত প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’ এ কথা শুনে খলিফা বললেন, ‘সে তো এক সময় আমার গোলাম ছিল। একজন গোলামের মাঝে তুমি এমন কী বৈশিষ্ট্য দেখলে যে তাকে মক্কার প্রশাসকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিযুক্ত করলে?’ জবাবাবে নাফে বললেন, ‘আমি দেখেছি ইবনে ইবজি কোরআনের সংরক্ষক, ফারায়েজের আলেম এবং মানুষকে দরদি ভাষায় নসিহত করতে পারে।’ এ কথা শুনে ওমর (রা.) পুরোপুরি আশ্বস্ত হলেন এবং বললেন, ‘নাফে! তুমি সত্য বলেছ। আমি নবীজি (সা.)-এর কাছে শুনেছি, কোরআনের কারণে আল্লাহ এক জাতিকে সম্মানিত করবেন আবার এ কোরআনের কারণেই এক জাতিকে লাঞ্ছিত করবেন।’ (ইবনে কাসির, ১৭ খণ্ড, ৩৭৩ পৃষ্ঠা।)
কিতাবের এলেম দু-ধারী তলোয়ারের মতো। এর দুই দিকই তীক্ষ্ণ ধারালো। কেউ যদি কিতাব মেনে চলে তাহলে সে সম্মানিত হবে। আবার কেউ যদি কিতাবের এলেম অর্জনের পর সে এলেম অনুযারী আমল না করে তাহলে তার জন্য জাহান্নামের সর্বশেষ স্তর নির্ধারিত রয়েছে। এ কারণে সুফিয়ায়ে কেরাম বলেন, নবী-রসুলদের পর আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত ওলামায়ে কেরাম। আবার সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাও দিতে হয় আলেম সমাজকে। আলেমরা যে পরীক্ষার সম্মুখীন হয় সবচেয়ে বেশি সে পরীক্ষার নাম হলো ইখলাসের পরীক্ষা। এ পরীক্ষাটি এত কঠিন যে কেউ যদি আলেম হওয়ার সুবাদে আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া দুনিয়ার কোনো সুবিধা বা প্রতিপত্তি অর্জন করতে চায় তাহলেও আল্লাহ তাকে পাকড়াও করবেন। শুধু তা-ই নয়, কারও নিয়ত যদি থাকে আলেম হওয়ার কারণে মানুষ আমাকে সম্মান করবে, সুনাম করবে, সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে এসব দুনিয়াবি উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে হাদিসে ওই আলেমের শেষ পরিণাম জাহান্নাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রখ্যাত সুফি ফকিহ আবু লাইস সমরকন্দি (রহ.) তার তাম্বিহুল গাফেলিন কিতাবে আবদুল্লাহ বিন খুবাইক আনতাকির (রহ.) একটি বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। খুবাইক আনতাকি বলেন, ‘কেয়ামতের দিন যখন একশ্রেণির আলেম আল্লাহর কাছে প্রতিদান চাইবে তখন আল্লাহ বলবেন, ‘আমি কি তোমাকে আলেম হওয়ার কারণে দুনিয়াতেই প্রতিদান দিইনি? তুমি চেয়েছো মানুষ তোমাকে বড় আলেম বলবে, তোমার জন্য মজলিসে আলাদা আসন রাখবে, স্টেজে জায়গা রাখবে, সমাজের নেতৃত্ব তোমার হাতে থাকবে, আলেম হওয়ার কারণে কেনাবেচায় তোমার থেকে দাম কম রাখা হবে- এ সবই তোমার প্রতিদান, যা তুমি দুনিয়াতেই পেয়ে গেছো। আখেরাতে তোমার কোনো প্রতিদান নেই।’ (তাম্বিহুল গাফেলিন, ১ম খণ্ড, ৪৭ পৃষ্ঠা।)
আলেমদের জন্য সবচেয়ে ভয় ধরানো হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরিফে। হাদিসটি আরও বিশদভাবে তিরমিজি ও নাসায়িতেও এসেছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা যখন বিচারকের আসনে বসবেন সর্বপ্রথম তিনি একজন কোরআনের আলেম, একজন শহীদ ও একজন দানবীরকে ডাকবেন। কোরআনের আলেমকে জিজ্ঞেস করবেন, দুনিয়ায় তুমি আমার জন্য কী করেছ? জবাবে আলেম বলবে, ওগো আল্লাহ! আমি জীবনভর কোরআনের ওপর চলেছি। মানুষকে কোরআন শুনিয়েছি, নিজে কোরআন পড়েছি। কোরআনের বাইরে একচুলও নড়িনি। এসব শুনে আল্লাহ ধমকের সুরে বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। দুনিয়ায় তুমি কোরআন চর্চা করেছো মানুষ তোমাকে বড় আলেম বলবে, তোমার সুনাম-সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে, সাধারণ মানুষের চেয়ে তোমাকে আলাদা করে মূল্যায়ন করা হবে এসব নিয়তে। তোমার উদ্দেশ্য দুনিয়াতেই পূরণ হয়েছে। আজ জাহান্নাম ছাড়া আমার কাছে তোমার কোনো প্রতিদান নেই। (মুসলিম, ১৯০৫, তিরমিজি, ২৩৮২, নাসায়ি, ৩১৩৭।)
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর