ক্যানসার আক্রান্ত ময়মনসিংহের ত্রিশালের সায়েরা বেগম (৫৫)। মাকে নিয়ে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এসেছিলেন রুমানা (৩৫)। তিনি বলেন, ‘মায়ের ক্যানসার শনাক্ত হওয়ার পর থেকে চিকিৎসা খরচ, ওষুধপত্র, যাতায়াতের খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছি। বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসারই চলে না। চিকিৎসক এমআরআই করাতে বলেছেন। কিন্তু এ হাসপাতালে এমআরআই মেশিন নষ্ট থাকায় অন্য জায়গা থেকে টেস্ট করাতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালে কয়েক গুণ বেশি টাকা দিয়ে টেস্ট করানোর সামর্থ্য আমাদের নাই।’
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে যন্ত্র নষ্ট থাকায় পাঁচ বছর ধরে এমআরআই পরীক্ষা বন্ধ আছে। কিছুদিন আগে নষ্ট হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এমআরআই মেশিনটিও। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে এক দশক ধরে অকেজো পড়ে আছে প্রায় ১১ কোটি টাকার ল্যাসিক মেশিন। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বাক্সবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে বেশ কিছু যন্ত্র। শুধু ঢাকা নয়, বরিশাল, সাতক্ষীরাসহ বেশ কিছু জায়গায় যন্ত্র নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। রাজশাহীতে পুরো হাসপাতালই অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্ট করাতে গিয়ে রোগী ও স্বজনদের গুনতে হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি টাকা। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, মেরামতের অভাবে পাঁচ বছর ধরে পড়ে আছে চীন থেকে উপহার পাওয়া এমআরআই মেশিন। এতে বাড়ছে ক্যানসার হাসপাতালে আসা রোগীদের ভোগান্তি। এর আগে নষ্ট হয়ে পড়ে ছিল সিটিস্ক্যান মেশিন। সম্প্রতি মেশিন মেরামত হলেও ফিল্মসংকটের কারণে খুব অল্প পরিমাণে টেস্ট হচ্ছে। ফলে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে টেস্ট করানোর জন্য। এতে ক্যানসার আক্রান্ত কিংবা উপসর্গ আছে এমন রোগীদের অবস্থার আরও অবনতি হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে একটি এমআরআই মেশিন নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ফলে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের প্রয়োজনীয় এমআরআই পরীক্ষা করানোর জন্য বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হচ্ছে। ভর্তি থাকা গুরুতর রোগীদেরও যেতে হচ্ছে বাইরে। ঢামেক হাসপাতালে এমআরআই করাতে খরচ হয় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু বাইরের প্রতিষ্ঠানে লাগে ৬ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা। জনি হোসেন নামে এক রোগী বলেন, ‘আমার পায়ের এমআরআই করাতে বলেছেন চিকিৎসক। কম খরচের জন্য সরকারি হাসপাতালে এসেছি। কিন্তু মেশিন নষ্ট থাকায় ফিরে যেতে হয়েছে। গত সপ্তাহেও একবার এসে ফিরে গেছি। এখন বাইরে থেকে দ্বিগুণ টাকায় টেস্ট করাতে হবে।’ ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘হাসপাতালের এমআরআই যন্ত্র নষ্ট হয়েছে। এটা মেরামতের বিষয়ে ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারে জানানো হয়েছে। এটার মেরামত খরচ অনেক বেশি হওয়ায় অন্য হাসপাতালের বন্ধ মেশিন থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্র এনে দ্রুত সচল করার চেষ্টা হচ্ছে। রোগীর সেবা নিশ্চিতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’
পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে ২০১৫ সাল থেকে অকেজো পড়ে আছে প্রায় ১১ কোটি টাকার ল্যাসিক মেশিন। এতে চোখের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। পুরোপুরি নষ্ট হওয়া থেকে মেশিনটি বাঁচাতে দুটি শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র পরিচালনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে পরিশোধ করতে হচ্ছে হাজার হাজার টাকার বিদ্যুৎ বিল।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে দুই-আড়াই বছর ধরে বন্ধ হৃদরোগীদের জরুরি পিটি আইএনআর, এপিটিটিসহ কয়েকটি টেস্ট। অথচ হাসপাতালের স্টোরে ওইসব টেস্টের নতুন মেশিন বাক্সবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে।
বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের এনজিওগ্রামের একটি যন্ত্র, ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসার কোবাল্ট-৬০ যন্ত্র নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এমআরআই মেশিন ২০১৮ সালের পর থেকে অকেজো পড়ে আছে। ছয় বছর ধরে অকেজো পড়ে আছে অত্যাধুনিক ল্যাসিক যন্ত্রটিও। এ তো গেল যন্ত্র নষ্টের কথা, রাজশাহীতে পুরো হাসপাতালই অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। রাজশাহী মহানগরীর সিপাইপাড়ায় রাজশাহী সদর হাসপাতাল। একসময় হাসপাতালটি ছিল রাজশাহী ও আশপাশ জেলার রোগীদের অন্যতম ভরসার জায়গা। কিন্তু শত বছরের পুরোনো ভবনে হাসপাতালটি আর চলছিল না। দেড় যুগ বন্ধই পড়ে ছিল। ২০২১ সালে জেলায় অতিরিক্ত করোনা রোগীর চাপে বন্ধ হাসপাতালটি ফের চালুর কথা ভাবা হয়। ৬ কোটি টাকার বেশি খরচ করে হয় সংস্কার। সে কাজ শেষ হয় গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। তবু এক বছর ধরে অব্যবহৃত পড়ে আছে হাসপাতালটি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উত্তর-পশ্চিম কোণে টিবি হাসপাতালের কাছে দুই বছর আগে ২০০ বেডের একটি শিশু হাসপাতাল নির্মাণ করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হলেও ঝকঝকে তকতকে ওই ভবনটি এখনো তালাবদ্ধ। এ ব্যাপারে রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. এস আই এম রাজিউল করিম জানান, ‘বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল নির্মাণে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা ব্যয় হলেও দুই বছরেও চালু হয়নি সেবা। মন্ত্রণালয়কে জানানোর পরও কোনো নির্দেশনা না পাওয়ায় হাসপাতালটি চালু করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া ২ কোটি টাকা ব্যয় করে সদর হাসপাতালের সংস্কার করা হলেও চালু করা হয়নি মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা, জনবলের অভাবে।’ [প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী ও বরিশাল]