আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে আখ্যায়িত করে নির্বাচন সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর করতে সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষ ভূমিকা কামনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
গতকাল ঢাকার সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, নির্বাচন নির্বিঘ্ন ও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা যথাযথ পেশাদারি ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের সশস্ত্র বাহিনীর অবদান স্মরণ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী জাতি গঠনে এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করে আসছে। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং চলমান রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় সশস্ত্র বাহিনী সব সময়ের মতোই জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে নাগরিকদের আস্থার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী গণতান্ত্রিক ও শৃঙ্খলাপূর্ণ নেতৃত্বের প্রতি অনুগত থেকে তাদের পেশাগত দক্ষতা এবং দেশপ্রেমের সমন্বয়ে দেশের জন্য এই ত্যাগ ও কর্মপ্রবাহের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে।
বক্তৃতার শুরুতে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদ, আহত ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। পাশাপাশি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শহীদ, আহত ও অংশগ্রহণকারীদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানান। এ ছাড়া গতকাল দেশের বিভিন্ন জেলায় শক্তিশালী ভূমিকম্পে ভবন ধসে পড়ে হতাহতদের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেন।
১৯৭১ সালে যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী কীভাবে গঠিত হয়েছিল তা স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ২১ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলে যৌথ অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী- যা এখন প্রতি বছর সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। ২১ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের এক গৌরবময় মাইলফলক হিসেবে পালিত হয়। যদি বিজয় অর্জিত না হতো, তবে এসব বীর সেনা নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হতেন এবং তাদের পরিবারকে অসহনীয় কষ্ট সহ্য করতে হতো।
তিনি বর্ণনা করেন, কীভাবে বাংলাদেশের বাহিনীকে ১১টি সেক্টরে সংগঠিত করা হয়েছিল এবং কীভাবে এসব সেক্টর থেকে দেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক ও গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল- যার পরিণতিতে ২১ নভেম্বর ঐতিহাসিক যৌথ অভিযান শুরু হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
এর আগে সকালে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর বীর শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি ঢাকা সেনানিবাসের শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকারী সশস্ত্র বাহিনীর বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর একটি চৌকশ দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। পাশাপাশি বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। এরপর স্মৃতিস্তম্ভের ভিজিটর বইতে স্বাক্ষর করেন তিনি।
এর আগে শিখা অনির্বাণে পৌঁছালে প্রধান উপদেষ্টাকে স্বাগত জানান তিন বাহিনীর প্রধান এবং সশস্ত্র বাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তারা। সকালে ঢাকার সেনানিবাসে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দেওয়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা বীর জনগণের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন অনুযায়ী একটি বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনে অঙ্গীকারবদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা যে স্বপ্ন নিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন- একটি বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত, জনকল্যাণমুখী ও স্বাধীন রাষ্ট্র- আমরা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বলেন, এখন থেকে আমরা বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়ে তুলতে চাই, যাতে এই দেশের জনগণই যেন সব ক্ষমতার উৎস হয়ে ওঠে এবং বাংলাদেশ মানবিক ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের কাছে স্বীকৃতি পায়।
সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে গতকাল সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে ‘সেনাবাহিনী পদক’ প্রদান করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এ ছাড়া ঢাকা সেনানিবাসে বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস ‘ট্রেনিং কমপেনডিয়াম’ এর মোড়ক উন্মোচন করেন।
দিবসটি উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। কর্মসূচির শুরুতে দেশের সব সেনানিবাস, নৌঘাঁটি ও স্থাপনা এবং বিমানবাহিনী ঘাঁটির মসজিদসমূহে দেশের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি, সশস্ত্র বাহিনীর উত্তরোত্তর উন্নতি ও অগ্রগতি এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সশস্ত্র বাহিনীর শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে ফজরের নামাজ শেষে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সশস্ত্র বাহিনীর শহীদ সদস্যদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সকালে ঢাকা সেনানিবাসের শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকশ দল গার্ড অব অনার প্রদান করেন। পুষ্পস্তবক অর্পণকালে শহীদদের স্মরণে বিউগলে করুণ সুর বাজানো হয়। পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা শিখা অনির্বাণে রক্ষিত পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন। এর আগে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান উপদেষ্টা শিখা অনির্বাণে এসে পৌঁছালে তিন বাহিনী প্রধান এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার তাঁদের স্বাগত জানান।
মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের স্মরণে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন নিজ নিজ বাহিনীর পক্ষ থেকে সম্মিলিতভাবে শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণের পর প্রধান উপদেষ্টা সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে গমন করেন।
সেখানে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান এবং মহাপরিচালকবৃন্দ। সেনাবাহিনী প্রধান, নৌবাহিনী প্রধান ও বিমানবাহিনী প্রধান সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
