রক্ত পাতলা রাখার ওষুধেই হয়তো বাঁচবে জীবন। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সে রকমই মনে করছেন কোভিড চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের চিকিৎসকরা।
অনেক কোভিড রোগীরই পা নীল হয়ে ফুলে যায়। ডিপ ভেন থ্রম্বোসিসের শিকার হন তারা। শরীরের গভীর ভাগের শিরায় রক্তের ডেলা জমে পায়ে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হলে প্রাথমিক পর্যায়ে যে সমস্যা হয়। জটিল রোগ আছে এমন রোগীদের, যাদের ওজন বেশি, হাই প্রেশার-ডায়াবিটিস বা হৃদরোগ আছে, তাদের এমন হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। ফলে তাদের নিয়মমাফিক রক্ত পাতলা রাখার ওষুধ দেয়া হয়। এমনকি এটি এতো মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছায় যে, রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে পচন ধরায় ৪১ বছর বয়সী কোভিড রোগী অভিনেতা নিক করডেরোর ডান পা কেটে বাদ দিতে হয়।
কোভিড রোগীদের কিডনির কার্যকারিতাও কমে যেতে পারে। চীনে হওয়া এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, আইসিইউতে ভর্তি শতকরা পাঁচজন জটিল কোভিড রোগীর এমন হয়। ফলে রক্তের দূষিত পদার্থ বার করতে তাদের ডায়ালিসিস করতে হয়। একটি টিউব দিয়ে দূষিত রক্ত যায় মেশিনে, তার পর শুদ্ধ হয়ে আবার ফিরে আসে শরীরে।
বিজ্ঞানীরা দেখলেন, কিছু রোগীর ক্ষেত্রে খুব ছোট ছোট রক্তের ডেলা জমে টিউবে রক্ত চলাচল থেকে থেকেই আটকে যাচ্ছে।
নিউমোনিয়ার অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বা অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোমে মৃত কোভিড রোগীদের ময়নাতদন্তে দেখা যায়, তাদের অনেকেরই ফুসফুসে নিউমোনিয়ার চিহ্ন নেই। তার বদলে রয়েছে ছোট ছোট রক্তের ডেলা।
ফিলাডেলফিয়ার নিউরোসার্জেন পাস্কাল জাব্বরের মতে, এই রক্ত জমাট বাঁধার কারণে কোভিডে আক্রান্ত বহু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। মস্তিষ্কে জমা রক্তের ডেলা গলিয়ে দেয়ার পরেও তাদের অনেককেই বাঁচানো যায়নি।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন অনেক হার্টের রোগীরই ধমনীতে জমা রক্তের ডেলা গলানো হয়েছে, অন্যান্য চিকিৎসাও হয়েছে। তবু শেষ রক্ষা হয়নি। পরে দেখা গেছে, তারা কোভিড আক্রান্ত ছিলেন।
‘ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো অ্যান্সচুটস মেডিক্যাল ক্যাম্পাস’-এর আইসিইউ-তে ভর্তি কোভিড রোগীদের অবস্থার পর্যালোচনা করে ট্রান্সপ্লান্ট সার্জেন হান্টার মূর এক সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন, এদের শরীরে জমা রক্তের ডেলাগুলো এমন যে ওষুধ দিলেও চট করে গলছে না। ফলে প্রায় ৩০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে কিছু ডেলা মস্তিষ্কে চলে যাচ্ছে। প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে ফুসফুসে গিয়ে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে রক্ত সঞ্চালনে।
১০ এপ্রিল ‘থ্রম্বোসিস রিসার্চ জার্নাল’-এ প্রকাশিত হয় ডাচ বিজ্ঞানীদের গবেষণা। তাতে জানা যায়, ১৮৪ জন আইসিইউ-তে ভর্তি রোগীর মধ্যে কম করে ৩৮ শতাংশর শরীরে অস্বাভাবিক হারে রক্তের ডেলা জমছে।
চীনের খবর অনুযায়ী, ১৮৩ জন রোগীর মধ্যে যত জন মারা গেছেন তাদের ৭০ শতাংশের শরীরের বিভিন্ন রক্তনালী ও প্রত্যঙ্গে পাওয়া গেছে অগণিতক রক্তের ডেলা।
কীভাবে শুরু পরীক্ষা-নিরীক্ষা?
দিনে দিনে দেশ-বিদেশের এমন রোগীর খবর আসতে শুরু করল যাদের রোগ খুব মৃদু পর্যায় ছিল। তাদের নিয়ে আলাদা করে চিন্তা করার প্রয়োজনও পড়েনি। আচমকা শ্বাসকষ্ট হওয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসার পথে মারা গেছেন রোগী। আবার এমন অনেক রোগীর সন্ধান মিলেছে যাদের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা এতো কম যে তাদের মৃতপ্রায় অবস্থা হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি কথাবার্তা বলছেন। পর মুহূর্তেই অবস্থা এতোই অবনতি হয়েছে যে তাকে বাঁচানো যায়নি। দেখা গেছে, তাদের ধমনী ও মস্তিষ্কে রক্তের ডেলা মিলেছে।
এর পরেই কোন ধরনের রক্ত পাতলা করার ওষুধ দিয়ে এমন কোভিড রোগীদের চিকিৎসা করলে সবচেয়ে ভালো ফল হবে তা নিয়ে শুরু হয় ভাবনা-চিন্তা। এর মধ্যে দেখা গেল, আইসিইউতে ভর্তি থাকা রোগীদের ডায়ালিসিস করার সময় যে ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়, কোভিড রোগীদের সে সব দিয়ে ডায়ালিসিস করেও খুব একটা ভাল কাজ হচ্ছে না।
রক্ত পাতলা করার ওষুধ পড়লে এই সমস্যা মিটতে পারে ধরে নিয়েই গবেষকরা শুকু করলেন ক্লিনিকাল ট্রায়াল।
‘ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়া’-র একদল গবেষক রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ অ্যাডাম কুকারের তত্ত্বাবধানে হেপারিন নামের ওষুধ নিয়ে কাজ শুরু করলেন। বিভিন্ন রোগীকে বিভিন্ন মাত্রায় প্রয়োগ করে বুঝতে লাগলেন তার কার্যকারিতা। আর একদল গবেষক কাজ শুরু করলেন গবেষক ক্রিস্টোফার ব্যারেটের তত্ত্বাবধানে টিস্যু প্লাসমিনোজেন অ্যাকটিভেটর বা ‘টিপিএ’ নামের ওষুধ নিয়ে। এই দুই ওষুধ ব্যবহার করলে ব্যবহার করে স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত রোগীর মস্তিষ্কে ও হার্টে জমা রক্তের ডেলা গলানো যায়।
কিন্তু করোনাভাইরাসের মতো ভাইরাস, যাকে আগাগোড়া ‘ফ্লু ভাইরাস’-ই ভেবে এসেছেন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা, তার প্রভাবে রক্তে কেন এত পরিবর্তন হচ্ছে?
কেন জমছে রক্তের ডেলা?
ক্র্যাটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ সৌতিক পান্ডা জানিয়েছেন, মূলত দু’টি কারণে এমন হতে পারে। প্রথমত, সাইটোকাইন স্টর্ম। শরীরে যখন প্রবল পরাক্রমী কোনও বহিরাগত বস্তু আক্রমণ করে তখন শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা অতি সক্রিয় হয়ে সাইটোকাইন নামে একগুচ্ছ রাসায়নিকের ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। এর মধ্যে এমন কিছু রাসায়নিক আছে, যেমন ইন্টারলিউকিন ১, ৬ ও ৮ এবং টিএনএফ-আলফা, যারা প্রবল প্রদাহ ঘটায় শরীরে। যত বেশি প্রদাহ হয়, তত বাড়ে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা। একে বলে ডিসিমিনেটেড ইন্ট্রাভ্যাসকুলার কোঅ্যাগুলেশন, সহজ কথায় ‘ডিআইসি’। এর প্রভাবেই শরীরের ছোট-বড় সব রক্তবাহী নালীতে জমতে শুরু করে রক্তের ডেলা।
দ্বিতীয় যে কারণটি এর নেপথ্যে থাকতে পারে, তাকে বলে হিমোস্ট্যাটিক ডিরেঞ্জমেন্ট। ধরা যাক, শরীরের কোথাও চোট লেগেছে, শরীর তখন রক্ত জমাট বাঁধার উপকরণ সেখানে পাঠিয়ে রক্ত বন্ধ করে। শরীরে বড় আঘাত বা সংক্রমণ হলে শরীর দিশেহারা হয়ে যায়। ফলে যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানেও পাঠাতে থাকে রক্ত জমাট বাঁধার উপকরণ। অর্থাৎ রক্ত জমাট বাঁধা ও পাতলা থাকার মধ্যেকার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।
তা হলে উপায়?
বিজ্ঞানীদের মতে, রক্ত পাতলা রাখার ওষুধই এ ক্ষেত্রে সম্বল। ডিআইসি-র কারণে শরীরের সব প্রত্যঙ্গর একে একে অকার্যকর হয়ে যাওয়ার প্রবণতা পুরোপুরি ঠেকানো গেলে কোভিড রোগীর মৃত্যুর হার অনেক কমে যাবে। তখন অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ না দিলেও শরীরের প্রতিরোধী ব্যবস্থাই ভাইরাসকে নির্মূল করতে পারবে। সূত্র: আনন্দবাজার
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত