প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেছেন, মানুষ খুন করে সরকার পতন, এটা কবে হয়, কখন হয়। সাধারণ মানুষ কী দোষ করেছে। তিনি স্বজনদের উদ্দেশে বলেন, আমি কী বলে আপনাদের সান্ত¡না দেব। আমি শুধু বলব, আমি আপনাদের মতোই একজন! বাবা-মা-ভাই হারানো এতিম। কাজেই আপনাদের কষ্ট আমি বুঝি। আমি আছি আপনাদের জন্য, আপনাদের পাশে। আমার চেষ্টা থাকবে, যারা এ খুনের সঙ্গে জড়িত, খুঁজে বের করে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা। গতকাল দুপুরে গণভবনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিহতদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানকালে তিনি এ কথা বলেন। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিহত ৩৪ জনের পরিবার গণভবনে আসেন। প্রধানমন্ত্রী ৩৪ জনের পরিবারের সদস্যদের হাতে আর্থিক সহায়তা হিসেবে পারিবারিক সঞ্চয়পত্র এবং নগদ অর্থ তুলে দেন।
প্রধানমন্ত্রী নিহত ব্যক্তিদের পরিবার-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের খোঁজখবর নেন। অনেকে প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় আবেগাপ্লুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও অশ্রুসজল হতে দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রী তাদের সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় অশ্রুসজল প্রধানমন্ত্রী তাদের সান্ত¡না দিয়ে বলেন, আমি আপনাদের বেদনা বুঝি। আমাকে প্রতিনিয়ত বাপ-মা-ভাই হারানোর বেদনা নিয়ে চলতে হয়। বাপ-মায়ের লাশটাও দেখতে পারিনি, দেশে ফিরতে পারিনি। ছয় বছর পর দেশে এসেছি। তারপর যখন এসেছি সারা দেশ ঘুরেছি। কারণ আমার বাবা বলত, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে হবে। আমি সেই কাজটাই করার চেষ্টা করছি। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে হত্যাকান্ডে জড়িতদের বিচারের আশ্বাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সেক্ষেত্রে আপনাদেরও সাহায্য চাই। যদি আপনারা কিছু জানেন, আমাদের জানাবেন। এভাবে বারবার বাংলাদেশকে নিয়ে খেলা, এটা আর হতে দেওয়া যায় না। এ সময় নিজের স্বজন হারানোর কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এটুকু মনে করবেন, আপনারা আপনজন হারিয়েছেন, আপনারা একটা শোক সইতে পারেন না। আর আমি কী শোক সয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি, শুধু এ দেশের মানুষের জন্য। আন্দোলনকে ঘিরে দেশের সম্পদ বিনষ্টের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যা কিছু করি, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়, এটা তো কোনোদিনই গ্রহণযোগ্য নয়। সাধারণ মানুষই তো এসবের সুবিধা পেত। মেট্রোরেলে কারা চড়ত, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে কারা চড়ে। মানুষের কাজ করাই আমার কাজ। সবাইকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনাদের শুধু বলব, আপনারা সবুর করেন। আর আল্লাহকে ডাকেন, যেন এসব খুনি জালেমের হাত থেকে যেন আমাদের দেশ রেহাই পায়। আমি আপনাদের পাশে আছি। আপনাদের চোখের পানি দেখতে হচ্ছে, এটাই বড় কষ্ট। স্বজনহারার ব্যথা ভোলার নয়, সেটাই আমি জানি। আল্লাহ আপনাদের সবর দেন, সেটাই আমি চাই। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতে নিহত স্বজনদের কাছে সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, আপনাদেরও সাহায্য চাই। যদি আপনারা কিছু জানেন আমাদের জানাবেন। কারণ, এভাবে বারবার বাংলাদেশটাকে নিয়ে খেলা এটা আর হতে দেওয়া যায় না। কাজেই আমি আপনাদেরই সাহায্য চাই। সরকারপ্রধান বলেন, মানুষ মেরে লাশ ঝুলিয়ে রাখার মতো এ বর্বরতা, জানোয়ারের মতো ব্যবহার এটা কি কেউ করতে পারে। একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানের লাশ ঝুলিয়ে রাখবে পা বেঁধে! যারা এগুলোর সঙ্গে জড়িত অবশ্যই তাদের বিচার হবে। তাদের বিচার করা না হলে মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া যাবে না। মানুষ কী দোষ করল যে এভাবে মানুষ খুন করতে হবে! মানুষ খুন করে সরকার পতন এটা কবে হয়, কখন হয়। সাধারণ মানুষ কী দোষ করেছে। স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যদের শেখ হাসিনা বলেন, আপনাদের কাছে শুধু এ টুকু বলব, আপনারা সবর করেন। আর আল্লাহকে ডাকেন যেন এসব খুনি-জালেম এদের হাত থেকে আমাদের দেশটা যেন রেহাই পায়। আল্লাহর কাছে আমি চাই আল্লাহ আপনাদের সবর দিক। স্বজন হারানোর ব্যথা ভোলার না, সেটা আমি জানি। তারপরও আল্লাহ আপনাদের সবর দিক, সেটা আমি চাই। শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করেন যেন এর একটা বিহিত করা যেতে পারে। সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিহতদের পরিবার ও আহতদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যতক্ষণ বেঁচে আছি আপনাদের পাশে আছি। আমি আসলে আপনাদের কী বলে সান্ত¡না দেব? শুধু এটুকু বলব যে, আমি আপনাদের মতোই একজন। বাবা-মা, ভাই হারানো সেই এতিম। কাজেই আপনাদের কষ্ট আমি বুঝি। আমি আছি আপনাদের জন্য, আপনাদের পাশে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বজন হারানোর কথা স্মৃতিচারণা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনাদের সান্ত¡না দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। আমি তো বুঝি আপনাদের বেদনা। প্রতিনিয়ত বাপ-মা-ভাই-বোনদের হারানোর ব্যথা নিয়ে আমাদের চলতে হয়। এমনকি লাশটাও তো দেখতে পারিনি, কাফন-দাফনটাও করতে পারিনি। দেশেও ফিরতে পারিনি, ছয় বছর আসতে দেয়নি আমাকে। তিনি বলেন, যখন (দেশে) এসেছি, সারা বাংলাদেশ ঘুরছি। আমার বাবা বলতেন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাব। আমি সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটাবে, এ সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটাবে এটা তো কাম্য নয়।
ভুক্তভোগীরা গণভবনে আসায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সরকারপ্রধান বলেন, সবাই এসেছেন কষ্ট করে, দুঃসময়ে। আজকে যদি ভালো সময় হতো কত হাসিখুশি করে সবাই যেতে পারতেন। আর এখন আমারও আপনাদের চোখের পানি দেখতে হচ্ছে। এটিই সবচেয়ে কষ্ট। বক্তব্যের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বার বার আবেগাপ্লুত হতে দেখা যায়। এ সময় গণভবনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও) সচিব মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
ছদ্মবেশে কোটা আন্দোলনে প্রবেশ করেছিল জামায়াত-শিবির সন্ত্রাসীরা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা প্রাথমিকভাবে লো প্রোফাইল বজায় রেখে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ছদ্মবেশে সেখানে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু পরে তারা বিপজ্জনকভাবে আন্দোলনের সামনের সারিতে চলে আসে। বাংলাদেশে নিযুক্ত স্পেনের রাষ্ট্রদূত গ্যাব্রিয়েল মারিয়া সিসতিয়াগা ওচহোয়া ডি চিনচিক্রু গতকাল সকালে গণভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, সন্ত্রাসীরা আসলে সেই স্থাপনাগুলোতে হামলা করেছে যা জনগণের কল্যাণে কাজ করার পর সরকার যে সাফল্য অর্জন করেছে তা তুলে ধরছে। তিনি কভিড হাসপাতাল, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে, সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন এবং ডেটা সেন্টারের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমাদের সব উন্নয়নের প্রতীক যা জনগণকে স্বাচ্ছন্দ্য ও সুবিধা দিয়েছিল সেগুলো ধ্বংসের শিকার। সেনা মোতায়েনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেনাবাহিনীর সদস্যরা এ পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ধৈর্য দেখিয়েছেন।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, তার দল আওয়ামী লীগের প্রায় ২১ জন এ সহিংসতায় নিহত হয়েছেন। দলমতনির্বিশেষে তিনি নিহত বা আহত সবাইকে সাহায্য করা প্রসঙ্গে বলেন, আমি তাদের সাহায্য করার সময় দলীয় পরিচয় বিবেচনা করিনি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দাবির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা আন্দোলনের গতির শীর্ষে থাকতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের স্থিতাবস্থার কারণে দেশে কোটার অস্তিত্ব ছিল না। তখন তাদের দাবির যৌক্তিক ভিত্তি কী হবে? শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, সরকার মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের বেঁচে থাকা ও জীবিকা নির্বাহের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং আহত ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তা ও তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে। প্রেস সচিব জানান, স্পেনের রাষ্ট্রদূত শান্তি ও সমৃদ্ধির স্বার্থে সেনা মোতায়েন এবং কারফিউ জারির প্রশংসা করে বলেন, এখন ধীরে ধীরে সবকিছুর উন্নতি হচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, শান্তি ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা তিনি বোঝেন এবং এর প্রশংসা করেন। রাষ্ট্রদূত বলেন, আমি টেলিভিশনে সবকিছু দেখেছি। কিন্তু ভাষার পার্থক্যের কারণে সেগুলো সঠিকভাবে বুঝতে পারিনি। তবে সংবাদপত্র থেকে আমি ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ এবং মারামারি থেকে ধ্বংসের বিষয় জানতে পেরেছি। রাষ্ট্রদূত জানান, তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে কয়েকটি ভাঙচুরের স্থান পরিদর্শন করেছেন। এ সময় অ্যাম্বাসাডর অ্যাট লার্জ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন উপস্থিত ছিলেন।
আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী : কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সহিংসতায় আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বিকালে রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে প্রধানমন্ত্রী আহত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বেশ কিছু সময় কাটান এবং তাদের খোঁজখবর নেন। উন্নত চিকিৎসা এবং দ্রুত সুস্থতার জন্য আহত পুলিশ সদস্যদের সব ধরনের সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন শেখ হাসিনা।
গুরুতর আহত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অবস্থা দেখে এবং অমানবিক নির্যাতনের কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তাকে অশ্রুসজল হতে দেখা যায়। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান। পরে প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক সহিংসতায় আহতদের দেখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে চিকিৎসাধীন আহতদের খোঁজখবর নেন।