শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

তালগাছের আঁশে জীবনের স্বপ্ন

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

তালগাছের আঁশে জীবনের স্বপ্ন

বগুড়ার কাহালু উপজেলায় তালগাছের আঁশ দিয়ে গ্রামের নারী-পুরুষ তৈরি করছে হরেক রকম বাহারি তৈজসপত্র। তাল গাছের আঁশ থেকে টুপি, পর্যটক টুপি, বিভিন্ন ধরনের হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাটি, ডাইনিং টেবিলের বিভিন্ন ধরনের ম্যাট, সরা, শৌখিন ফুলদানি, ঘরকন্না সাজাতে শৌখিন হস্তশিল্পসহ নানারকম পণ্যসামগ্রী তৈরি করে তারা সংসার পরিচালনা করছেন। দেশের বাজারে এ তৈজসপত্রগুলোর কদর কম হলেও বিদেশের বাজারে রয়েছে বেশ কদর। জার্মানি, ফ্রান্স, মালয়েশিয়াসহ ১০টিরও বেশি দেশে ইতোমধ্যে বিক্রির বাজার গড়ে উঠেছে। তাল গাছের আঁশ দিয়ে পণ্য তৈরি করে প্রায় তিন শতাধিক পরিবারে সুদিন ফিরেছে।

জানা যায়, বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের পাঁচখুর গ্রাম। গ্রামে রয়েছে অসংখ্য তালগাছ। এ  গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই তালগাছের আঁশ দিয়ে তৈরি হয় বাহারি সব তৈজসপত্র। বছরের বারো মাসই গ্রামের নারী-পুরুষ এসব পণ্য তৈরি করছেন। তাল গাছের গোড়ার অংশ থেঁতলে বাঁশের চিমটা দিয়ে আঁশ বের করে, তা রোদে শুকানোর পর শক্ত আঁশ পাওয়া যায়।

এ আঁশ দিয়ে তৈরি করা হয় হরেক রকম তৈজসপত্র। আবার কেউ কেউ তালগাছের পাতার ডাল দিয়েও তৈরি করেন তৈজসপত্র। সাংসারিক ছোটখাটো কাজে ব্যবহারের জন্য ও ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এসব শৌখিন তৈজসপত্র তৈরি করে স্বচ্ছল হয়েছেন এ গ্রামের অনেকেই। আশপাশের গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে তালগাছের আঁশ থেকে তৈরি হস্তশিল্পের কাজ।

সরেজমিনে জেলার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের পাঁচখুর গ্রামে প্রবেশ করতেই তাল গাছের আঁশ শুকাতে দেখা যায় এক নারীকে। কেউ-বা আবার বসে তালের আঁশ দিয়ে তৈরি করছেন বাহারি পণ্য। সারি সারি তাল গাছে ঘেরা এ গ্রামটিতে তাল গাছের আঁশ দিয়েই তৈরি হচ্ছে হরেক রকম বাহারি তৈজসপত্র। কেউ আবার আয়ের আশায় ঘরে বসেই তৈরি করছেন শৌখিন এসব পণ্য। এ গ্রামের নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরাও অবসর সময়ে তাল গাছের আঁশ দিয়ে পণ্য তৈরি করছেন।

 হস্তশিল্প কারিগর মোছা. হাসিদা বেগম জানান, তার স্বামী দেশের বাইরে থাকেন, তিনি সংসারের কাজের ফাঁকে তালের আঁশ দিয়ে তৈরি করেন বিভিন্ন পণ্য। এ আঁশ দিয়ে প্রতিদিন তিন থেকে চারটি টেবিল ম্যাট তৈরি করেন। একটা ম্যাটে ৩৫-৪০ টাকা পান। প্রতিদিন ১০০-১৫০ টাকা আয় হয় তার।

তৈজসপত্রের কারিগররা জানান, এ গ্রামের নারীদের হাতে তৈরি সামগ্রী এলাকায় বা দেশে তেমন বিক্রি না হলেও, অন্যান্য দেশে এর কদর রয়েছে। দিন দিন পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকায় এখন প্রায় ৩০০ পরিবার এ তালগাছের আঁশ দিয়ে ১০০-র বেশি রকমের সামগ্রী তৈরি করে থাকেন। তৈজসপত্রের পাইকারি ব্যবসায়ী কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের মো. ইউনুস আলী জানান, পাঁচখুর গ্রামের এ শিল্প প্রায় শত বছরের। আগে দেশের মধ্যে বিক্রি হতো। এখন দেশ ছাড়িয়ে জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে বিভিন্ন উপায়ে প্রেরণ করা হয়। পাঁচখুড় থেকে মাসে লাখ লাখ টাকার পণ্য বগুড়া জেলার শেরপুরে অবস্থিত ক্লাসিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রপ্তানিকারকরা কিনে নিয়ে বিভিন্ন দেশে পাঠাচ্ছেন। ইউনুস আলী জানান, মাঝারি বয়সের তাল গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করা হয়। পাতার ডাঁটা (স্থানীয় ভাষায় ডাকুর) বা গাছের গোড়ালির সঙ্গে লেগে থাকা অংশ কেটে নিয়ে হাতুড়ি দিয়ে থেঁতলে নেওয়া হয়। তা থেকে সংগৃহীত আঁশ রোদে শুকানো হয়। শুকনো আঁশ দিয়ে একটির সঙ্গে অপরটি পেঁচিয়ে বুননের মাধ্যমে বিভিন্ন আকার বা রূপ দেওয়া হয়। ঘর সাজানোর শৌখিন এসব পণ্য একদিকে যেমন দেখতে সুন্দর, তেমনি পরিবেশবান্ধব। এগুলো সহজেই মাটির সঙ্গে মিশে যায়। সাংসারিক ছোটখাটো কাজে ব্যবহারের জন্য ও ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এসব শৌখিন জিনিসপত্র তৈরি করে স্বচ্ছলতা এসেছে এ গ্রামের অনেকেরই। ইউনুস বলেন, তার বাবাও এ পেশায় যুক্ত ছিলেন ৪৫-৫০ বছর ধরে। এখন বয়স বেড়ে যাওয়ায় তিনি আর এসব তৈরি করতে পারেন না। এখন বাবার পেশাটাকে ধরে রাখতে তিনি এ পেশায় যুক্ত হয়েছেন। এ পেশায় এসেছেন তিনি প্রায় ২০ বছর হলো। তিনি সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় করেন। পাঁচখুর গ্রামে বেকার নেই বললেই চলে। ছোট-বড় সবাই কম-বেশি এসব পণ্য তৈরি করে অর্থ উপার্জন করছেন। মোছা. বৃষ্টি নামের এক কারিগর জানান, ১২ বছর ধরে এ কাজ করছেন। গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি এ কাজ করে দিনে আয় করেন ২০০ টাকা। একই গ্রামের আসমা খাতুন (৪০) জানান বিয়ের আগে থেকেই এ কাজ করছেন। আসমা তার এ রোজগারে সংসার আগলে রেখেছেন। তার স্বামীর রোজগারের সঙ্গে তার আয় যোগ করে মেয়ের পড়ালেখা আর অন্যান্য খরচ চালাচ্ছেন তিনি। বৃষ্টি আর আসমার মতোই পাঁচখুর গ্রামে ছোটবেলা থেকেই তালের আঁশ দিয়ে টুপি, টেবিল ম্যাট, ঝুড়িসহ নানা ধরনের খেলনা তৈরি করছেন পারভীন খাতুন, কুলসুম বিবি, মায়া বেগম, লাভলী বেগম ও মিনারা বেগম। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) বগুড়ার উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মাহফুজুর রহমান জানান, এ গ্রাম সম্পর্কে শুনেছি। তারা কোনোদিন সহযোগিতার জন্য বিসিকে আসেননি। তারা বিসিকে এলে নীতিমালা অনুযায়ী তাদের সহযোগিতা করা হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে গ্রামবাসীর তৈরি এ অনন্য কুটির শিল্পের উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি বহু মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

সর্বশেষ খবর