মধ্যপ্রাচ্য থেকে স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বিশেষ করে দুবাই থেকে বাংলাদেশে স্বর্ণ চোরাচালানে সিন্ডিকেট ব্যবহার করে থাকে এ রুট। মাঝেমধ্যে শুল্ক গোয়েন্দাদের হাতে দুবাইফেরত যাত্রীসহ ধরা পড়ে স্বর্ণের চালান। অভিনব কৌশল অবলম্বন করে তারা নিয়ে আসেন স্বর্ণ। বাহকসহ মাঝেমধ্যে চালান ধরা পড়লেও সবসময় সিন্ডিকেটের মূলহোতা স্বর্ণসম্রাটরা থেকে যান অধরা। আর ধরা পড়া চালানের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি চালান নিরাপদে চলে যায় গন্তব্যে- এমন দাবি সচেতন মহলে। এতদিন এই সিন্ডিকেটের মূলহোতাদের পরিচয় ছিল আড়ালে। তবে গত বুধবার প্রায় ১৭ কোটি টাকার চালান ধরা পড়ার পর আলোচিত হচ্ছে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ আগরওয়ালা ও ডায়মন্ড অ্যান্ড ডিভার্সের স্বত্বাধিকারী এনামুল হক খান দোলনের নাম। কাস্টমস সূত্র বলছে, ২০১৭ সালের জুলাই থেকে গত বুধবার পর্যন্ত ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বর্ণের ২২টি অবৈধ চালান আটক করা হয়। এসব চালানে জব্দ করা হয় ১০ হাজার ৪২২ ভরি স্বর্ণ। জব্দকৃত স্বর্ণের মূল্য শত কোটি টাকার ওপরে। ওসমানী বিমানবন্দরে সর্বশেষ স্বর্ণের চালান ধরা পড়ে গত বুধবার। দুবাইফেরত যাত্রী সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার তোয়াকুল বাজার এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে হোসাইন আহমদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় প্রায় ১৬ কেজি স্বর্ণ। জুসার মেশিনের ভিতরে করে অভিনবপন্থায় এ চালান নিয়ে আসেন হোসাইন। গ্রিন চ্যানেল পার হয়ে বিমানবন্দরের ভিতর থেকে নিরাপদে তিনি বেরও হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু গতিবিধি সন্দেহজনক হওয়ায় কার পার্কিং জোন থেকে তাকে সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তাকর্মী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তাকে চ্যালেঞ্জ করে ফের বিমানবন্দরের ভিতর এনে তল্লাশি করেন। পরে লাগেজে রাখা ৪টি জুসার মেশিনের ভিতর থেকে ১৭ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ১৬ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) মিডিয়া অফিসার, অতিরিক্ত উপ কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, হোসাইন আহমদকে গতকাল আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আকামুল আলী বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। সাইফুল ইসলাম জানান, স্বর্ণের চালানের সঙ্গে যাকে আটক করা হয়েছে তিনি বাহকমাত্র। চালানের মূল মালিক অন্য কেউ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছে, বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পর চোরাচালান সিন্ডিকেটের সদস্যরা তার কাছ থেকে স্বর্ণের চালানটি নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তবে সিন্ডিকেটের মূলহোতা কারা বা তাকে কে চালানটি দিয়েছিল তা জানায়নি হোসাইন। তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিন্ডিকেটের হোতাদের শনাক্তের চেষ্টা করা হবে।
এর আগে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর সিলেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় স্বর্ণের চালান ধরা পড়ে ওসমানীতে। ওই দিন দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট থেকে প্রায় ৩৪ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। সন্দেহজনকভাবে আটক করা হয় চারজনকে। কিন্তু তদন্তে চালানের মূল মালিককে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা যাত্রীদের কাছ থেকেই সিংহভাগ সোনা জব্দ করা হয়। সোনা চোরাচালানে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা হয়। কখনো নিজের শরীরে পেঁচিয়ে, কখনো বিমানের সিটের নিচে টেপ দিয়ে আটকিয়ে, কখনোবা জুসের মেশিনের ভিতরে সোনা চোরাচালানের চেষ্টা করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সোনার বার আনা হয়।
সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে সোনা চোরাচালানের সবচেয়ে নিরাপদ রুট ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কিন্তু যখনই কোনো ইস্যুতে শাহজালালে কড়াকড়ি বা নজরদারি বাড়ানো হয় তখন ওসমানী বিমানবন্দর ব্যবহার করে স্বর্ণ চোরাচালান বেড়ে যায়।
গোয়েন্দাদের তথ্য মতে, সোনা চোরাচালানে বিভিন্ন বিমান পরিবহন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিমানবন্দরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িত। ফলে অনেক বড় চালানই ধরা পড়ে না। সাধারণ যেসব যাত্রী সোনা নিয়ে বিমানবন্দরে ধরা পড়েন, তারা মূলত কিছু টাকার বিনিময়ে বাহক হিসেবেই কাজ করেন। সোনা কোনোরকমে বিমানবন্দর পার হলেই চলে যায় চক্রের হাতে।
ব্যাগেজ রুলের আওতায় একজন যাত্রী বৈধভাবে শুল্ক দিয়ে সর্বোচ্চ ২০ ভরি বা দুটি সোনার বার বিদেশ থেকে আনতে পারেন। এ জন্য প্রতি ভরিতে (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) ২ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হয়। কেউ যদি বার না এনে ১০০ গ্রাম বা সাড়ে আট ভরি ওজনের স্বর্ণালংকার আনেন, তবে তাকে শুল্ক দিতে হয় না। কিন্তু সাধারণ যাত্রীদের সিংহভাগই নিয়ম জানেন না। এই সুযোগই নিচ্ছে চোরাচালানচক্র। তারা যাত্রীদের কাছে সোনার বড় চালান দিয়ে দেশে পাঠাচ্ছে। বিমানবন্দরে ধরা না পড়লে সেই চালান চক্রের হাত ধরে দেশের সোনার বাজারে ঢুকে পড়ে। এদিকে, ওসমানী বিমানবন্দরে অবৈধ স্বর্ণ ধরা পড়লেও মূল চোরকারবারিরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এতদিন সিন্ডিকেটের মূলহোতারা আড়ালে থাকলেও গত বুধবার ১৬ কেজি স্বর্ণের চালান আটকের পর জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে দেশের আলোচিত স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট দিলীপ-দোলনের নাম। সূত্র জানায়, ওই স্বর্ণের মালিক ছিলেন দিলীপ কুমার আগারওয়ালা। পতিত শেখ হাসিনা সরকারের রথী-মহারথীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় তিনি স্বর্ণ চোরাচালানে বেপরোয়া ছিলেন। কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নজরদারি বাড়ানোর কারণে ওই দিলীপ-দোলন সিন্ডিকেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে দুবাই থেকে স্বর্ণের চালান নিয়ে আসছেন।