মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধের তীব্র উত্তেজনার মধ্যে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ঘোষণা করেছে, যুদ্ধ শুরু হলে তারা ইসরায়েলকে তাদের আকাশসীমা ব্যবহার করতে দেবে না। এর আগে আকাশসীমা ব্যবহার করতে না দেওয়ার জন্য আরব দেশগুলোকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল ইরান। এদিকে গত বৃহস্পতিবার এবং গতকাল ইসরায়েলি বিমান থেকে বোমা বর্ষণে দক্ষিণ লেবাননে অবস্থিত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী ঘাঁটি ক্ষতিগ্রস্ত ও সিরিয়া-লেবানন সীমান্তে অবস্থিত রেডক্রসের ফিল্ড হাসপাতাল ধ্বংস হয়েছে। এতে করে আন্তর্জাতিক মহলের তীব্র নিন্দার মুখে পড়েছে ইসরায়েল। সূত্র : রয়টার্স, বিবিসি, আল জাজিরা, আল মনিটর, এএফপি। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, দখলদার ইসরায়েল যেন ইরানের তেল স্থাপনায় হামলা না চালায় সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লবিং করছে সৌদি আরবসহ গালফ অঞ্চলের দেশগুলো। কারণ তাদের শঙ্কা, যদি ইসরায়েলের হামলার পর সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে তাহলে তাদের নিজেদের তেল স্থাপনা ও ইরানি প্রক্সি বাহিনীর হামলার ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এ ছাড়া ইরান ও ইসরায়েলের দ্বন্দ্বের মাঝখানে যেন পড়ে না যায়, সেজন্য সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত মার্কিনিদের জানিয়ে দিয়েছে, ইরানে হামলা চালাতে তারা ইসরায়েলকে নিজেদের আকাশসীমা ব্যবহার করতে দেবে না। এর আগে ইরান এক হুঁশিয়ারিতে জানিয়েছিল, ইসরায়েলের যেকোনো হামলায় সহায়তা করলে উপসাগরীয় দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না ইরান। এরকম সহযোগিতা দিলে দেশগুলো শত্রুর তালিকায় পড়বে এবং পরিণতি ভোগ করতে হবে। ইরানের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও এক কূটনীতিক জানিয়েছেন, তেহরান এরই মধ্যে সৌদি আরবকে সতর্ক করেছে যে, ইসরায়েলকে যে কোনো ধরনের সহায়তা দেওয়া হলে সৌদি আরবের তেল স্থাপনাগুলো নিরাপদ থাকবে না।
এ বিষয়ে সৌদি রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ সৌদি বিশ্লেষক আলি শিহাবি বলেন, ইরানিরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, যদি উপসাগরীয় দেশগুলো ইসরায়েলের জন্য তাদের আকাশসীমা খুলে দেয়, তবে ইরানের মিত্ররা, বিশেষত ইরাক ও ইয়েমেনের গোষ্ঠীগুলো কঠিন জবাব দেবে। বুধবার সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচির মধ্যে বেঠক হয়েছে। এ বৈঠকে ইসরায়েলের সম্ভাব্য হামলা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। উপসাগরীয় ও ইরানি সূত্রগুলো জানায়, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফর এবং সৌদি-মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার যোগাযোগ একটি সমন্বিত প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর লক্ষ্য হলো চলমান সংকট মোকাবিলা করা।
অন্যান্য খবরে বলা হচ্ছে, ইসরায়েল গত সপ্তাহের ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুতি নিয়েছে। অন্যদিকে, তেহরান সতর্ক করেছে, প্রতিশোধমূলক হামলা হলে তা প্রচন্ড ধ্বংসযজ্ঞে রূপ নেবে, যা পুরো অঞ্চলকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলতে পারে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রকেও এই সংঘাতে জড়ানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তেল স্থাপনা নিয়ে শঙ্কা : বিশ্বের শীর্ষ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে থাকা সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলো তেল সরবরাহের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ওপেকের নেতৃত্বে থাকা সৌদি আরবের কাছে পর্যাপ্ত অতিরিক্ত তেল সরবরাহ করার সক্ষমতা থাকলেও, ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলায় ইরানের তেল স্থাপনাগুলো ধ্বংস হলে এর প্রভাব বিশ্ববাজারে পড়বে। উপসাগরীয় দেশগুলো যেমন বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি বা সেনা মোতায়েন রয়েছে। ফলে তাদের সঙ্গে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী ঘাঁটিতে ইসরায়েলি হামলা : দক্ষিণ লেবাননে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী (ব্লু হেলমেট)-এর সদর দপ্তরে ইসরায়েলি বিমান হামলায় দুজন শান্তিরক্ষী আহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবারের এ হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে। বিশেষ করে, জাতিসংঘ মিশনে অংশ নেওয়া ইউরোপীয় দেশগুলো এ ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ইতালি ইসরায়েলের এ হামলাকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ বলে অভিহিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রও এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইন্দোনেশিয়ার জাতিসংঘের রাষ্ট্রদূত হারি প্রাবোও এ ঘটনাকে আন্তর্জাতিক আইন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল্যবোধের পরিপন্থি বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, এই হামলা প্রমাণ করে, ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকারের ঊর্ধ্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। স্পেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘটনাটিকে ‘গুরুতর আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করেছে এবং এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস বলেছেন, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলা অগ্রহণযোগ্য এবং তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা প্রধান জ্যাঁ-পিয়ের লাক্রোয় নিশ্চিত করেছেন, লেবাননে শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা এখন মারাত্মক ঝুঁকির মুখে রয়েছে। পরিস্থিতির অবনতির কারণে ৩০০ শান্তিরক্ষীকে এরই মধ্যে বৃহত্তর ঘাঁটিতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং আরও ২০০ জনকে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
এদিকে ইসরায়েল স্বীকার করেছে, তাদের সেনাবাহিনী ওই এলাকায় গুলি চালিয়েছে। তবে তাদের দাবি, হিজবুল্লাহর সশস্ত্র সদস্যরা জাতিসংঘের ঘাঁটির কাছে অবস্থান করছিল।
ফিল্ড হাসপাতাল ধ্বংস : ইরানের রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, সিরিয়া-লেবানন সীমান্তে অবস্থিত রেডক্রসের ফিল্ড হাসপাতালে গতকাল ভোরে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এ হামলায় হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও উপকরণ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। এই হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘাই। তিনি একে ‘যুদ্ধাপরাধ’ বলে অভিহিত করেন। এক বিবৃতিতে বাঘাই ৫৬ শয্যার হাসপাতালটিকে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর জন্য ইসরায়েলের সমালোচনা করেন। বাঘাই জানান, নিয়মিত গাজা, লেবানন ও সিরিয়ার হাসপাতাল ও আশ্রয় কেন্দ্রে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল, যা সব ধরনের আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার স্পষ্ট ইঙ্গিত।