হিজবুল্লাহর যোগাযোগ যন্ত্র পেজার ও ওয়াকিটকিতে অভিনব কায়দায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ইসরায়েল অনেককে অবাক করে দেয়। তার মাঝেই ঘটেছে আরেক ঘটনা। লেবাননে বিস্তৃত পরিসরে হামলা চালানোর আগে মুঠোফোনে দেশটির বাসিন্দাদের বার্তা দিয়ে সতর্ক করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
অনেকেই মনে করছেন, লেবাননের টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক হ্যাক করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণেও নিতে পারে ইসরায়েল।
গতকাল সোমবার দক্ষিণ লেবাননের বিভিন্ন গ্রাম ও বৈরুতের কোনো কোনো অংশের বাসিন্দারা দিনের শুরুতে খুদে বার্তা ও ফোনকল পান। এসব বার্তা ও কল এসেছিল লেবাননেরই একটি ফোন নম্বর থেকে। তাতে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটিগুলো থেকে বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সব বার্তাই ছিল একই রকম।
সকাল ৮টা ২০ মিনিটের দিকে পাওয়া এমনই একটি বার্তায় লেখা ছিল, ‘আপনি যদি হিজবুল্লাহর অস্ত্রশস্ত্র থাকা কোনো ভবনে থাকেন, তবে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ওই গ্রাম থেকে দূরে থাকুন।’
আল জাজিরার সাংবাদিক মাজেন ইব্রাহিম বলেছেন, মানুষের ফোন নম্বর, তাদের অবস্থানের মতো ব্যক্তিগত তথ্য ইসরায়েল কীভাবে পেয়েছে সেটা বিস্ময়কর ঘটনাই বটে। তার মতে, এটি তথ্য ফাঁস নাকি লেবাননের টেলিকম অবকাঠামোয় ইসরায়েলের হ্যাকিং সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
ইসরায়েলের দাবি, বেসামরিক লোকজনের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এসব সতর্কবার্তা পাঠাচ্ছে তারা। গাজায় চলমান যুদ্ধেও এমন সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে দেশটি। আর এর পেছনেও তারা ওই একই যুক্তি দেখিয়েছে।
কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এ যুক্তিকে সমর্থন করে না। লেবাননে ইসরায়েলের বোমা এমন সব ভবনেও আঘাত হেনেছে, যেখানকার বাসিন্দারা কোনো সতর্কবার্তা পাননি। অন্যদিকে গাজায় বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে থাকা মানুষের ওপরও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
সতর্কবার্তা নানাভাবে, যেমন গণমাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে, ফোনকল বা প্রচারপত্র বিলি করে দেওয়া যেতে পারে। তবে গাজায় ফোনের মাধ্যমে বছরজুড়ে যেভাবে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে, তাতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ইসরায়েলের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধেরও একটি উদাহরণ। এর উদ্দেশ্য, ফিলিস্তিনিদের এ কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে তাঁরা যখন, যেখানেই থাকুন, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারিতে রয়েছেন।
এ নিবিড় নজরদারি ইসরায়েলকে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতেও সহায়তা করেছে। গাজায় গ্রহণ করা এ পরিচিত পদ্ধতিই এবার লেবাননে ঘটাল ইসরায়েল।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পেজার ও ওয়াকিটকিগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার কয়েক মাস আগেই ইসরায়েল এসব যন্ত্রের ভেতর বিস্ফোরক ঢুকিয়ে দেয়। এ ঘটনার পর গতকাল লেবাননের নির্দিষ্ট এলাকার মানুষের ফোনে ফোনে সতর্কবার্তা পাঠানো ও কল করার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল এ ইঙ্গিতই দিল যে শত্রু হিজবুল্লাহই শুধু নয়, সাধারণ লেবাননিদের ব্যক্তিগত তথ্যে অনুপ্রবেশ করার সক্ষমতাও রয়েছে তার। অবশ্য ঝুঁকি ও সংঘাতবিষয়ক বিশ্লেষক এলিজাহ ম্যাগনিয়ারের মতে, এ ঘটনায় বিস্ময়ের কিছু নেই। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সংঘাত ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা এই বিশ্লেষক বলেছেন, গত ৮ অক্টোবরের আগেই লেবাননের টেলিকম নেটওয়ার্ক হ্যাক করেছে ইসরায়েল।
এলিজাহ ম্যাগনিয়ার বলেন, ‘ল্যান্ডফোনের লাইন, গাড়ির প্লেট নম্বর, মোবাইল ফোনে তাদের (ইসরায়েল) প্রবেশাধিকার আছে। এর মানে হলো পশ্চিম তীর বা গাজার মতো লেবাননের দক্ষিণেও যেকোনো ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম তারা।’
ম্যাগনিয়ার আরও বলেন, অত্যাধুনিক গোয়েন্দা প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে ওই সব এলাকায় কারা বসবাস করেন, তাঁদের ফোন নম্বর কত, এমনকি তাঁদের বাসায় কাদের যাতায়াত, সেসব বিষয় নিখুঁতভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম করে তুলেছে।
এই গোয়েন্দারা নির্দিষ্ট সরঞ্জাম নিয়ে শহরের সড়কগুলোতে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় হাজার হাজার আইপি অ্যাড্রেস সংগ্রহ করতে সক্ষম বলে জানান এই বিশ্লেষক। সেই সঙ্গে কোনো এলাকায় হিজবুল্লাহর বৈঠকের মতো কোনো ‘অস্বাভাবিক ঘটনা’ ঘটছে কি না, সেটি শনাক্ত করা ও ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করতেও সক্ষম তারা।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল