কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতসহ ১১ দফা দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
রবিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে অবস্থিত মাইডাস সেন্টারে টিআইবি কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত এক মানববন্ধনে অংশ নেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
মানববন্ধনে তিনি বলেন, সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ, অহিংস, যৌক্তিক ও অরাজনৈতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন তথা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সহিংসতায় দুই সপ্তাহ ধরে দেশে নজিরবিহীন ও নির্মম হত্যাকাণ্ড, ধারাবাহিক বেআইনি নির্যাতন ও নিপীড়ন, বাছবিচারহীন মামলা, যথেচ্ছ হামলা, ব্লকরেইড করে নির্বিচারে গণগ্রেফতার, অবৈধ রিমান্ড, নিরাপত্তা প্রদানের ভুয়া যুক্তিতে গোয়েন্দা কার্যালয়ে আটক ও নির্যাতন, হুলিয়া-পরোয়ানা, অনলাইন-অফলাইন হুমকিসহ সংবিধান, বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এক নৈরাজ্যপূর্ণ ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন জবাবদিহিহীন কার্যক্রমকে বৈধতা ও মূল অপরাধীদের সুরক্ষার লক্ষ্যে অসত্য বয়ান ও নিরেট মিথ্যাচার করা হচ্ছে, যা উদ্বেগ, শঙ্কা ও আস্থাহীনতা গভীরতর করাসহ সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ অধিকতর রুদ্ধ করছে।
তিনি আরও বলেন, বেসরকারি হিসাবে শিশু-কিশোর, সংবাদকর্মী ও অন্যান্য পেশাজীবীসহ দুই শতাধিকেরও অধিক শিক্ষার্থী ও জনতাকে হত্যা করা হয়েছে, যা মূলত আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকর্তৃক বেআইনি, নির্বিচার ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অতিরিক্ত, অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে মর্মে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে ইতোমধ্যে শুধু রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ২ লাখ ১৩ হাজারের বেশি আসামি করে অন্তত ২০০টি মামলা করা হয়েছে। আন্দোলনের মুখে সব সমন্বয়ক, শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিকদের কোনো ধরনের হয়রানি না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। অথচ সমস্ত নৈতিকতা ও ন্যূনতম বিবেকবোধ বিসর্জন দিয়ে আজ পর্যন্ত রাতের আঁধারে নির্লজ্জভাবে শিক্ষার্থী ও নানা শ্রেণী-পেশার মানুষকে নির্বিচারে আটক করে, তুলে নিয়ে গুম করে প্রতারণামূলকভাবে বিভিন্ন মামলার আসামি করা হচ্ছে-যার সঙ্গে তাদের দূরতম সম্পর্ক না থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও অনেককে রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশে নির্মমভাবে বাছবিচারহীনভাবে বহুমাত্রিক ও বহু-পর্যায়ের ঘোরতর ও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, যার দায় মূলত আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের যথেচ্ছ ক্ষমতার অপব্যবহারসহ সার্বিক সুশাসনের ঘাটতি এবং একচ্ছত্র ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ, জনস্বার্থবিচ্ছিন্ন, অবারিত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বিবর্জিত, সীমাহীন দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনব্যবস্থার। এ পরিপ্রেক্ষিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ১১ দফা দাবি তুলে ধরছে।
দাবিগুলো হলো:
১. বহুমাত্রিক ও বহুপর্যায়ের নজিরবিহীন ও নির্মম মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য তদন্ত নিশ্চিতে জাতিসংঘের উদ্যোগে সম্পূর্ণ স্বাধীন কমিশন গঠন করার মাধ্যমে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২. ভবিষ্যতে এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে আইন-প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনের শাসনের সঙ্গে জড়িত সব প্রতিষ্ঠান তথা সার্বিক রাষ্ট্রকাঠামো ঢেলে সাজাবার জন্য জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৩. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকর্তৃক সব শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিকদের হয়রানি ও নির্মম নিপীড়ন এখনই বন্ধ করতে হবে। আটক সব সমন্বয়ক, শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিককে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে ও সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
৪. বেআইনি, নির্বিচার ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অতিরিক্ত, অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারসহ বিভিন্নভাবে যারা নির্মম হতাহতের জন্য দায়ী এবং যাদের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্নকে পদদলিত করে নজিরবিহীন এ নির্মমতা সংগঠিত হয়েছে তাদের সবাইকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
৫. জাতির ইতিহাসের নজিরবিহীন এ অধ্যায়ে নিহত-আহত সবার বয়স ও পেশা অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ তালিকা অবিলম্বে প্রকাশ করতে হবে।
৬. আহত সবার পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা, পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করতে হবে।
৭. হতাহত সবার পরিবারের জন্য সম্মানজনক ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি পুনর্বাসন প্রক্রিয়া প্রকাশ করতে হবে।
৮. অবাধ তথ্যপ্রবাহের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও ডিজিটালসহ সব গণমাধ্যমের প্রতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব ধরনের হুমকি, নিষেধাজ্ঞা ও নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার এবং বন্ধ করতে হবে। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ওপর সব প্রকার নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে।
৯. সহিংসতা দমন বা অন্য কোনো অজুহাতে, ভিন্নমত দমনের হঠকারি-প্রক্রিয়া থেকে এখনই সরে আসতে হবে। ভিন্নমত, বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিপন্থি নজরদারিভিত্তিক ভীতিকর পরিবেশ, তথা সব জনগণের জন্য নিরাপত্তাহীনতার বোধ সৃষ্টির সংস্কৃতি পরিত্যাগ করতে হবে।
১০. এ মুহূর্ত থেকে সব অসত্য বয়ান ও মিথ্যাচার বন্ধ করে, সব দেশবাসীর মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
১১. দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার ফাঁকাবুলির সংস্কৃতি পরিহার করে সব প্রকার-বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির বিচারহীনতা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বিডি প্রতিদিন/এএ