ওটিটি প্ল্যাটফরম যা বর্তমান জেনারেশনের কাছে খুবই জনপ্রিয় একটি বিনোদনমাধ্যম। ওটিটি শব্দের অর্থ হলো- ‘ওভার দ্য টপ’। ওটিটি মিডিয়া সার্ভিস এমন এক ধরনের মিডিয়া যাতে কোনো ডিশ ক্যাবল বা স্যাটেলাইটের প্রয়োজন হয় না। প্রথাগত সব মাধ্যমকে পাশ কাটিয়ে শুধু ইন্টারনেটের সাহায্যেই গ্রাহক তার পছন্দমতো মিডিয়া উপভোগ করতে পারে। বাংলাদেশেও সিনেমা ও নাটকের প্রসারে ওটিটি ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। বর্তমানে এ দেশের সেরা ওটিটি প্ল্যাটফরম হলো- বায়োস্কোপ, বায়োস্কোপ প্রাইম, হইচই, বঙ্গ, বিঞ্জ, টফি, চরকি, আইস্ক্রিন প্রভৃতি। ওটিটির মাধ্যমে যে কোনো ডিভাইসে কনটেন্ট দেখা যায়। যেমন টিভি, স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার। আমরা বিশ্বের যে কোনো জায়গায় বসে ওটিটির মাধ্যমে কনটেন্ট দেখতে পারি। প্রযুক্তি উন্নতির সুবাদে পুরো দুনিয়া এখন হাতের মুঠোয়। সিনেমা দেখার জন্য এখন আর সিনেমা হলে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। দেশ-বিদেশের নাটক কিংবা ওয়েব সিরিজ সবই ঘরে বসে দেখা যায় ওটিটিতে। এ জন্য ওটিটি প্ল্যাটফরমগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বর্তমানে সিনেমা কিংবা সিরিজপ্রেমীদের কাছে ওটিটি প্ল্যাটফরমগুলো হয়েছে অবসরের সঙ্গী। এর দর্শকের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। সারা বিশ্বে নেটফ্লিক্স এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় প্ল্যাটফরম। নেটফ্লিক্স একটি মার্কিন বিনোদনধর্মী প্রতিষ্ঠান, যা ১৯৯৭ সালের ২৯ আগস্ট রিড হ্যাস্টিংস এবং মার্ক রেন্ডোল্ফ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের স্কটস ভ্যালি শহরে প্রতিষ্ঠা করেন। নেটফ্লিক্স ২০১৩ সালে কনটেন্ট (নাটক, চলচ্চিত্র, ভিডিও) প্রযোজনা শিল্পে প্রবেশ করে। তাদের প্রথম পরিচালিত ধারাবাহিক ‘হাউস অব কার্ডস’ দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ধারাবাহিক তৈরিতে ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন প্ল্যাটফরমের গ্রাহক বাড়তে থাকায় নতুন দেশি প্ল্যাটফরম যেমন চালু হয়েছে, তেমনি বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে। সেই সঙ্গে তৈরি হচ্ছে বাংলা কনটেন্ট। যা একই সঙ্গে বিশ্ববাজারের পণ্য হিসেবে ছড়িয়ে পড়ছে। এদেশে ওটিটি প্ল্যাটফরমগুলোর বিস্তারের কারণে এখানে বিনিয়োগ যেমন হচ্ছে, তেমনি উঠে আসছে নতুন নতুন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, পরিচালক, অভিনয়শিল্পী। আগে যেসব বড় মাপের তারকা ওটিটিতে কাজ করতে আগ্রহী ছিলেন না এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা দেখে তারাও এখন এ মাধ্যমের দিকে বেশি পরিমাণে ঝুঁকে পড়ছেন। ইতোমধ্যে ‘তকদির’, ‘কন্ট্রাক্ট’, ‘মানি হানি’, ‘মহানগর’, ‘ইতি, তোমারই ঢাকা’, ‘ঊণলৌকিক’, ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান’ এর মতো আরও কিছু ওয়েব সিরিজ পেয়েছে দর্শক। তাছাড়া তুফানসহ অনেক বড় মাপের চলচ্চিত্রও মুক্তি পেয়েছে ওটিটিতে। বাংলাভাষী ভারতীয় বিনোদনমাধ্যম ‘হইচই’ চালু হয় ২০১৭ সালে। কলকাতাভিত্তিক এ ভিডিও স্ট্রিমিং সাইটটি বাংলাদেশে কাজ শুরু করে ২০১৯ সাল থেকে। বিনোদন বাণিজ্য বিষয়ক মার্কিন প্রতিষ্ঠান ভ্যারাইটি জানিয়েছে, ‘হইচই’ আশা করছে বাংলাদেশে তাদের প্রবৃদ্ধি প্রতি বছর ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। তাদের মোট আয়ের ৩০ শতাংশই আসে ভারতের বাইরে থেকে। ‘হইচই’ এর মতে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে হইচই কাজ শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত গ্রোথ বাড়ছে। এ সময়ে সব মিলিয়ে ১২-১৩টারও বেশি কনটেন্ট তৈরি করা হয়। তার মানে মানুষ দেখছে। নতুন এ মাধ্যমের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ার কারণ প্রসঙ্গে এ খাতে যুক্ত পরিচালক, প্রযোজক বলছেন, নতুন এ মাধ্যমে অনেকটাই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন নির্মাতা। নতুন বিনিয়োগ আসায় আর্থিক সংস্থান নিয়েও কলাকুশলীদের চিন্তা কম। নতুন মাধ্যম এবং কাজের স্বাধীনতার কারণে নির্মাতারা তাদের গল্প স্বাধীনভাবে বলতে পারছেন। এ মাধ্যমটা বাংলাদেশে নতুন। আর এর কনটেন্ট শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। নতুন শিল্পীরা কাজের সুযোগ পাচ্ছেন। আর ওটিটির হিরো হচ্ছে গল্প। তাই যে ভালোভাবে গল্পটা তুলে ধরতে পারছেন তার কাজ দর্শক নিচ্ছেন। দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফরম ‘বঙ্গবিডি’ মনে করছে এ মাধ্যমের কনটেন্টগুলো বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত হওয়ায় নির্মাতারা ওটিটিতে আগ্রহী হচ্ছেন। এখন তথ্য-প্রযুক্তির যুগে ভিডিও প্ল্যাটফরমগুলোর কনটেন্ট বিশ্ববাজারে চলে যাচ্ছে। নির্মাতারা এ জন্য এক ধরনের উৎসাহ পান। আরেকটা বিষয় হলো- এক সময়ে টেলিভিশনে বাজেটের কিছু সমস্যা ছিল। এখানে সেটা অনেকটাই নেই। নির্মাতারা নিজেদের মতো করে কাজ করতে পারছেন। সে কারণে অনেক নতুন নতুন ভালো নির্মাতা এবং শিল্পী পাচ্ছি। এখানে গল্প বলার স্বাধীনতা পাওয়া যায়। আরেকটা বিষয় হলো- এখানে সিরিজ এবং সিনেমা দুটোই নির্মাণ করা যায়। টেলিভিশন নাটকের সময়সীমার একটা বিষয় থাকে। এখানে সেই বাধ্যবাধকতা কম। ওটিটির নীতিনির্ধারক হচ্ছে দর্শক। দর্শক তার পছন্দমতো কনটেন্ট এখানে দেখছে। টেলিভিশন বা সিনেমা হলে দর্শক তার সময়মতো দেখতে পারে না। এখানে তিনি পারছেন। ওটিটি জনপ্রিয় হওয়ার এটা অন্যতম কারণ। এ নতুন মাধ্যম আসায় দর্শক, নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী প্রত্যেকেই আগের চেয়ে নতুন উদ্যমে কাজ করছেন। নতুন গল্পকার আসছেন, পরিচালক আসছেন, অভিনয়শিল্পী আসছেন। পুরনো অনেক অভিনয়শিল্পী নতুনভাবে নিজেদের উপস্থাপন করছেন। এখন আধুনিক দর্শকরা নাটক দেখার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন ইউটিউব আর ওটিটিকে।
২০১৩ সালে বাংলাদেশে সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক ওটিটি হিসেবে সর্বপ্রথম ‘বঙ্গ’র আগমন ঘটে। প্ল্যাটফরমটি বিদেশি নানা কনটেন্টের পাশাপাশি দেশি নাটক, সিনেমা প্রভৃতি দিয়ে সাজানো হয়। কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে ওটিটি প্ল্যাটফরমের জন্য ওয়েব ফিল্ম, ওয়েব সিরিজ তৈরির বিষয়গুলো ছিল আলোচনার বাইরে। সেই চিত্র পাল্টে যাচ্ছে ক্রমেই।
ওয়েব সিরিজ ‘মরীচিকা’ দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে নতুন ওটিটি প্ল্যাটফরম চরকি। এ প্ল্যাটফরমটি ১২ মাসে ১২টি বড় বাজেটের তারকাসমৃদ্ধ ওয়েব ফিল্মের ঘোষণা দিয়েছে। অনলাইনে ছবি মুক্তি দিয়ে সিনেমার বাজার চাঙা রাখা সম্ভব উল্লেখ করে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার সিইও আলিমুল্লাহ খোকন বলেছেন, ‘অনলাইন প্ল্যাটফরমগুলো সবার জন্যই উন্মুক্ত। চাইলেই যে কেউ ছবি মুক্তি দিতে পারেন। এখন আমরাও আমাদের ছবি অনলাইনে মুক্তির চিন্তাভাবনা করছি।’ অনলাইন প্ল্যাটফরম নিয়ে জনপ্রিয় তারকারাও দারুণ আশাবাদী। জিয়াউল ফারুক অপূর্বর মতে- ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই বদলাবে, আধুনিক হবে; এটাই তো স্বাভাবিক। একটা সময় টেলিভিশন, এরপর ইউটিউব, এখন ওটিটি প্ল্যাটফরম আসছে; এটা তো খুবই ভালো। অভিনয় করার জায়গাগুলো বিস্তৃত হচ্ছে। শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। দেশি-বিদেশি প্লাটফরমে কাজ করেছি। বেশ সাড়াও পাচ্ছি।’ অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী ওটিটি প্ল্যাটফরমে কাজ করার বিষয়টিকে পজিটিভলি দেখছেন। তার মতে, শিল্পীদের অভিনয়ের ক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে, অভিনয়ের অনেক সুযোগ পাচ্ছেন। যেটা দেশের কিংবা শিল্পীদের জন্য খুবই ভালো। অনেকেই কাজ করছেন এ মাধ্যমে। চিত্রনায়ক শাকিব খানের ভাষ্য, ‘আমাদের দেশেও ওটিটি প্ল্যাটফরমের যাত্রা শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে দেশের দর্শকরাও অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। আগামীতে সিনেমা হলের পাশাপাশি ওটিটিতে কাজ করব। দেশি কনটেন্ট বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ুক এটাই প্রত্যাশা।’ তরুণ নির্মাতা রায়হান রাফির মতে, পৃথিবীটাই এখন চেঞ্জ হয়ে গেছে। ওটিটিতেও ধীরে ধীরে নির্ভরতা বাড়ছে। তবে সিনেমা হলের বিকল্প কখনো ওটিটি হতে পারে না। ওটিটি আলাদা আরেকটা প্ল্যাটফরম। ওটিটির দর্শকরা টাকা দিয়ে সিনেমা দেখে, তারা খুবই স্মার্ট দর্শক। ফলে ওটিটির জন্য সিনেমা বানালে সেটা মাথায় রাখতে হবে। নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী ওটিটি প্ল্যাটফরমের জোয়ারকে সুবাতাস হিসেবে দেখছেন। কথায় কথায় তিনি জানালেন, ‘টেলিভিশন নাটকের বাজেট কমে গেছে। সেখানে ওটিটিকে সুবাতাস মনে হচ্ছে। এখানে গল্প অনুযায়ী শিল্পী নেওয়া যাচ্ছে। বাজেটও ভালো। সবকিছু বিবেচনা করলে এ ভয়ংকর সময়ে ওয়েব সিরিজ ও ওয়েব ফিল্ম নির্মাতাদের জন্য সুবাতাস বয়ে নিয়ে এসেছে।’ বিদেশি ওটিটি প্ল্যাটফরমে ‘মহানগর’ সিরিজ তৈরি করে দারুণ আলোচনা সৃষ্টি করেছেন নির্মাতা আশফাক নিপুণ। তিনি মনে করেন, ‘ভালো ওয়েব সিরিজ নির্মাণের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। ফ্রি কনটেন্ট দেখায় অভ্যস্ত দর্শক টাকা খরচ করে বাংলাদেশের কনটেন্ট দেখছে। তারা লেখালেখি করছে। সাধারণ ও বোদ্ধা দর্শক এটা নিয়ে আলোচনা করছে। ব্যক্তিগত অর্জনের চেয়ে সামষ্টিক অর্জন অনেক বেশি।’ বলা যায়, সময় এখন ওটিটি প্ল্যাটফরমের। ডিজিটাল দুনিয়ায় ভিন্ন গল্প এবং মানসম্পন্ন নির্মাণশৈলী দিয়ে বাংলাদেশের কনটেন্ট বিশ্ববাজারে ঠাঁই করে নেবে, এমনটাই প্রত্যাশা।