গাজীপুর ও সাভারে শ্রমিক বিক্ষোভে একের পর এক শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা চেয়ে ব্যবসায়ীরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের পর বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ উপদেষ্টা। বৈঠক শেষে উপদেষ্টারা বলেছেন, এ অসন্তোষের কোনো গতিপ্রকৃতি বোঝা যাচ্ছে না। ভাঙচুরের পেছনে ‘ভাড়াটে’ ও ‘টোকাইদের’ও দায়ী করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের বার্তাও দেওয়া হয়েছে।
গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লে. জে. মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ; আইন, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং সংস্কৃতি উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার; শিল্প, গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান অংশ নেন।
পোশাকশিল্পে ঝুট ব্যবসায় এখনো আওয়ামী লীগের ‘প্রভাবশালীরা’ রয়ে গেছেন এবং বিএনপির লোকেরাও এখানে দখল করতে আসছেন-এমন কথাও বলেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। গতকাল বৈঠক শেষে উপদেষ্টা আরও বলেন, বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে আওয়ামী লীগের লোকজনসহ বহিরাগতরা রয়েছেন। বুধবার তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন শুরু হবে বলেও জানিয়েছেন।
শ্রম উপদেষ্টা বলেন, ‘শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে আমরা মালিক ও শ্রমিক পক্ষের সঙ্গে একাধিক সভা করেছি। আমাদের শিল্প উপদেষ্টাও কথা বলছেন। সব শ্রমিকনেতার কাছ থেকে আমরা এটাই জানতে পেরেছি, এখন যে আন্দোলনগুলো হচ্ছে, শ্রমিকনেতারা এ আন্দোলনের প্রকৃতিটা নিজেরাও বুঝে উঠতে পারছেন না। কারণ এখানে কোনো নির্দিষ্ট দাবি উঠে আসছে না। কোনো নির্দিষ্ট দফা পাওয়া যাচ্ছে না। যারা সাধারণত শ্রমিক আন্দোলন করেন, তারাও সেখানে সেভাবে নেই। বহিরাগত লোকজনের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় মালিকপক্ষ বেতন দিতে দেরি করছে, এজন্য আন্দোলন হচ্ছে। কয়েকটি স্পেসিফিক ফ্যাক্টরি আছে সেখানে মালিকপক্ষ পালিয়ে গেছে। সেখানে কিছুটা অসন্তোষ হয়েছে। সেগুলো আমরা অ্যাড্রেস করছি, সেগুলোর জন্য সরকার সফট লোন ঘোষণা দিয়েছে। সেটার পরিধি আরও বাড়ানো হবে।’
উপদেষ্টা বলেন, ‘তবে এ ছোট ছোট কয়েকটি সুনির্দিষ্ট জায়গায় অসন্তোষ কেন্দ্র করে যে জায়গাগুলোয় ফ্যাক্টরি ক্লাস্টারগুলো আছে, সেখানে দেখা গেছে বহিরাগতরা এসে এবং বেকার যুবসংঘ নামে যারা কখনো শ্রম এরিয়ার মধ্যে আন্দোলন করেনি তারা গাড়ি ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে।’ আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘শ্রমিকনেতারাই আমাকে বললেন যে তাঁরা সেখানে হেঁটে এসেছেন এবং তাঁরা দেখেছেন হেলমেট ও হাফপ্যান্ট পরা যারা টোকাই, যাদের টাকা দিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রামের জন্য ভাড়া করা হয়, তাদের সেখানে দেখা গেছে। যারা ঝুট ব্যবসা নিয়ে সন্ত্রাস করছে, আওয়ামী লীগের লোকেরা যে সিন্ডিকেটগুলো সামলাত তারা তো সেগুলো ছেড়ে চলে গেছে। এখন যারা সেগুলো দখলের পাঁয়তারা করছে এবং সেখানে সন্ত্রাস করছে, তাদের এবং যারা বহিরাগত তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে, সেটা মঙ্গলবারও বলেছি। স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগও আছে কিছু জায়গায়। কিছু স্থানীয় বিএনপি নেতাও রয়েছেন বলে আমরা সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আমাদের এ বিষয়ে কথা হচ্ছে, তাঁরা যাতে তাঁদের নিবৃত্ত রাখেন। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী যেসব আওয়ামী লীগ নেতা এখনো রয়ে গেছেন তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে যাব।’ উপদেষ্টা বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে যে তথ্য রয়েছে, তার ভিত্তিতে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে। সেখানে যে জনদুর্ভোগ তৈরি হয়েছে, তার জন্য পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।’
পরিস্থিতি কতদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হবে বলে মনে করছেন-জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ‘বুধবার (আজ) অ্যাকশন শুরু হবে, সেখানে ক্ষতি হয় এমন কোনো অ্যাকশন পুলিশ নেবে না। রাস্তাগুলো খালি করার জন্য যথাযথ অ্যাকশন নেবে। যারা ইন্ধন জোগাচ্ছে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।’
আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের শ্রমিকনেতারা আশ্বস্ত করেছেন, যে শ্রমিকরা আন্দোলন করছে তাদের বোঝাবেন। তাদের সমস্যার সমাধানে আরও বৈঠক করব। সমস্যা সমাধানে মালিক এবং শ্রমিক পক্ষ মিলে এগিয়ে যাব।’ উপদেষ্টা হাসান আরিফ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। সাংবাদিকদের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, ‘চারদিকে যে শ্রমিক অসন্তোষ হচ্ছে, তা নিয়ে আমরা বৈঠক করেছি। আমরা খবর পাচ্ছি যে প্রকৃত শ্রমিক যারা, তারা কেউ নিজের বাড়ি পোড়াবে না, কারণ এখানে তার জীবিকা। এটা বহিরাগতরা এসে করেছে। তাদের আপনারা (শ্রমিকরা) বাধা দেন, আপনারা তাদের বাধা দিলে আমরাও আপনাদের সঙ্গে থাকব। এমনভাবে তারা মিশে আছে যে তাদের আলাদা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’ স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রকৃত শ্রমিকরা এ ধরনের কোনো বিশৃঙ্খলা করছেন না। যেখানে তার জীবিকা সেখানে তিনি (শ্রমিক) ধ্বংস করবেন না। স্থানীয় কারখানা নষ্ট হয়ে যাবে, তাহলে কার লাভ হবে? কাজেই শ্রমিকরা কোনো বিশৃঙ্খলা করছেন না। যারা করছেন তাদের অধিকাংশই বহিরাগত। তাদের কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সে কারণে আমাদের একটু কঠিন হতে হবে।’ উপদেষ্টা বলেন, ‘সরকার কোনো সময় তার নাগরিকের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করবে না, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এখন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, কারখানা, শ্রমিক ও দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে গেলে কিছুসংখ্যকের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সে ব্যাপারে আমাদের আলোচনা হয়েছে।’ কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে বিষয়ে আরও চিন্তাভাবনা করতে হবে। তারা গ্রেপ্তার কিংবা আটক হতে পারেন। ৫০ জন রাস্তায় বসে পড়লে ৫ লাখ মানুষের অসুবিধা হবে। কাজেই তাদের সরাতে যদি বলপ্রয়োগ করতে হয়, লাঠিপেটা করতে হয়, জলকামান ব্যবহার করতে হয় আমরা সেটা করব।’