শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

তুরাগ হত্যায় নানা ফাঁদ

উচ্ছেদের পরও দুই শতাধিক স্থাপনার দখলে তুরাগ, পাউবোর জমি ব্যবহার করে অবৈধ স্থাপনায় যাতায়াতের রাস্তা, নদের জমিতে আছে সরকারি স্থাপনাও, রাতের আঁধারে চলছে প্লাবন ভূমি ভরাট, ১৩১ পয়েন্টে কঠিন বর্জ্য ফেলে চলছে ভরাট

গোলাম রাব্বানী ও শামীম আহমেদ

তুরাগ হত্যায় নানা ফাঁদ

নানা কৌশলে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে ঢাকা ও গাজীপুরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া অন্যতম বাণিজ্যিক নদ তুরাগকে। ঢাকাকেন্দ্রিক নদ-নদীগুলোকে দ্রুত দখল ও দূষণমুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনার পরও তুরাগের পাড় ও প্লাবন ভূমি দখল করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে শিল্প-কারখানা, বাজার, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ক্লাব, বাস-ট্রাক স্ট্যান্ড, ফিলিং স্টেশন, বাড়ি, দোকানসহ দুই শতাধিক স্থাপনা। সরকারের অধিগ্রহণ করা জমিতে বালু ফেলে তৈরি করা হয়েছে এসব স্থাপনায় যাওয়ার সংযোগ সড়ক। বেসরকারি দখলের পাশাপাশি সরকারি স্থাপনাও গড়ে উঠেছে তুরাগের জমিতে। প্রতিদিন রাতের আঁধারে ভরাট হচ্ছে নদের প্লাবন ভূমি ও তীর। সরিয়ে ফেলা হচ্ছে সীমানা পিলার ও নদী রক্ষার ব্লক। সেই সঙ্গে ১৩১টি পয়েন্টে কঠিন বর্জ্য ফেলে ভরাট করা হচ্ছে তীর। ৯৯টি সুয়ারেজ লাইন দিয়ে অপরিশোধিত শিল্প ও পয়োবর্জ্য সরাসরি পড়ছে নদের পানিতে। এতে কালের সাক্ষী এক সময়ের খরস্রোতা তুরাগ ক্রমেই পরিণত হচ্ছে সরু নর্দমায়। সরেজমিন মিরপুরের গোড়ান চটবাড়ি এলাকা থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে গিয়ে দেখা গেছে, বেড়িবাঁধ ও তুরাগের মাঝখানের প্লাবন ভূমি ভরাট করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনা, ক্লাব, হোটেল, রেস্তোরাঁ (কিছু রেস্তোরাঁ অবশ্য পানির মধ্যে টং বানিয়ে তৈরি করা হয়েছে), বাজার, ট্রাকস্ট্যান্ড, পেট্রলপাম্পসহ দেড় শতাধিক স্থাপনা। অধিকাংশ স্থাপনাই কয়েক বছরের পুরনো।  বেড়িবাঁধ থেকে এসব স্থাপনায় যাওয়ার জন্য প্লাবন ভূমি ও তুরাগের বিভিন্ন শাখা চ্যানেল ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে ১০৩টি সংযোগ সড়ক। নতুন করে বালু ফেলে প্লাবন ভূমি ভরাট করা হয়েছে এমন ১৬টি স্থান নজরে এসেছে। গোড়ান চটবাড়ি এলাকায় বেড়িবাঁধ থেকে প্রায় ৪০০ গজ দূরে তুরাগের পাড়েই কয়েক একর জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান (পিকআপ) মালিক সমিতির ট্রাক টার্মিনাল। গুগল ম্যাপে ওই এলাকায় তুরাগের মূল চ্যানেলের বাইরে বেশ কয়েকটি শাখা চ্যানেল দেখালেও বাস্তবে তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এদিকে গাবতলী পশুরহাটের কাছে তুরাগের সীমানা পিলারের মধ্যেই গড়ে উঠেছে ইট-বালু-সুরকির গদি, বিভিন্ন দোকান, ওয়ার্কশপ। সরকারের কৃষি বিপণন অধিদফতরের বহুতল সেন্ট্রাল মার্কেটটিও তুরাগের সীমানা পিলার থেকে অন্তত ৫০ গজ নদের দিকে। সীমানা পিলারের মধ্যে রয়েছে অন্তত ৩৫টি ইট-বালু-সুরকির গদি, অস্থায়ী ট্রাক স্ট্যান্ডসহ অসংখ্য ছোট ছোট দোকান। গাবতলী পশুর হাটের পাশের দোকানিরা জানান, তাদের দোকান যেখানে, সেখানেও নদী দেখেছেন। তাদের চোখের সামনেই ভরাট হয়েছে। লুৎফর মহাজন নামের একজনকে তারা দোকানের ভাড়া দেন। এদিকে দূষণে বসিলা ও টঙ্গী এলাকায় তুরাগের পানির রং হয়ে গেছে কালো। পানি থেকে বের হচ্ছে উৎকট গন্ধ।

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু দখল নয়, ৯৯টি সুয়ারেজ লাইন দিয়ে তুরাগে সরাসরি পড়ছে শিল্প ও পয়োবর্জ্য। এ ছাড়া ১৩১টি পয়েন্টে কঠিন বর্জ্য ফেলে ভরাট করা হচ্ছে নদ। ভরাটের কারণে তুরাগের ২২টি চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেছে। সংস্থাটির চেয়ারম্যান  মোহাম্মদ এজাজ বলেন, পাউবো চাইলে একদিনের অভিযানে তুরাগ দখল করে গড়ে তোলা এসব অবৈধ স্থাপনার কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে পারে। বেড়িবাঁধ থেকে পাউবোর জায়গা ব্যবহার করে এসব স্থাপনায় যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সংযোগ সড়কগুলো কেটে দিলেই ওইসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। নতুন করে দখলও থেমে যাবে।

খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, তুরাগ ও বেড়িবাঁধের মধ্যের প্লাবন ভূমিতে কিছু ব্যক্তি মালিকানা জমিও রয়েছে। সেই সব জমির পাশাপাশি খাস জমি ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলেছে প্রভাবশালীরা। আর বেড়িবাঁধের পাশে পাউবোর অধিগ্রহণ করা জায়গা ভরাট করে এসব স্থাপনায় যাওয়ার রাস্তা তৈরি করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদী গতিপথ পরিবর্তন করায় অনেক সময় প্লাবন ভূমি ও তীরভূমিতে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিও থাকে। বসিলা এলাকায় নদের মধ্যেই ৮৯০ দাগ নদীর জমি আর ৮৯১ ও ৮৯২ দাগের জমি ব্যক্তিমালিকানাধীন। তবে এসব জমিতে ইচ্ছা করলেই যে কোনো স্থাপনা করার বিধান নেই। এ ব্যাপারে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইনানুযায়ী নদী বা নদীর বন্যা প্রবাহ এলাকায় ব্যক্তি বা সরকারেরও কোনো স্থাপনা থাকতে পারবে না। আমরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সব ধরনের রেকর্ড যাচাই করে নদীর জায়গাগুলো চিহ্নিত করছি। কাজ শেষের পথে। নদীর জায়গা কেউ দখলে রাখতে পারবে না। সংস্থাটির সার্বক্ষণিক সদস্য মো. আলাউদ্দিন বলেন, প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী, নদ-নদীর তীরভূমি ও প্লাবন ভূমির রূপ পরিবর্তন করা যাবে না। বর্ষাকালে জোয়ারের পানি যতদূর ছড়িয়ে যায় ততদূর প্লাবন ভূমি। এখানে কৃষিকাজ করা যাবে কিন্তু ভরাট বা কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু, তুরাগের বেড়িবাঁধের পর নদ পর্যন্ত অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে প্লাবন ভূমিতে। ভরাট করা হয়েছে। সেসব প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার জন্য বেড়িবাঁধ থেকে পাউবোর জায়গায় বাঁধ দিয়ে রাস্তা তৈরি করেছে। আমরা পাউবোকে বলেছি। তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে।

এদিকে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশনা ও হাই কোর্টের নির্দেশের (রিট পিটিশন নম্বর ৩৫০৩/২০০৯) ভিত্তিতে গত বছরের ২৯ জানুয়ারি ঢাকার আশপাশের নদ-নদী দখলমুক্ত করার অভিযানে নামে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ২৪ জুলাই পর্যন্ত ৬ মাসে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীর উভয় পাড়ের ১৫৭ কিলোমিটার তীরভূমিতে অভিযান চালিয়ে ৪ হাজার ৭৭২টি ছোট-বড় স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। উদ্ধার হয় ১২১ একর তীরভূমি। তবে আইনি জটিলতায় তখন টঙ্গী এলাকায় তুরাগের ১০ একরের বেশি জায়গা দখল করে গড়ে ওঠা কয়েকটি শিল্প-কারখানা ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবন না ভেঙেই প্রাথমিক অভিযান শেষ করে বিআইডব্লিউটিএ। অন্যদিকে উচ্ছেদ অভিযান শেষে উদ্ধারকৃত জমিতে ফের হানা দেয় দখলদাররা। গত ১ অক্টোবর গভীর রাতে  মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় তুরাগ পাড়ে বিআইডব্লিউটিএ নির্মিত ওয়াকওয়ের রেলিং ভেঙে ও নদী রক্ষা ব্লক তুলে নদী ভরাট শুরু করে দুষ্কৃতকারীরা। খবর পেয়ে রাতেই ঘটনাস্থলে গিয়ে হাতেনাতে দুজনকে আটক করে বিআইডব্লিউটিএ। গত বছরের জুলাইয়ে অভিযান সমাপ্তির ছয় মাস না যেতেই তুরাগের আব্দুল্লাহপুর অংশে দুই তীর পুনর্দখল করে গড়ে ওঠে দুই তলা ভবনসহ বাজার। ১৯ ডিসেম্বর ফের অভিযান চালিয়ে পাঁচ শতাধিক পাকা ও কাঁচাঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। মিরপুর বেড়িবাঁধ এলাকার বড়বাজার, পালপাড়া, হরিরামপুর এলাকায় উচ্ছেদের পর বার বার পুনর্দখলের চেষ্টা চলছে। গত আগস্টে আবারও অভিযান চালিয়ে ট্রাক-লেগুনা-রিকশাস্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন স্থাপনা উচ্ছেদ করে বিআইডব্লিউটিএ। এ সময় বড়বাজার এলাকায় বর্জ্য তুলতে গিয়ে নদ থেকে উঠে আসে পরিত্যক্ত গাড়ি। স্থানীয়রা বলছেন, সব ধরনের মালামাল নদের মধ্যে ফেলে তুরাগ ভরাট করছে দখলদাররা।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর