ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাঠ প্রশাসন সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এখন প্রশাসনে রদবদল চলছে। বিগত সরকারের আমলে প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা তাঁদের ন্যায্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বঞ্চিত সেই কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া শুরু হয়েছে। জানা গেছে, এদের মধ্যে অনেকের পদোন্নতি নিয়ে কথা উঠেছে। কারও কারও নামে বিভাগীয় মামলাসহ নানা বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও এ সুযোগে বঞ্চিতদের সঙ্গে পদোন্নতি বাগিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছেন, বিভিন্ন সময় বঞ্চিত হয়েছেন, নিজেদের গায়ে এমন তকমা লাগিয়ে জেলা প্রশাসক বা ডিসি হতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বিতর্কিত কর্মকর্তারাও। নিয়মিত মাঠ প্রশাসন শাখাসহ, এপিডি উইং এবং হাতেগোনা কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে ধরনা দিচ্ছেন তাঁরা। প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা এমনকি সংশ্লিষ্ট ব্যাচের কর্মকর্তারা ডিসি পদের জন্য মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছেন এমন বিতর্কিত কয়েকজনের নাম শুনে হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সদ্যপদোন্নতি পাওয়া উপসচিবসহ বিসিএস ২৪, ২৫ ও ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হবে। নিয়োগের মানদণ্ড হবে মেধা, দক্ষতা ও সততা। গত সোমবার বিকালে ডিসি হতে ইচ্ছুক প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। যে কোনো সময় নতুন ডিসি নিয়োগ হবে। একাধিক সূত্র জানান, সরকার পতনের পর অনেক জেলায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালনে অনীহার কথা পন্ত্রিপরিষদের মাঠ প্রশাসন বিভাগকে জানিয়েছেন ডিসিরা। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সোমবার রাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনের কক্ষে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) একাধিক সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠকে দেশের সব জেলা প্রশাসককে (ডিসি) প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ধাপে ধাপে নতুন করে ডিসি নিয়োগ দেওয়া হবে জেলাগুলোয়। জানা গেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালনে অনেক ডিসিও অনীহার কথা জানিয়েছেন। তাঁরা মাঠ প্রশাসন থেকে ফেরত নেওয়ার জন্য এরই মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথাও বলেছেন। এদিকে গতকাল ডিসিদের প্রত্যাহার শুরু হয়েছে। রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে ২৫ জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আগের ডিসি ফিটলিস্ট বাতিল করে নতুন ফিটলিস্ট করতে বলেছেন বঞ্চিত কর্মকর্তারা। সে অনুযায়ী নতুন তালিকাও তৈরি হচ্ছে। এসএসবির এক সদস্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ডিসি নিয়োগে প্রক্রিয়ার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। যাচাইবাছাই শেষে যোগ্য কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রশাসনের একটা কাঠামো আছে। ডিসিদের অনেক দায়িত্ব সুতরাং অযোগ্য হলে সেখানে কাজে ব্যত্যয় হবে। কয়েক দিন ধরে পদোন্নতি পাওয়া বিতর্কিত নামগুলো নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। এরই মধ্যে ডিসি পদে আলোচনায় আছেন কতিপয় বিতর্কিত কর্মকর্তা। গতকাল সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তাদের রুমে রুমে গিয়ে নানা ধরনের আবদার নিয়ে ধরনা দিতে দেখা গেছে কর্মকর্তাদের। এরই মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন-২ শাখায় আগের কর্মকর্তা সরিয়ে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বিভিন্ন কাজ নিয়ে ওই শাখার কর্মকর্তা রুমে গেলে দরজা বন্ধ দেখতে পান আগত কর্মকর্তারা। এ সময় জানানো হয়, তিনি গোপনীয়তার সঙ্গে কাজ করছেন বলে রুমের দরজা বন্ধ রেখেছেন।
জানা গেছে, কেউ এপিডির সঙ্গেও দেখা করছেন। ২৪ ও ২৫ ব্যাচের কর্মকর্তারা বেশি দৌড়ঝাঁপ করছেন। ভালো পদায়নের অপেক্ষায় ঘুরতে থাকা ২৪ ব্যাচের এক কর্মকর্তা বলেন, আমি ডাম্পিং পোস্টে কাজ করেছি, বঞ্চিত ছিলাম। তবে এও ঠিক, ডিসি হতে পারব না। কিছু নিয়মকানুন আছে, যা আমার পূরণ হয়নি। তবে ডিসি হতে ভাইভা যারা দিয়েছেন বলে নাম শুনেছি হিসাব করে দেখেছি এর চেয়ে আমি অনেক যোগ্য। এখন অযোগ্যতাও বড় যোগ্যতা বলে হাসেন ওই কর্মকর্তা। ২৪ ব্যাচের আরেক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাচের কে কেমন তা কিন্তু ব্যাচের কমবেশি সবাই জানেন। আর্থিক, চরিত্রগত সমস্যা বিভিন্ন সময় আলোচনা হয়। সে ধরনের কেউ যদি মাঠ প্রশাসনের প্রতিনিধিত্ব করেন কী হবে সেখানের অবস্থা বোঝেন? কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানার কথা মনে আছে? সে রকম হবে জেলাগুলো। তিনি আরও বলেন, একটা ব্যাচের সবাই ডিসি হবেন না এটা ঠিক। তবে এ ক্ষেত্রে যোগ্য প্রকৃত বঞ্চিতদের দিক, সেটা নিয়ে আপত্তি নাই। ভালো নিরপেক্ষ যোগ্য কর্মকর্তা দিক, কেউ প্রশ্ন ওঠাবে না। বঞ্চিত হলেই সে ডিসি হওয়ার যোগ্যতা রাখে এটা কিন্তু ঠিক নয়। এ প্রতিবেদকের কাছে ডিসি নিয়োগের মানদণ্ড বজায় রাখার প্রত্যাশা করেন তিনি। এ প্রতিবেদকের কাছে অনেক কর্মকর্তা বলেন, প্রত্যেক ব্যাচে অতিমাত্রার দুর্নীতিবাজ, বিতর্কিত কিংবা দুশ্চরিত্রবান কারা তা আগের ইতিহাস দেখলেই পরিষ্কার হবে। ঊর্ধ্বতন স্যারেরাও জানেন। তবে এখন যারা এসএসবিতে আছেন তারা যেন শুধু বঞ্চিত হয়েছেন এই একটা বিষয় বিবেচনায় না আনেন। যাকে দায়িত্ব দিয়ে জেলায় পাঠাচ্ছেন তার বিষয়ে একটু খোঁজ নেন-সে অনুরোধও রাখেন অনেকে। এদিকে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে, ডিসি নিয়োগ ইস্যুতে বিগত সরকারের আমলে বঞ্চিত পাঁচ কর্মকর্তার সহায়তা নেওয়া হবে। তারা হলেন বিসিএস ২৪ ব্যাচের নুরজাহান খানম ও নজরুল ইসলাম, ২৫ ব্যাচের নুরুল করিম ভুইয়া ও ফরিদা খানম এবং ২৭ ব্যাচের সারোয়ার আলম। সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান ডিসি নিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এসএসবিতে এসব নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হতে হবে। এতে তাড়াহুড়া করা যাবে না। বিভাগীয় মামলা, বদনাম, দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে এসব ক্ষেত্রে শুধু মাঠ প্রশাসন নয়, তাদের কোনো পদেই বসানো যাবে না। আমরা বাংলাদেশকে ঠিক করতে চাই, মেরামত করতে চাই। বঞ্চিত মানে কী-তার ন্যায্যতা ছিল, সবকিছুর যোগ্যতা ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তির হস্তক্ষেপে দেওয়া হয়নি। যাদের ডিপি ছিল, অভিযোগ ছিল, তারা তো বঞ্চিত নন এবং সুবিধাও পাওয়া উচিত নয়।’ সাবেক এই সচিব আরও বলেন, ‘আমি গণমাধ্যমে দেখলাম ডিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনটি ব্যাচে প্রতিনিধি ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। এ প্রতিনিধির মাধ্যমে যাচাইবাছাই ঠিক হবে না। এটা একটা খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকবে মনে করি। ডিসি নিয়োগের একটা পরীক্ষিত পদ্ধতি আছে। যদি আসলেই এ প্রতিনিধির সহায়তা নেওয়া হয় সেটা খারাপ উদাহরণ, যা করা অন্তর্বর্তী সরকারের ঠিক হবে না।’
ডিসি হওয়ার শর্ত : জেলা প্রশাসক বা ডিসি পদে পদায়ন নীতিমালায় বলা হয়েছে, ‘বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কর্মচারীগণের মধ্য হইতে উপসচিব পদে পদোন্নতি প্রাপ্তির এক বৎসর পর জেলা প্রশাসক পদে পদায়নের জন্য ফিটলিস্ট প্রণয়ন করা হইবে। ফিটলিস্ট প্রণয়নের ক্ষেত্রে উপপরিচালক, স্থানীয় সরকার/অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক/সচিব, জেলা পরিষদ/প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, পৌরসভা এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উভয় পদে মোট ন্যূনতম ২ (দুই) বৎসরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকিতে হইবে। পূর্ববর্তী ৫ (পাঁচ) বৎসরের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনের রেকর্ড এবং সমগ্র চাকরিজীবনের শৃঙ্খলা প্রতিবেদন সন্তোষজনক হইতে হইবে। প্রকল্প ও ক্রয় ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত জ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে জানা এবং বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা থাকিতে হইবে। ম্যাজিস্ট্রেসি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হইতে হইবে।’ বঞ্চিত একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দীর্ঘ ১৫ বছর বঞ্চিত থাকায় অনেকেই মাঠ প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। এসব বিষয় বিবেচনা করে নতুন ফিটলিস্ট তৈরি করতে হবে। গণমাধ্যমসহ সমাজমাধ্যমে তিনটি ব্যাচের কয়েকটি নাম নতুন ফিটলিস্টে জায়গা পেয়েছে বলে ঘুরপাক খাচ্ছে। এসবের মধ্যে কয়েকটি নাম নিয়ে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে প্রশাসনের ভিতরে।
২৫ ডিসিকে প্রত্যাহার, বদল হবে সব জেলায় : মাঠ প্রশাসনে রদবদল শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। রদবদলের অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলায় দায়িত্ব পালন করা জেলা প্রশাসক (ডিসি) প্রত্যাহার শুরু হয়েছে। এরমধ্যে ২৫ জেলা প্রশাসককে (ডিসি) প্রত্যাহার করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ধাপে ধাপে সব জেলার ডিসিকেই প্রত্যাহার করে নতুন ডিসি পদায়ন করা হবে বলে জানা গেছে। গতকাল রাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পৃথক প্রজ্ঞাপনে ২৫ জেলার ডিসিকে প্রত্যাহার করার পাশাপাশি একই আদেশে তাদের নতুন কর্মস্থলে পদায়ন করা হয়েছে। প্রত্যাহার হওয়া ডিসিদের তালিকায় রয়েছেন ঢাকা, সিলেট, রংপুর, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, মাগুরা, গাইবান্ধা, নওগাঁ, নাটোর, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, ফরিদপুর, শেরপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, পাবনা, বগুড়া, জয়পুরহাট, চাঁদপুর, খুলনা ও গোপালগঞ্জের ডিসি।