১ আগস্ট, ২০২২ ০৮:১৩

বারবার সময় বাড়িয়েও বন্ধ হয়নি অবৈধ হ্যান্ডসেট

বার্ষিক রাজস্ব ক্ষতি হাজার কোটি, থামছে না মোবাইল ছিনতাই, নকল ফোনে সয়লাব বাজার

শামীম আহমেদ

বারবার সময় বাড়িয়েও বন্ধ হয়নি অবৈধ হ্যান্ডসেট

প্রতীকী ছবি

ব্যাংকিং তথ্য, গোপন পাসওয়ার্ড, ব্যক্তিগত ছবি, গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট সবই এখন থাকছে মোবাইলে। মুহূর্তে সেই মোবাইল ছোঁ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছিনতাইকারী। লাখ টাকার হ্যান্ডসেট বিক্রি করে দিচ্ছে ১০-১৫ হাজার টাকায়। গত বছর রাজধানীর বিজয় সরণি থেকে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের মোবাইল ফোনটি চোখের পলকে নিয়ে যায় ছিনতাইকারী। সাঁড়াশি অভিযানে ছিনতাইকারীকে আটক করা হলেও রাজধানীর ১৬টি স্থানে দৈনিক ছিনতাই হচ্ছে শতাধিক মোবাইল ফোন, যার অধিকাংশেরই হদিস মিলছে না। গত ২০ জুলাই কারওয়ান বাজার এলাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্রী পারিশা আক্তারের মোবাইলটি ছিনতাই হয়। ওই ফোনে ছিল পারিশার থিসিসের জন্য এক বছর ধরে জমা করা তথ্য-উপাত্ত। ওই ছাত্রীর বক্তব্য- লাখ টাকা দিয়েও ওই তথ্য-উপাত্ত এখন আর সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।

চোরাই, অবৈধ ও নকল হ্যান্ডসেট বেচাকেনা রুখতে সরকার ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্টার বা এনইআইআর প্রকল্পের মাধ্যমে অবৈধ সব হ্যান্ডসেট বন্ধের উদ্যোগ নিলেও তা মাঝ পথেই থেমে আছে। বারবার সময় বাড়িয়েও উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি। সবশেষ গত বছরের ১ অক্টোবর থেকে সব অবৈধ হ্যান্ডসেট পর্যায়ক্রমে বন্ধ হওয়ার কথা ছিল। সেই মোতাবেক কাজও শুরু হয়। কিন্তু বিদেশ থেকে ফেরত আসা যাত্রীদের বহন করা বৈধ সেট নিবন্ধন নিয়ে জটিলতা দেখা দেওয়ায় ভেস্তে যায় উদ্যোগ। এদিকে চুরি যাওয়া সেট বেচাকেনা ও ব্যবহারের অবাধ সুযোগ থাকায় থামছে না মোবাইল ছিনতাই। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর ব্যস্ততম ১৬টি স্থানে দৈনিক শতাধিক মোবাইল ছিনতাই হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশের বাজার ছেয়ে গেছে অবৈধভাবে আমদানি করা, চোরাই ও নকল হ্যান্ডসেটে। এতে শুধু গ্রাহকই প্রতারিত হচ্ছেন না, বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাবেই দেশে প্রতি বছর বিক্রি হওয়া মোবাইল হ্যান্ডসেটের প্রায় ২৫ থেকে ৩০ ভাগ অসাধু উপায়ে কর ফাঁকি দিয়ে বাজারে ঢুকছে। এতে ৮০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিটিআরসির মহাপরিচালক (স্পেকট্রাম) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জুয়েল মোবাইলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অবৈধ সেট বন্ধের জন্য বিটিআরসির এনইআইআর সিস্টেম শতভাগ তৈরি আছে। কিন্তু হ্যান্ডসেট রেজিস্টার বা ডিরেজিস্টার করার বিষয়ে এখনো ব্যবহারকারী সচেতন নয়। সেট নিবন্ধনের মেসেজ পাঠালেও অনেকে তা সময়মতো দেখছেন না। সাধারণ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হয় এ জন্য এনইআইআর কার্যক্রম আপাতত বন্ধ আছে। সরকারের নির্দেশনা পেলে আবার চালু করব। বিটিআরসি ও বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী সমিতির (বিএমবিএ) তথ্যানুসারে, দেশে গড়ে বছরে সাড়ে ৩ কোটি হ্যান্ডসেট বিক্রি হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি করা ও উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ১২ লাখ। মোবাইল ফোন উৎপাদন ও অ্যাসেম্বলিং খাতে দেশে বর্তমানে ১২-১৪টি কোম্পানির বিনিয়োগ ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি, যাদের উৎপাদন সক্ষমতা ৪ কোটি ইউনিটের বেশি। অনেকে নতুন বিনিয়োগ নিয়ে উৎপাদনের অপেক্ষায় আছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে মোবাইল বিদেশে রপ্তানির সুযোগ থাকলেও ২৫-৩০ ভাগ হ্যান্ডসেট কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে ঢুকছে দেশে। এতে সরকার রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের মোবাইল শিল্প।

এদিকে অবৈধ সেটের সংখ্যার ধারণা পাওয়া যায় গত বছরের ১ জুলাই থেকে পরীক্ষামূলক এনইআইআর কার্যক্রম শুরুর পর। পয়লা জুলাই থেকে গ্রাহকের হাতে থাকা হ্যান্ডসেটের নিবন্ধন শুরু হয়। তিন মাস সময় দিয়ে ১ অক্টোবর থেকে অবৈধ সেট বন্ধের কথা ছিল বিটিআরসির। পয়লা জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি সাড়ে ৮ লাখ নতুন হ্যান্ডসেট বিক্রি হয়, যার মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩১ লাখ সেটকে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কথা অনুযায়ী ১ অক্টোরব থেকে বিটিআরসি অনিবন্ধিত নতুন হ্যান্ডসেট বন্ধ করা শুরু করে। প্রথম তিন দিনে ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৬৫২টি সেট তাদের নেটওয়ার্কে নতুন শনাক্ত হয়। এর মধ্যে ১ লাখ ২৪ হাজার ৮৬১টি হ্যান্ডসেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বিদেশ থেকে আসা বৈধ হ্যান্ডসেট নিবন্ধন নিয়ে জটিলতা শুরু হওয়ায় সরকার বৈধ-অবৈধ কোনো ধরনের হ্যান্ডসেট বন্ধ না করার ঘোষণা দেয়। এদিকে বিটিআরসি সূত্র বলছে, অবৈধ সেট বন্ধ হলে ব্যবহারকারীরা ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশি নিরাপত্তা উপভোগ করতে পারবেন। চোরাই ফোন বেচাকেনা বন্ধ হবে। সরকারের রাজস্ব বাড়বে। দেশীয় মোবাইল ফোন অ্যাসেম্বল শিল্প লাভবান হবে। নকল সেট কিনে মানুষ প্রতারিত হবে না। এনইআইআর কার্যক্রম চালু হলে অনিবন্ধিত সেটে সিম ঢুকানোর সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ যাবে। মেসেজে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেটটি রেজিস্টার করার নির্দেশনা থাকবে। ছিনতাই করা সেট কেনাবেচা বন্ধ হবে। কারণ, একজন ব্যবহারকারী একবার সেট রেজিস্টার করার পর যদি সেটি অন্য কাউকে বিক্রি করতে চান তাহলে ওই সিম দিয়ে সেটি ‘ডি-রেজিস্টার’ করে বিক্রি করতে হবে। চলতি বছরে একাধিক অভিযানে মোবাইল ছিনতাইকারী চক্রের অনেককে আটক করে ডিবি। তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, পুরো ঢাকায় সীমানা নির্ধারণ করে মোবাইল ছিনতাইয়ে জড়িত অন্তত ২০টি চক্র। ১৬টি জনবহুল স্থানে দৈনিক ছিনতাই হয় শতাধিক ফোন। কম দামি ফোনগুলোর বেশির ভাগ গুলিস্তান পাতাল মার্কেট ও মিরপুর এলাকায় ফোনের দোকানে বিক্রি হয়। ফুটপাতে প্রকাশ্যেও বিক্রি হয় কিছু ফোন। দামি ফোনগুলো কিনে নেওয়ার আলাদা চক্র রয়েছে। তারা ফোনের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে অনলাইনে বা হাতে হাতে বিক্রি করে দেয়।


বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর