সিনিয়র হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে (৬২) গাইডেড মিসাইল চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল সকালে ইসরায়েলি মিসাইলটি তেহরানে তাঁর ব্যক্তিগত বাসভবনে আঘাত করে। এ ঘটনার পর আঞ্চলিক উত্তেজনা তীব্র হয়েছে। ইসরায়েল আশঙ্কা করছে, যে কোনো মুহূর্তে তাদের ওপর বড় ধরনের পাল্টা আঘাত হানা হতে পারে। সূত্র : রয়টার্স, বিবিসি, আল হাদাথ, আলজাজিরা, এএফপি। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, হানিয়া তেহরানের উত্তরের একটি অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের আবাসিক কেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন। এ অবস্থায় তিনি ‘আকাশ থেকে নিক্ষিপ্ত একটি প্রজেক্টাইল’ দ্বারা নিহত হন। প্রাথমিক তথ্য অনুসারে, একটি রকেট আঘাত হানলে হানিয়া এবং তাঁর দেহরক্ষী মারা যান। ইরানের নবম প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া মঙ্গলবার থেকে তেহরানে অবস্থান করছিলেন। গাজা যুদ্ধ শুরুর পর তিনি বেশ কয়েকবার তেহরান সফর করেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি কাতারের রাজধানী দোহায় বসবাস করতেন। হানিয়া হত্যাকান্ডের ঘটনায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সশস্ত্র শাখা এর প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। এ হত্যাকান্ডের কঠোর জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছে ইরানও। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ হামলার নিন্দা জানিয়েছে। হামাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সামি আবু হামলার ঘটনার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে বলেছেন, ‘এই দখলদার বাহিনীর হাতে ভাই হানিয়া হত্যাকান্ড মারাত্মক বাড়াবাড়ি। হামাসের মনোবল এবং আমাদের জনগণের মনোবল ভেঙে দিয়ে ভুয়া লক্ষ্য অর্জন করাই এর উদ্দেশ্য। আমরা নিশ্চিত করে বলছি এই বাড়াবাড়ি কোনো কাজে আসবে না, লক্ষ্যও পূরণ হবে না।’ তিনি উল্লেখ করেন, হামাস একটি ধারণা, একটি প্রতিষ্ঠান। এটি কোনো ব্যক্তি নয়। তারা এই পথেই চলবে। তাতে যত ত্যাগ তিতিক্ষাই থাকুক না কেন। আমরা জয় পাওয়ার ব্যাপারে আস্থাশীল। এরই মধ্যে ইরানের শক্তিশালী বাহিনী ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড জানিয়েছে, হানিয়াকে হত্যার কঠিন প্রতিশোধ নেওয়া হবে। তারা এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘তেহরানে গুপ্তহত্যার শিকার হানিয়ার হত্যাকান্ডের জবাব হবে কঠোর ও বেদনাদায়ক। ইরান এবং প্রতিরোধ বাহিনী এই অপরাধের জবাব দেবে।’ পাশাপাশি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ইমাম খামেনি বলেছেন, ‘(হানিয়াকে হত্যার) এই পদক্ষেপের মাধ্যমে (ইসরায়েলের) অপরাধী, জঙ্গি ও জাওনবাদী শাসকরা কঠিন শাস্তি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। ইরানের ভূখন্ডে হানিয়ার রক্ত ঝরেছে, প্রতিশোধ নেওয়া এখন আমাদের কর্তব্যে পরিণত হয়েছে।’ হানিয়ার মৃত্যুতে গতকাল থেকে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে তেহরান। সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইসমাইল হানিয়া শহীদ হওয়ার কারণে ইরানে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোকের ঘোষণা দেওয়া হলো।’
অন্যদিকে ইসরায়েলের ঐতিহ্য বিষয়ক মন্ত্রী বলেছেন, ‘বিশ্বকে ময়লা মুক্ত করার এটিই সঠিক পথ। আর কোনো মনগড়া শান্তি/আত্মসমর্পণ চুক্তি নয়। আর কোনো দয়া নয়। লৌহমুষ্টিতে তাদেরকে আঘাত করাই শান্তি বয়ে আনবে, কিছুটা হলেও স্বস্তি আনবে। যারা শান্তির আকাক্সক্ষা করে তাদের সঙ্গে আমাদের শান্তিতে বসবাসের সক্ষমতা বাড়বে। হানিয়ার মৃত্যু বিশ্বকে আরেকটু ভালো অবস্থানে নিয়ে গেছে।’
এদিকে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান নিজেদের আঞ্চলিক অখন্ডতা, সম্মান, গৌরব, মর্যাদা রক্ষা করবে এবং সন্ত্রাসী হামলাকারীদেরকে তাদের কাপুরুষোচিত কর্মকান্ডের জন্য পস্তানোর ব্যবস্থা করবে।’ পাশাপাশি ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি এক বিবৃতিতে হানিয়ার ওপর হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে বলেছেন, ‘অপরাধী এবং সন্ত্রাসী ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠী আমাদের অতিথিকে আমাদের বাড়িতে হত্যা করে আমাদেরকে মর্মাহত করেছে। কিন্তু তারা একাজ করে নিজেদের জন্যও কঠোর সাজা পাওয়ার পট প্রস্তুত করেছে।’
হামাস ও ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ টেলিগ্রামে এক বিবৃতিতে বলেছে, মহান এই নেতাকে (হানিয়া) হারিয়ে হামাসে আমাদের প্রিয় ভাইরা যে বেদনা ভোগ করছে, শত্রুর প্রতি যে ক্রোধ অনুভব করছে, তার সঙ্গে আমরাও একাত্মতা প্রকাশ করছি। সেই সঙ্গে আমাদের আন্দোলনের নেতারা তাদের জনগণের নেতৃত্ব দেওয়া এবং মুজাহিদীনদের শহীদানের যে ত্যাগ স্বীকার করছেন তাতে গর্বও অনুভব করছি। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া হত্যার তীব্র নিন্দা করে একে ‘কাপুরুষোচিত কাজ ও বিপজ্জনক তৎপরতা’ বলে মন্তব্য করেছেন। এক বিবৃতিতে তিনি ফিলিস্তিনিদের ‘ধৈর্য ধরার ও ঐক্যবদ্ধ থাকার’ আহ্বান জানিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী রিচার্ড মার্লেস বলেছেন, ‘এই ব্যক্তি (হানিয়া) গত বছর ৭ অক্টোবরের হামলার ঘটনার মূলে ছিল। সেই ঘটনা যার নিন্দা আমরা অনবরতই জানিয়ে এসেছি।’
চীন ইসমাইল হানিয়া হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চীনের পরারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেছেন, ‘আমরা এ ঘটনার নিন্দা জানাই এবং দৃঢ়ভাবে এ হত্যাকান্ডের বিরোধিতা করছি। গাজায় যত দ্রুত সম্ভব একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতি অর্জিত হওয়া উচিত।’
মালয়েশিয়া ইসমাইল হানিয়া হত্যার ঘটনার দ্রুত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা এবং এর জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে। হত্যাকান্ড ঘিরে সত্য ঘটনাটি যতক্ষণ সামনে না আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত সব পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বানও এক বিবৃতিতে জানিয়েছে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
কাতার অত্যন্ত কড়া ভাষায় হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া হত্যার নিন্দা জানিয়েছে। তারা একে জঘন্য অপরাধ, বিপজ্জনক তৎপরতা এবং আন্তর্জাতিক ও মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে বর্ণনা করেছে। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এই হত্যাকান্ড এবং গাজায় বেসামরিক মানুষদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের বেপরোয়া আচরণ এ অঞ্চলকে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেবে এবং শান্তির সম্ভাবনা নস্যাৎ করবে। রাশিয়ার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী মিখাইল বোগদানভ বলেছেন, ‘এটি একটি রাজনৈতিক খুন। এমন খুন কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এই ঘটনা উত্তেজনা আরও বাড়াবে।’ তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, হানিয়া হত্যা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো অভিপ্রায় নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরায়েলকে থামাতে ব্যবস্থা না নিলে এই অঞ্চল আরও বড় ধরনের সংঘাতের মুখোমুখি হবে।
ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠীর সুপ্রিম রেভলিউশনারি কমিটির প্রধান মোহাম্মদ আলি আল-হুতি বলেছেন, ‘ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার নিশানা করা একটি জঘন্য সন্ত্রাসী অপরাধ এবং আইন ও আদর্শগত মূল্যবোধের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’
বড় হামলার আশঙ্কায় ইসরায়েল : ইরানের রাজধানী তেহরান ও লেবাননের রাজধানী বৈরুতে হামলা চালিয়ে হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া ও হিজবুল্লাহর এক উচ্চপদস্থ নেতাকে হত্যার কারণে ইসরায়েলে বড় হামলা হতে পারে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল। এমন আশঙ্কার মধ্যেই নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন যুদ্ধপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
হানিয়াকে কেন টার্গেট : হানিয়া মূলত থাকেন কাতারে। তিনি ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে তেহরানে গিয়েছিলেন। সেখানেই গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন তিনি। কেন এখন হানিয়াকে টার্গেট করা হলো- এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির সাংবাদিক জেরেমি বাউয়েন। তিনি বলেছেন, ‘আমি ইসমাইল হানিয়ার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করি ১৯৯০ সালে। তখন তিনি হামাসের একজন উদীয়মান নেতা ছিলেন। ৭ অক্টোবরের পর তার পরিবারকে টার্গেট করা হয়েছে। তার ছেলে ও নাতি-নাতনি ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন। হানিয়ার অন্যতম দিক হলো তিনি হামাসের অন্যান্য নেতাদের মতো আড়ালে থাকতেন না। আমি মনে করি ইসরায়েল হানিয়াকে হত্যা করেছে। যদিও তারা এখন পর্যন্ত মন্তব্য করেনি। কিন্তু কেন তারা হানিয়াকে এখন হত্যা করল? যখন পূর্বে তাদের সামনে অবশ্যই সুযোগ ছিল।’
জেরেমি বাউয়েন বলেন, রাজনৈতিকভাবে হানিয়াকে কাতারে হত্যা করা সম্ভব ছিল না। ইরানে তাকে হত্যার মাধ্যমে ইসরায়েলের একটি বার্তা পৌঁছেছে যে- কেউ নিরাপদ নয়। হানিয়া যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি চুক্তি আলোচনার অংশ ছিলেন। যার অর্থ এখন এগুলো আর সহজ হবে না। ইসমাইল হানিয়া দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের হিট লিস্টে ছিলেন। গত বছরের ৭ অক্টোবর যখন হামাসের যোদ্ধারা ইসরায়েলে হামলা চালান তখন দখলদার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে নির্দেশ দেন বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে হামাসের নেতাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার জন্য। ইরানে হানিয়াকে হত্যা করে ইসরায়েল বার্তা দিয়েছে যে, তারা চাইলে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রুর নাকের ডগায় যে কাউকে টার্গেট করতে পারবে।’