‘দলবাজ, দুর্নীতিবাজ ও ফ্যাসিস্টের দোসর’ বিচারপতিদের অপসারণ দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাই কোর্ট ঘেরাও কর্মসূচি কেন্দ্র করে গতকাল দিনভর উত্তাল ছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকাল সোয়া ৪টা পর্যন্ত নানা স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়। অন্যদিকে সকালে ১২ বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতির চায়ের দাওয়াতের খবর ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজনা বাড়ে সর্বোচ্চ আদালত এলাকায়। দুপুর সোয়া ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত একে একে ছয়জন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের মধ্যে চারজন ছুটিতে যাওয়ার কথা জানান।
পরে বিকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনা শেষে বিকাল ৪টার দিকে হাই কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে বিক্ষোভস্থলে এসে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ঘোষণা দেন আপাতত রবিবার থেকে হাই কোর্ট বিভাগে ১২ বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোনো বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না। ২০ অক্টোবর ষোড়শ সংশোধন মামলার রিভিউ আবেদন শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হবে। এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ঘোষণা দেন, বিচারপতি অপসারণের বিষয়ে রবিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে। এরপর পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানানো হবে। এরপর আন্দোলনকারীরা সুপ্রিম কোর্ট এলাকা ছেড়ে যান।
এদিকে কোন ১২ বিচারপতিকে বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না, তাঁদের নাম প্রকাশ করেনি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। তবে রেজিস্ট্রার জেনারেলের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন সন্ধ্যায় নিজের ফেসবুক আইডিতে ১২ বিচারপতির নাম তুলে ধরেন। এ ১২ বিচারপতির মধ্যে বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান, বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিন, বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামান, বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলন গতকাল প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করেন। তালিকায় থাকা অন্য ছয় বিচারপতি হলেন বিচারপতি আতাউর রহমান খান, বিচারপতি নাইমা হায়দার, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম খান, বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস ও বিচারপতি খিজির হায়াত।
এর আগে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে প্রথমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানারে ছাত্রদের ছোট একটি গ্রুপ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে মিছিল নিয়ে প্রবেশ করে। তারা হাই কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে। এদিকে এ ভবনের আরেক পাশে একই সময় বৈষম্য ও গণহত্যাবিরোধী আইনজীবী সমাজের ব্যানারে সুপ্রিম কোর্টের কিছু আইনজীবীকে স্লোগান দিতে দেখা যায়।
এরপর দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাই কোর্ট ঘেরাও কর্মসূচির মূল মিছিল সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় প্রবেশ করে। হাই কোর্টের মেইন বিল্ডিংয়ের সামনে দিয়ে মিছিল নিয়ে তাঁরাও অ্যানেক্স ভবনের সামনে গিয়ে অবস্থান নেন। এ সময় তাঁরা ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, শেখ হাসিনার দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান, হাই কোর্টের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান, ফ্যাসিজমের দালালেরা হুঁশিয়ার, সাবধান’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ বিচারপতিদের স্থান আদালতে হবে না। মামলার রায়ের জন্য কোটি টাকা লেনদেন হয়। বৈষম্যহীন বাংলাদেশে টাকার বিনিময়ে আসামি খালাস করা বন্ধ করুন। এসব বন্ধ না হলে যেখানেই অভিযোগ পাব, সেখানেই আমরা চলে যাব। ফ্যাসিস্টদের দোসররা নানা চেহারায় ফিরে আসছে বলে মন্তব্য করেন সারজিস আলম।
হাসনাত আবদুল্লাহকে আইনজীবীর বাধা : হাই কোর্ট ঘেরাও কর্মসূচি চলাকালে সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহকে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবীর বাধাদানের ঘটনা ঘটেছে। দুপুর ১টা ৫ মিনিটের দিকে যখন প্রধান বিচারপতির খাসকামরায় অভিযোগ থাকা বিচারপতিরা একে একে সাক্ষাৎ করতে আসছিলেন, ঠিক তখনই ওই ভবনের সামনে এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে একজন ক্যামেরাম্যান নিয়ে ভিডিও ধারণ করতে গিয়েছিলেন সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। ওই সময় আইনজীবী শাহ মো. বাবর তাঁকে বাধা দিয়ে বলেন, ‘আপনারা এখানে আসতে পারেন না। এখানে বক্তব্য দেবেন না।’ এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এ সময় হাসনাতের সঙ্গে ১০-১২ জন লোক ছিল। আইনজীবী শুরুতে একাই ছিলেন। পরে কয়েকজন আইনজীবী গিয়ে দুই পক্ষকেই থামিয়ে দেন। সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানান, ঘটনার পর রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ে হাসনাত ও আইনজীবীকে নিয়ে ঘটনার সমাধান করে দেওয়া হয়েছে।
বেঞ্চ পাচ্ছেন না ১২ বিচারপতি : বিকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর হাই কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে আন্দোলনস্থলে গিয়ে বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা। তিনি বলেন, বিচারপতির পদত্যাগ বা অপসারণের একটা প্রক্রিয়া আছে। বর্তমানে দেশে এ-সংক্রান্ত কোনো আইন নেই। বিগত সরকার সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছিল। একটা সংশোধন হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেটা বাতিল করে দিয়েছেন। সেটা আবার সরকার রিভিউ আকারে পেশ করেছে। আগামী রবিবার ২০ অক্টোবর সেটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগে শুনানি হবে। আজিজ আহমদ ভূঞা আরও বলেন, অন্যদিকে বিচারপতিদের পদত্যাগের আপনাদের যে দাবি, বিচারপতিদের নিয়োগকর্তা হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। পদত্যাগ বা অপসারণের সে উদ্যোগও রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে হয়ে থাকে। এখানে সুপ্রিম কোর্টের, প্রধান বিচারপতির যেটা করণীয়, উনি সেটা করেছেন। জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আপাতত ১২ জন বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোনো বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না। বেঞ্চ না দেওয়ার অর্থই হলো তাঁরা এই যে আগামী ২০ অক্টোবর কোর্ট খুলবে, তাঁরা বিচারকাজে অংশ নিতে পারবেন না। তিনি বলেন, বিচারপতি অপসারণের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট এককভাবে জড়িত নন। রাষ্ট্রপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও আইন উপদেষ্টা জড়িত আছেন। আপাতত ১২ জনকে বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না। পর্যায়ক্রমে শুনানির মাধ্যমে বাকিগুলো আপনাদের সামনে আসবে।
রবিবার বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা : বিচারপতি অপসারণ নিয়ে আগামী রবিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এরপর পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের সঙ্গে আলোচনার পর এমন সিদ্ধান্তের কথা জানান হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘বিচারপতি অপসরাণের সংশোধন নিয়ে মামলাটি চলমান আছে। আগামী ২০ তারিখ ওই মামলায় যদি সমাধান চলে আসে, তাহলে বিচারপতি অপসারণের দায়িত্ব হচ্ছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের। তাহলে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিচারপতিদের পদত্যাগ করতে হবে বা অপসারণ করা হবে। রবিবার বিকাল পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব। তারপর হচ্ছে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ।’