শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই এলোপাতাড়ি মামলা হচ্ছে দেশজুড়ে। নিহত পরিবারকে ব্যবহার করে সুযোগ সন্ধানীরা হয়ে উঠেছে তৎপর। তারা অনেক মামলায় প্রকৃত আসামিদের বাদ দিয়ে ফাঁদে ফেলছে সাধারণ মানুষকে। সাজানো এসব মামলার আসামি হয়ে তারা দিশাহারা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ঘুম থেকে উঠেই অজ্ঞাতনামা মোবাইল ফোনে জানতে পারি থানায় মামলা হয়েছে। এরপরই গা ঢাকা দিতে হয়। আগে হতো গায়েবি মামলা, এখন হচ্ছে এলোপাতাড়ি মামলা। প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে ভয়ংকর সব হৃদয়বিদারক নৃশংস ঘটনাগুলোকে। এ ধরনের মামলা প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করবে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মামলাগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এতে করে বিচারপ্রার্থীরা সুবিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর গায়েবি মামলায় হয়রানি, গ্রেপ্তার ও নির্যাতনে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের নির্দেশনা চেয়ে রিট হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তৈমুর আলম খন্দকার ২৪ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ রিট দায়ের করেন। আইনসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক ও র্যাবের মহাপরিচালককে রিটে বিবাদী করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটি শেষে রিটের শুনানি হবে বলে জানিয়েছিলেন সেই আইনজীবী। এর বাইরে যাচাই-বাছাই না করে মিথ্যা বা ভুয়া মামলা দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি না করার অনুরোধ এসেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে। গত সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের মাধ্যমে যারা অপতৎপরতা চালাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যেহেতু নিরপরাধ ব্যক্তিদের হত্যা মামলায় জড়ানোর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনাও বিশেষ নির্দেশনাও এসেছে তাই আসামি গ্রেপ্তারের আগে সঠিক তদন্তের ওপর জোর দিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে নিরপেক্ষ তদন্তের ক্ষমতা দিতে হবে। তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিবিড় সুপারভিশন ও জরুরি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জীবনে কখনো ঢাকায় থাকেননি। তবু ঢাকার হত্যা মামলার আসামি হয়েছেন একই পরিবারের চারজন। তারা হলেন মিজানুর রহমান মাতবর, তার চাচাতো ভাই জিয়াউর রহমান এবং তাদের ভাতিজা মো. কামাল ও নাজমুল হোসাইন সিদ্দিকী। মিরপুর-১০ নম্বরে গত ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইকরামুল হক। এ ঘটনায় ৭ সেপ্টেম্বর ইকরামুলের বাবা মো. জিয়াউল হক বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় ৭৩ জন আসামির মধ্যে তারাও রয়েছেন।
মিজানুর রহমান ও জিয়াউর রহমান দাবি করেন, তারা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এ কারণে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তারেক বিন সিদ্দিকী ১৬ বছর আগে তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়ে এলাকাছাড়া করেন। তারা কক্সবাজারেই অন্য এলাকায় থাকেন। কখনো ঢাকায় থাকেননি।
আরও ঘটনা
রবিউল ইসলাম রবি। পুরান ঢাকার আরমানিটোলা ১০১ এসসিসি রোডের ‘উত্তরা ট্রেডার্সের’ মালিক। কেরানীগঞ্জ আতাসুরে পরিবার নিয়ে থাকেন। গ্রামের বাড়ি পাবনা। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তবে বংশাল থানার ইয়াসিন আহমেদ রাজ হত্যা মামলার এজাহারে তাকে ১৩ নম্বর আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে তার পরিচয় দেওয়া হয়েছে তিনি ৩২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা। গত ৫ আগস্ট রাত ৯টার দিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান পিকআপ ভ্যানচালক রাজ। গত ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ইয়াসিন আহমেদ রাজ হত্যার ঘটনায় মামলা করেন তার মা সাহিদা বেগম।
মামলা দায়েরের পর থেকেই পলাতক রবি। তার দোকানে মাঝেমধ্যে গিয়ে হাজির হচ্ছেন স্থানীয় কিছু ব্যক্তি। নিজেদের একটি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী বলে দাবি করেছেন। মামলা থেকে বাঁচাতে রবির কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছেন তারা। পুরান ঢাকার চাঞ্চল্যকর আকবর শেট হত্যা মামলার ৩ নম্বর আসামিও ছিলেন তাদের একজন। রবিকে ফোন দিলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভাই খুব বিপদে আছি। জীবনে রাজনীতি করি নাই। এখন মামলা খাইলাম। বলা হইছে আমি নাকি যুবলীগ করতাম। কন কই যাই!!’
১০ লাখ টাকা চাঁদার বিষয়ে জানতে চাইলে কাঁপা কাঁপা স্বরে তিনি বলেন, আর বিপদে ফেইলেন না ভাই। ব্যবসাপাতি সব শেষ হইয়া যাইতাছে। আপনার সঙ্গে পরে কথা কমু নে।
মো. শাহরিয়ার জামাল তুর্য। বংশাল থানা ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তিনি স্থানীয় গোবিন্দ দাস লেনের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি। দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও বংশাল থানার বংশাল থানার ইয়াসিন আহমেদ রাজ হত্যা মামলার ১৫ নম্বর আসামি তিনি। এজাহারে তার পরিচয় দেওয়া হয়েছে ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউনিট যুবলীগের সহ সভাপতি।
তুর্য বলেন, ভাই আমি ব্যবসা করে খাই। রাজনীতি করতে যামু কেন? তবে স্থানীয় পঞ্চায়েতের সভাপতি। সবাই মিলে আমাকে সভাপতি বানাইছে। ন্যায়ের পক্ষে কথা কওয়া জন্মসূত্রে পাইছি। এর লাইগ্যা সাবেক এমপি সোলায়মান সেলিমের কাছে বিচারও দিছিল দুর্বৃত্তরা। এহন দেহি মামলায় যুবলীগের সহ সভাপতি বানাইয়া ফালাইছে। মামলার বাদী সাহিদা বেগম এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি বাবা লেখাপড়া জানি না। আমার ছেলে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। আমি পুলিশকে আসামি করতে বলছিলাম। অন্য আসামিদের কাউকে আমি চিনি না। জানা গেছে, রাজ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ২৭ জন। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে ৩০০ জনকে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিস্টার মুসতাসীম তানজীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সত্যিকার মামলায় ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে হয়রানির উদ্দেশ্যে কাউকে যুক্ত করলে মামলার মেরিটে স্বাভাবিকভাবেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে এই ক্ষেত্রে অভিযোগ যুক্তিসংগত সন্দেহের বশে করা হয়েছে নাকি হয়রানির জন্য করা হয়েছে তা মামলার মেরিট নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আর মিথ্যা সাক্ষী দিলে তার জন্য আইনে পর্যাপ্ত শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।
ঢাকার মিরপুর মডেল থানাসংলগ্ন মিরপুর শপিং কমপ্লেক্সের সামনে ৫ আগস্ট গুলিতে আহত হয়ে পরে মারা যায় রিতা আক্তার (১৭)। এ ঘটনায় করা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও পুলিশসহ ৩৯৫ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে মিরপুর-১ নম্বরের মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ী আফরোজ উদ্দিন ও শাহ আলী থানার ডি ব্লকের বাসিন্দা কাজী জয়নালের নামও রয়েছে।
ব্যবসায়ী আফরোজ উদ্দিনের দাবি, তাকে ফাঁসানো হয় তার ভাইয়ের হত্যা মামলা তুলে না নেওয়ার কারণে। তিনি বলেন, ২০০৫ সালে চাঁদার জন্য শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের নেতৃত্বে দুর্র্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা তার বড় ভাই ব্যবসায়ী আফতাব উদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করে। ভাইয়ের হত্যা মামলার আসামিরাই তাকে রিতা হত্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে।
মামলার বাদী রিতার বাবা মো. আশরাফ আলী। তিনি পেশায় রিকশাচালক। থাকেন মিরপুর ২ নম্বর সেকশনে। গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাটের কালাইয়ে। তিনি বলেন, ‘আমাকে সই করতে বলেছে, তখন আমি সই করেছি। আসামি যে কতজন হয়েছে, তা আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না।’