বাড়ছে রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়ে নতুন আশা, কর্মচাঞ্চল্যতা ফিরেছে আর্থিক খাতে ► খুলেছে প্রায় সব পোশাক কারখানা ► বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে ডলার সরবরাহ ► ব্যবসা-বাণিজ্য আস্থার সংকট কাটছে ► ব্যাংক খাতের সংস্কার শুরু হওয়ায় নতুন করে বিনিয়োগের পরিকল্পনায় বিনিয়োগকারীরা
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্থবির হয়ে পড়া অর্থনীতি ধীরে ধীরে গতিশীল হচ্ছে। অর্থনীতির সব সূচকেই ইতিবাচক চিত্র দেখা যাচ্ছে। বাড়ছে রেমিট্যান্স, পোশাক কারখানাগুলোয় উৎপাদন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে সংস্কার কার্যক্রম জোড়ালোভাবে শুরু হওয়ায় নতুন করে আস্থার সঞ্চার হচ্ছে। কর্মচাঞ্চল্যতা ফিরেছে আর্থিক খাতে। ব্যবসা-বাণিজ্যে আস্থার সংকট কাটছে। ব্যাংক খাতের সংস্কার শুরু হওয়ায় নতুন করে বিনিয়োগের কথা ভাবছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।
অবশ্য এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি করছে বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ। বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েই চলেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসেই (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ঋণ পরিশোধ ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময় ২০৩ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। গতবারের একই সময়ের ৪৩ শতাংশ বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে ৮০ কোটি ডলার হয়েছে। এই চাপ সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে। একইভাবে সরকারের বাজেট বাস্তবায়ন বা প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দেওয়ার একমাত্র প্রতিষ্ঠান এনবিআর তাদের আয় বাড়াতে পারছে না। যা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি সেপ্টেম্বরের প্রথম ২৮ দিনে দেশে এসেছে ২০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে দেশে এসেছে প্রায় ৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স। যা সাম্প্রতিক সময়ের রেকর্ড। এতে করে ডলারের সরবরাহ আগের তুলনায় অনেকটা বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়তে শুরু করেছে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ (গ্রস) দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২১ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর থেকে প্রবাসীরা আবারও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়িয়ে দেন। সাধারণ মানুষ কাজে ফিরতে শুরু করেন। খোলা হয় সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানা। ফলে বিরাট এক ধাক্কার পর আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। চলতি মৌসুমে কৃষি উৎপাদন ভালো হওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। যদিও পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসা উজান ঢলের কারণে দেশের কয়েকটি জেলার কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সাধারণ মানুষ ও সরকারের প্রচেষ্টায় আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বানভাসি মানুষও। এদিকে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ প্রায় সব উন্নয়ন সহযোগী বাংলাদেশকে সহযোহিতা বৃদ্ধি ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ ইতোমধ্যে সহায়তা বাড়িয়েছেও। ফলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন আশার সঞ্চার হতে শুরু করেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ৫ আগস্টের আগের অবস্থা আর পরের অবস্থা পুরোটাই বিপরীত। ফলে এখন মানুষের আস্থা বাড়বে। এ ছাড়া বহির্বিশ্বেও একটা ইতিবাচক সিগনালও যাচ্ছে। যা আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করছে। তবে আমাদের যে সংস্কার কার্যক্রমগুলো শুরু হয়েছে তা ঠিকঠাক করতে না পারলে আমরা আবারও বিপদে পড়ে যেতে পারি বলে মনে করেন তিনি। তবে বর্তমানে দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে অস্বস্তিকর হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, এক বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে এত মূল্যস্ফীতি আগে দেখা যায়নি। মূল্যস্ফীতির চাপ সবচেয়ে বেশি পড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর। যদিও গত আগস্টে মূল্যস্ফীতির এই চাপ সামান্য কমে এসেছে বলে জানিয়েছে বিবিএস। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়াবে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। সরকার এই মূল্যস্ফীতির চাপ কমিয়ে আনতে নিত্যপণ্য আমদানির ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিনিসপত্রের দাম কমাতে হলে এ খাতের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। একই সঙ্গে উৎপাদন খরচ কমাতে হবে।
অবশ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সুদের হার বাড়িয়েছে। এখন ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার সাড়ে ১৩ শতাংশ হয়েছে। জুলাই মাসের পর থেকে ৯ শতাংশ থেকে সুদের হার বাড়ানো শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সুদের হার বাড়িয়ে সরকার বাজারের অর্থের প্রবাহ কমাতে চায়। এতে মানুষের হাতে টাকা কম যাবে, ফলে চাহিদাও কমবে-এমন প্রত্যাশা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন এতে বিপত্তিও আছে। কেননা মানুষের হাতে টাকার প্রবাহ কমে গেলে দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) কমে যেতে পারে।
সরকার মনে করে রপ্তানি খাতের পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো হচ্ছে। তবে সেটার গতি মন্থর গত চার মাসের রপ্তানি আয়ের সফলতায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অবশ্য এই রপ্তানি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ কম। অন্তর্বর্তী সরকার রপ্তানি বাড়াতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে।