বিগত আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক স্বার্থে ইচ্ছেমতো সামষ্টিক অর্থনীতির পরিসংখ্যান তৈরি করেছে বলে অর্থনীতির শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে এই প্রতিবেদন তুলে দেওয়ার পর প্রবৃদ্ধি নিয়ে যেসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, সেগুলো কতটা বাস্তব ছিল সেটা নিয়েও গণমাধ্যমের কাছে প্রশ্ন করেছে কমিটি।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শুধু প্রবৃদ্ধির তথ্য নয়, বরং বিগত সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতি, দারিদ্র্য, অসমতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, শক্তি, আর্থিক, রাজস্ব ও মুদ্রানীতিতে দেওয়া পরিসংখ্যানও কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। তথ্য পরিবেশন অত্যন্ত অস্পষ্ট এবং প্রতারণামূলক উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রবৃদ্ধির গতি অনেক কম ছিল এবং গত এক দশকে প্রবৃদ্ধির তথ্য ছিল সরকারি তথ্যের বিপরীত। যেমন ৪-৫ শতাংশ বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির যে গুণগতমান অর্জিত হয়েছিল, তা আয়, সম্পদ এবং সুযোগ বৃদ্ধির অসমতার কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। পদ্মা সেতু মেট্রোরেলের মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, উন্নয়নের সঙ্গে তুলনা করলে তাতে দুর্নীতিই হয়েছে বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার একটি গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাওয়া অর্থনীতিকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। কাঠামোগত সংস্কারের স্থবিরতা, সংস্কারের বিপরীতমুখিতা, প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়, বৈশ্বিক প্রতিকূলতা এবং বাস্তবতার সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের ধারণার মধ্যে বাড়তে থাকা ব্যবধানের একটি গল্প আমরা পেয়েছি। এগুলো অর্থনীতিকে একটি নিম্ন-মধ্যআয়ের প্রবৃদ্ধির ফাঁদে নিয়ে গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অতিরিক্ত প্রবৃদ্ধির বদঅভ্যাস একটি পরিসংখ্যানগত কৌশল বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে মোট দেশ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অতিরঞ্জিত করার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে, কিন্তু অতিরঞ্জনের মাত্রা গত দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বিভিন্ন পরামর্শ এবং তথ্যপ্রমাণ যুক্ত করে মূল্যস্ফীতির হারকে কম দেখানো হয়েছিল। সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো সংরক্ষণ, প্রতিবেদন এবং একত্রিত করা তুলনামূলকভাবে সহজ হলেও এগুলোর মধ্যে বড় ধরনের ভুল রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সফটওয়্যারের মাধ্যমে হিসাব করার কারণে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের তথ্য তুলনামূলকভাবে পক্ষপাতহীন মনে হলেও রপ্তানির তথ্য সংশোধনের কারণে তাতে পরিবর্তন এসেছে। ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিবেদনে বিতর্ক উঠে এসেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবায়ন নিয়েও।
এ ছাড়াও আর্থিক খাতের ব্যালান্স শিটের তথ্য মানসম্পন্ন হিসাবায়নের চর্চা থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে বলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, কর আদায়ের তথ্য সাধারণত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অতিরঞ্জিতভাবে প্রকাশ করত। অভিযোগ রয়েছে অনেক সময়ে এটি এনবিআরের শীর্ষ পর্যায় থেকে সচেতনভাবে করা হতো এবং অডিটর জেনারেলের অফিস থেকে পরিবর্তন হতো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ তথ্য এবং প্রশাসনের তথ্যের মধ্যে মিল না থাকা সামাজিক সূচকে উল্লেখযোগ্য গোলমাল নির্দেশ করে। বলা হয়েছে, জনগণের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ঝুঁকি এবং পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন সামাজিক সূচকের জরিপের তথ্য সরকারি তথ্যের সঙ্গে মেলাতে সংগ্রাম করতে হয়। দারিদ্র্য নির্ণয় এবং তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি সংশোধনের ফলে ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দারিদ্র্য আগের তুলনায় কমেছে। তথ্য উৎপাদন এবং প্রতিবেদন সম্পর্কে রাজনৈতিক প্রভাব বিগত সরকারের আমলে একটি নজিরবিহীন উচ্চতায় পৌঁছেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকৃত মূল্যস্ফীতি ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) ৯ থেকে ১১-এর চেয়ে ১৫ থেকে ১৭ শতাংশের মধ্যে থাকতে পারে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি সমীক্ষায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ পাওয়া গেছে। যা আনুষ্ঠানিকভাবে পরিসংখ্যান ব্যুরো ৭ দশমিক ৯ শতাংশে জানিয়েছিল।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ২০১৯-২০ থেকে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে মোটা চাল, সয়াবিন তেল, মসুর ডাল, পিঁয়াজ, মাছ, গরুর মাংস, মাটন এবং ডিমের (গ্রামীণ ওজন ব্যবহার করে) মূল্য পরিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে বার্ষিক গ্রামীণ খাদ্য মূল্যস্ফীতির গড় হার ১১ দশমিক ৭ শতাংশ প্রস্তাব করেছিল। ওই সময়ে পরিসংখ্যান ব্যুরো গ্রামীণ খাদ্য মূল্যস্ফীতি জানিয়েছিল ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। গবেষণাপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়েছে চলতি বছরের জুলাই মাসে বিবিএস ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঘোষণা করলেও ওই সময় মানুষ প্রকৃতপক্ষে ১৮ দশমিক ১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি অনুভব করেছে।