২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বেশ কিছু চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসী জেল থেকে বেরিয়ে আসে। এর ফলে অশান্ত হয়ে উঠেছে আন্ডারওয়ার্ল্ড। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা শুরু করেছে নতুন করে চাঁদাবাজি। এ ছাড়া ৫ আগস্টের পর অনেক সন্ত্রাসী পক্ষ বদল করছে। দীর্ঘদিন সাবেক ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় লালিত এসব সন্ত্রাসীর অনেকেই ভোল পাল্টে ফেলেছে। নতুন করে শুরু করেছে চাঁদাবাজি। ফলে বেড়েছে সন্ত্রাস, হত্যাকাণ্ড।
গত ১৫ মাসে রাজধানীতে দুই ডজন খুনের নেপথ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম এসেছে। অন্তত ২০ স্থানে হামলা, জখম, দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীদের জড়িত থাকার কথা জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। মগবাজার, মতিঝিল, বাড্ডা, গুলশানসহ কিছু এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও অন্যের হয়ে ভাড়ায় খাটছে শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ তাদের সহযোগীরা। এদের প্রধান লক্ষ্য চাঁদাবাজি। সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত অপরাধ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এসবের নেপথ্যে রয়েছে চাঁদাবাজি। বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় বিএনপি নেতা কামরুল আহসানকে (সাধন) গুলি করে হত্যা করা হয়। কেবল টিভি, ইন্টারনেটের সংযোগসহ চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে ঘটা এ হত্যাকাণ্ডে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের সহযোগীদের নাম এসেছে। এর আগে ১৯ এপ্রিল হাতিরঝিলে ওয়ার্ড যুবদলের সদস্য আরিফ সিকদারকে গুলি ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানতে পারে, এ হত্যার নেপথ্যেও আছেন সুব্রত বাইন। হত্যার কারণ হাতিরঝিল, মগবাজারসহ আশপাশ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এর সুযোগ নেয় সন্ত্রাসীরা। আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে অন্তত ছয়জন জামিনে মুক্তি পান। তাদের মধ্যে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ‘কিলার আব্বাস’ হিসেবে পরিচিত মিরপুরের আব্বাস আলী, তেজগাঁওয়ের শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল ও হাজারীবাগের সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন। এ ছাড়া ঢাকার অপরাধজগতের আরও দুই নাম খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসুও কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই এক থেকে দেড় যুগের বেশি কারাগারে ছিলেন। এর বাইরে ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর গোপন স্থান থেকে ফিরে প্রকাশ্যে তৎপরতা শুরু করেছেন অনেকে। তাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে বিদেশে চলে গেছেন, এমন তথ্যও রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। এ ছাড়া আগে থেকেই যারা বিদেশে অবস্থান করছেন, তাদের অনেকে দেশে ফিরে বিভিন্ন এলাকায় নতুনভাবে তৎপরতা শুরু করেন। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সম্পদ দখলের ঘটনায় নাম আসতে থাকে তাদের। এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জেরে বিভিন্ন এলাকায় আতঙ্ক তৈরি হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন এলাকায় আতঙ্ক তৈরি করে আধিপত্য বিস্তার করছে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। জমি ও সম্পদ দখল, কোরবানির পশুর হাটের নিয়ন্ত্রণ, কেবল টিভির সংযোগ, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবসা ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিতে খুন-জখমসহ বিভিন্নভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি করছে তারা। সম্প্রতি মগবাজার-হাতিরঝিল এলাকায় কয়েক দফা গোলাগুলি ঘটেছে। এ এলাকার একটি সন্ত্রাসী দল সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে অস্ত্র আনার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছে একজন গোয়েন্দা সূত্র। আধিপত্য বিস্তারের এ প্রতিযোগিতায় নিজেদের মধ্যেও খুনাখুনিতে জড়াচ্ছেন অনেকে।
যুবদলের সদস্য আরিফ সিকদার হত্যার তদন্তসংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছেন, মগবাজার-রামপুরার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের সঙ্গে দুবাইয়ে পলাতক আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদের দ্বন্দ্ব রয়েছে। হাতিরঝিল, মগবাজার ও রামপুরা বিএনপির যে অংশের সঙ্গে জিসানের যোগাযোগ আছে, তাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন আরিফ সিকদার। এজন্য সুব্রত বাইনের অনুসারীরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারেন।
১৪ মে একটি বেসরকারি ব্যাংকের এক কর্মকর্তাকে মুঠোফোনে কল করে শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ পরিচয়ে হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। ঘটনার বিষয়ে ভুক্তভোগী কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, নিজেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের লোক পরিচয় দিয়ে চাঁদা দাবি করা হয়েছে। এর আগে মহাখালী ও নিকেতনের ময়লাবাণিজ্য (বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ) নিয়ন্ত্রণের ঘটনায় আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ কুমার বিশ্বাসের নাম আসে। বিদেশি একটি নম্বর থেকে আসা ফোনকল এবং কয়েক দফা হামলার ঘটনায় ২১ থেকে ২৪ অক্টোবর ওই এলাকার বর্জ্য সংগ্রহ, রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া এবং নালা পরিষ্কারের কাজ টানা চার দিন বন্ধ ছিল।
পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ডিএনসিসির আওতাধীন ২০ নম্বর ওয়ার্ডের এ এলাকার ময়লাবাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিল স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. নাছিরের হাতে। ৫ আগস্টের পর স্থানীয় বিএনপি নেতারা এর নিয়ন্ত্রণ নেন। এর মধ্যেই সন্ত্রাসী বিকাশের পরিচয়ে ঠিকাদারপ্রতিষ্ঠানকে মুঠোফোনে কল দিয়ে ময়লা সংগ্রহের কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়। কথা অনুযায়ী কাজ বন্ধ না রাখায় কয়েক দফা হামলা চালানো হয়।
শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ আগারগাঁওয়ে জোড়া খুন, ছাত্রলীগের নেতা জরিপ হত্যাসহ বেশ কয়েকটি হত্যা ও চাঁদাবাজি মামলার আসামি ছিলেন। ১৯৯৭ সালে তিনি গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। দীর্ঘ ১২ বছর কারাভোগের পর ২০০৯ সালে জামিনে মুক্ত হন তিনি। এরপর পালিয়ে যান বিদেশে। বর্তমানে বিদেশে বসেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অপরাধজগতে প্রভাব বিস্তার করছেন বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র।
মতিঝিলের অপরাধজগতের অন্যতম দুই আলোচিত নাম বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক ও দুবাইয়ে পলাতক আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ। মতিঝিলের বাইরে বাড্ডা এবং রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের খুন, দখল, চাঁদাবাজিসহ নানান অপরাধকর্মে বিভিন্ন সময়ে জিসানের নাম আসে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছেন, বাড্ডা ও গুলশানে বর্তমানে জিসানের সহযোগীদের বাইরে চার সন্ত্রাসী গ্রুপ ও তাদের সহযোগীদের নাম সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসছে। এ গ্রুপগুলোর নেতৃত্বে আছেন সুব্রত বাইন, মেহেদী, রবিন ও বাড্ডার হেলাল উদ্দিন। এর মধ্যে মেহেদী যুক্তরাষ্ট্রে ও রবিন মালয়েশিয়ায় আছেন বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা সূত্র। রবিনের ভাই হিসেবে এলাকায় পরিচিত মাহবুব এখন এ এলাকায় চাঁদাবাজির ঘটনায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। আর হেলালের বাড়ি উত্তর বাড্ডায়। তবে গ্রেপ্তার আতঙ্কে তিনি এলাকা ছেড়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের নাওড়ায় বেশির ভাগ সময় থাকছেন। কখনো কখনো তাকে গুলশানেও দেখা যায়।
গত ২০ মার্চ রাতে গুলশানের পুলিশ প্লাজার সামনের সড়কে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় সুমন মিয়া ওরফে টেলি সুমনকে। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো জানান, কেবল টিভি সংযোগ ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবসার আড়ালে সন্ত্রাসী দলের হয়ে কাজ করতেন সুমন। বাড্ডা-গুলশানের রবিন গ্রুপের সদস্য ছিলেন তিনি। র্যাব জানিয়েছে, গুলশান ও বাড্ডায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সন্ত্রাসী মেহেদী ও রবিন গ্রুপের বিরোধের জেরে খুন হন সুমন। মেহেদীর নির্দেশে তাকে খুন করতে পাঁচজনের একটি ‘কিলার গ্রুপ’ কাজ করে। সুমন হত্যার নেপথ্যের কারণ সম্পর্কে র্যাব জানায়, ওয়াসির মাহমুদের মাধ্যমে গুলশান ও বাড্ডার চাঁদা সংগ্রহ করতেন সন্ত্রাসী মেহেদী। সন্ত্রাসী রবিন গ্রুপের হয়ে একই এলাকায় চাঁদাবাজি শুরু করেন সুমন। গুলশানের বিভিন্ন বিপণিবিতানে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মেহেদী গ্রুপের সঙ্গে রবিন গ্রুপের বিরোধ তৈরি হয়। এর জেরে মেহেদীর নির্দেশে সুমনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন ওয়াসির মাহমুদ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো আরও জানিয়েছেন, বর্তমানে ফার্মগেট ও আশপাশ এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী শেখ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলামের কিছু তৎপরতা রয়েছে। মহাখালীতে কিছু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তরা নিজেদের শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমাম হোসেনের সহযোগী বলে পরিচয় দিয়েছেন।
শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশে সন্ত্রাসীদের রীতিমতো চাঁদাবাজির উৎসব শুরু হয়েছে। পদ্মার চরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, খুন, চাঁদাবাজি ও বালু লুটের ঘটনায় ‘কাকন বাহিনী’র নাম সামনে আসছে। পুলিশ ৯ নভেম্বর ‘অপারেশন ফার্স্ট লাইট’ নামে অভিযান চালিয়ে ৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু এতে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। আসল চাঁদাবাজরা ধরাছোঁয়ার বাইরে এখনো। এভাবে জেলায় জেলায় নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে সন্ত্রাসী চক্র। চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ জনজীবন।