পাবনার ভাঙ্গুড়া পৌরসভার মসজিদ পাড়ায় বুদ্ধি প্রতিবন্ধী তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে স্থানীয়ভাবে সালিশি বৈঠকে মারধর ও জরিমানা করার কয়েক ঘণ্টা পরই অভিযুক্ত যুবকের রেললাইনে দ্বিখন্ডিত মরদেহ পাওয়া গেছে। ঘটনাটি শুধু একটি মৃত্যুর রহস্যই নয়, গ্রাম্য সালিশের নামে স্বেচ্ছাচারী, প্রভাবশালীদের ‘বিচার-বাণিজ্য’ ও আইনবহির্ভূত শাস্তির দেয়ার প্রশ্ন উঠেছে।
রেললাইনে আত্মহত্য করা যুবক হাফিজুল ইসলাম (২৪) পেশায় ছিলেন দিনমজুর। তিনি ভাঙ্গুড়া পৌর সদরের মসজিদপাড়া মহল্লার মৃত ছাবেদ আলীর ছেলে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে প্রতিবেশী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী এক তরুণীকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করার অভিযোগ ওঠে হাফিজুলের বিরুদ্ধে। ঘটনাটি প্রত্যক্ষদর্শী তরুণীর চাচি চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন এসে হাফিজুলকে ধরে একটি কক্ষে আটকে রাখে। কিন্তু কড়া পাহারার মধ্যে আটক থাকা যুবক হঠাৎ করেই পালিয়ে যাওয়ারও অভিযোগ তোলে তারা। এ বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়রা কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না হাফিজুল পালালো কিভাবে।
ঘটনার দিন রাতেই ধর্ষণের বিষয়টি নিয়ে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতা ও স্থানীয় সাবেক কাউন্সিলর বরাত আলী বাড়িতে সালিশ বৈঠক বসে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মোন্নাফ কসাই, রবিউলসহ আরও কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। প্রথমে জরিমানা ধার্য করা হয় পাঁচ লাখ টাকা। হাফিজুরের পরিবার হতদরিদ্র হওয়ায় পরে তা কমে আসে আড়াই লাখ টাকাতে। এই সালিশ চলাকালেই কয়েকজন উপস্থিত ব্যক্তি হাফিজুলকে মারধর করেন বলে দাবি স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের।
এদিকে সালিশের রাত পেরোতেই শুক্রবার সকালে পার্শ্ববর্তী চাটমোহর উপজেলার গুয়াখড়া এলাকায় রেললাইনে পড়ে থাকা মরদেহটি শনাক্ত হয় হাফিজুলের মরদেহ হিসেবে।
স্থানীয় মানবাধিকারকর্মী শহিদুল ইসলাম বলছেন, ধর্ষণের মতো সংবেদনশীল মামলায় আইন অনুযায়ী অভিযোগ নেওয়া, মেডিকেল পরীক্ষা, তদন্ত সবই হওয়া উচিত ছিল থানা পুলিশের মাধ্যমে। কিন্তু সেখানে বসেছে গ্রাম্য সালিশ, জরিমানা নির্ধারণ, এবং শারীরিক নির্যাতন। এ ধরনের ‘বিচারবহির্ভূত সালিশ সংস্কৃতি’ শুধু ভুক্তভোগী নয়, অভিযুক্ত এমনকি পুরো সমাজকেই ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
সাবেক কাউন্সিলর বরাত আলী প্রথমে সালিশের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, "আমি বাইরে আছি, পরে কথা বলব। শালিস করা মোন্নাফ কসাইও একইভাবে অস্বীকার করে ফোন কেটে দেন।
সালিশে উপস্থিত থাকা হাফিজুলের মামা রবিউল ইসলাম বলেন, আমরা আমাদের পারিবারিক টাকা-পয়সার বিষয়ে কাউন্সিলর বরাত আলীর বাসায় বসে ছিলাম। তবে হাফিজুলকে জরিমানা ও মারধরের বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।
চাটমোহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মঞ্জুরুল আলম বলেন, আমরা মরদেহ উদ্ধার করে সিরাজগঞ্জ রেলওয়ে পুলিশকে হস্তান্তর করেছি। বিষয়টির বিস্তারিত আর খোজ নেয়া হয়নি।
সিরাজগঞ্জ রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল হোসেন বলেন, আইনগত প্রক্রিয়া শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরে শুক্রবার রাতেই পারিবারিক ভাবে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। তবে ছেলের এই ঘটনার পর মা নির্বাক, কারোর সাথেই স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছেন না।
ভাঙ্গুড়া থানার ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, ছেলেটি ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে বলে জেনেছি। ঘটনাস্থল আমাদের থানার বাইওে হওয়ায় আর খোজ খবর নেয়া হয়নি। তবে ধর্ষনের পর সলিসী বৈঠকে জরিমানা ও মারধোরের ঘটনা আমরা কিছুই অবগত নই।
তবে স্বজন ও স্থানীয়রা দাবি করছেন, সালিশি বৈঠকে ঠিক কী ঘটেছিল, কেমন করে মারধর করা হয়েছিল, সালিশকারীরা কেন থানা পুলিশকে অবহিত করেন নাই। আত্মহত্যার পেছনে কোন প্ররোচনা আছে কি না খতিয়ে দেখার আহ্বানও জানান তারা।
বিডি প্রতিদিন/এএম