শুক্রবার ছুটির দিনে সকালে সবারই একটু আলসেমিতে পেয়ে বসে। কেউ ঘুম থেকে উঠেও বিছানায় গা এলিয়ে থাকেন আরও কিছুক্ষণ। কেউ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সংবাদপত্রে চোখ রাখেন। এমন এক অলস সকালে কেঁপে উঠল বাংলাদেশ। আতঙ্কিত মানুষ দৌড়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। কেউবা চরম বিপদের শঙ্কায় ঘরেই কোনো কোনায় আশ্রয় নিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে থাকলেন। ২১ নভেম্বর সকালের ভূমিকম্পের কথাই বলছি। এ রকম কাঁপুনি দিয়ে ভূমিকম্প আগে কখনো দেখিনি আমরা অনেকেই। ২৬ সেকেন্ডের এ ভূমিকম্প যেটুকু ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে বেশি আতঙ্কিত করেছে আমাদের সবাইকে। কারণ এর উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশেই, নরসিংদীর মাধবদী। এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছে প্রকৃতির কাছে আমরা কতটা অসহায়। ভূমিকম্প এমন এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যার আগাম সতর্কবার্তা দেওয়া যায় না। তাই ভয় আর শঙ্কা নিয়েই আমাদের জীবন এগিয়ে নিতে হবে। মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগ আমরা আগে থেকেই অনুমান করতে পারি। ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবার্তা আমরা পাই না। কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি এবং সচেতনতা এর ক্ষতি কমাতে পারে। সেদিক থেকে মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগ একটু চেষ্টা করলেই থামানো যায়।
২১ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। সশস্ত্র বাহিনী দিবস। আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক, মাতৃভূমির অতন্দ্র প্রহরী সশস্ত্র বাহিনী দিবসটি উদ্যাপন করা হয় গৌরবের সঙ্গে। এদিন সেনাকুঞ্জে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন সরকারপ্রধান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের গণ্যমান্য ব্যক্তি। সেনাকুঞ্জের সংবর্ধনায় প্রদত্ত ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের পথে যাত্রা হবে।’ নির্বাচনবিরোধী নানান প্রতিকূলতা এবং ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে প্রধান উপদেষ্টা দেশকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বারবার তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে তিনটি বিষয়ে তাঁর অবস্থান তুলে ধরেছেন-
প্রথমত ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদের নির্বাচন হতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। দ্বিতীয়ত এবারের নির্বাচন হবে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন। মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দেবে। তৃতীয়ত সরকার সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশের জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। বিগত তিনটি নির্বাচনে তারা ভোট দিতে পারেনি। শুধু দেশের মানুষ নয়, সারা বিশ্ব তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন কূটনৈতিক মহল নির্বাচনের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনও পুরোদমে প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক চলছে। দলগুলোও এখন নির্বাচনমুখী। সারা দেশে প্রধান প্রধান দলের প্রার্থীরা এখন সরব। তাঁরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। গোটা দেশে একটি নির্বাচনি আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। এর পরও একটি দুর্যোগের শঙ্কায় সবাই উৎকণ্ঠিত। সেই শঙ্কার নাম আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। সাধারণ নাগরিক থেকে রাজনৈতিক দলের নেতা, নির্বাচন কমিশন থেকে সরকার সবাই একবাক্যে স্বীকার করছেন, আগামী নির্বাচনের প্রধান চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে না পারলে নির্বাচন উৎসব ম্লান হয়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
এর কারণ দেশের বিরাজমান অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, গত এক মাসে ১৫৩টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। অর্থাৎ দিনে পাঁচজনের বেশি মানুষ নিহত হচ্ছে। এ হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগই রাজনৈতিক বিরোধে। চট্টগ্রামে একজন প্রার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যের বিরুদ্ধে সহিংস হয়ে উঠছে ক্রমে। সারা দেশে অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। গত বছরের ৫ আগস্ট থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার হয়নি পুরোপুরি। সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে। নির্বাচন সামনে রেখে নতুন করে মাথা চাড়া দিয়েছে সন্ত্রাসীরা।
ক্ষমতার পালাবদলের প্রেক্ষাপটে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা নতুন করে ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তারের জন্য সন্ত্রাসে লিপ্ত হচ্ছে। দেশজুড়ে বেড়েছে চাঁদাবাজি, দখলদারি, ছিনতাই এবং নানানরকম অপরাধ। মানুষ অসহায়। একমাত্র ভরসা সেনাবাহিনী। এ পরিস্থিতিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এখন সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সে কাজটি দক্ষতার সঙ্গে করতে হবে সরকারকে।
এটা করতে না পারলে ভোটাররা নিজেদের অনিরাপদ মনে করবেন। ভোটের দিন সহিংসতার আশঙ্কায় ভোট দিতে যাবেন না। তখন এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার সংকটে পড়বে। কম ভোটার উপস্থিতি হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তা অংশগ্রহণমূলক হিসেবে বিবেচিত হবে না। এটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সৃষ্টি করবে ভূমিকম্প। ভেঙেচুরে যাবে জুলাই বিপ্লবের স্বপ্ন। মনে রাখতে হবে, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গেই হবে গণভোট। এ গণভোটের ওপর নির্ভর করছে রাষ্ট্র সংস্কারের ভবিষ্যৎ। কমসংখ্যক ভোটার উপস্থিতি জুলাই সনদ প্রশ্নবিদ্ধ করবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন মানে হলো ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি। সেটা না হলে নির্বাচন না হবে উৎসবমুখর, না হবে গ্রহণযোগ্য।
আর উৎসবমুখর নির্বাচনের প্রধান শর্তই হলো ভোটারদের নিরাপত্তা। ভোটাররা যেন নির্ভয়ে এবং নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে যেতে পারেন তা নিশ্চিত করা। আর সেটা করতে হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
ঘোষিত সময়ে নির্বাচন হলে আগামী বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে করতে হবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের সময় আছে তিন মাসেরও কম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এখন বহাল থাকলে এই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করত। অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো দায়িত্ব নিয়ে সবার আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি করেছিল। চারটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারই প্রথমে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে মনোযোগ দিয়েছিল। তারপর তারা সারা দেশে সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। এসব না করলে নির্বাচনের স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে না।
রাজনৈতিক দলগুলো অবিলম্বে বর্তমান সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করার আহ্বান জানিয়েছে। সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। অবিলম্বে সরকারকে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। দেশের জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। নাগরিকরা যেন নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এটা করতে না পারলে রাজনৈতিক ভূমিকম্পে তছনছ হয়ে যাবে গণতন্ত্র, আমাদের স্বপ্ন।