শুক্রবার, ১০ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

মহানবীর স্মৃতিবিজড়িত মক্কা-মদিনা

মোস্তফা কাজল

মহানবীর স্মৃতিবিজড়িত মক্কা-মদিনা

পবিত্র হজ এবং ওমরাহ উপলক্ষে প্রতি বছর লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি সৌদি আরবের পবিত্র নগরী মক্কা-মদিনায় আসেন। অনেকে প্রিয় নবীর স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন এলাকায়ও ছুটে যান। এসব নিয়েই আজকের আয়োজন...

 

মসজিদুল আল খায়েফ

যেখানে নামাজ আদায় করেছেন ৭০ নবী

মসজিদুল আল খায়েফ। মক্কা নগরী থেকে আট কিলোমিটার দূরে জামারার (শয়তানকে পাথর মারার স্থান) কাছে অবস্থিত। আরবি ভাষায় পাহাড়ের চেয়ে নিচু এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উঁচু স্থানকে খায়েফ বলা হয়। খায়েফ মসজিদ হচ্ছে মক্কার কাফেরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের এক স্মৃতিচিহ্ন। 

পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতার অন্যতম হলো- শয়তানের প্রতীকী স্তম্ভে কঙ্কর নিক্ষেপ করা।  কঙ্কর নিক্ষেপের স্থানের কাছে ঐতিহাসিক ‘মসজিদুল আল খায়েফের’ অবস্থান। এই মসজিদে ৭০ জন নবী নামাজ আদায় করেছেন। মসজিদের সামনে স্থাপিত সাইনবোর্ডে ৭টি ভাষায় লেখা রয়েছে মসজিদের নাম। এমনকি বাংলায়ও লেখা আছে-আল খায়েফ মসজিদ। আল সওর পাহাড়ের বিপরীত দিকের পাহাড়ের পাশেই প্রতিষ্ঠিত এ মসজিদ। বিশাল মসজিদটি কঙ্কর নিক্ষেপ করতে আসা হাজীদের মনে করিয়ে দেয় ইতিহাসের অনেক ঘটনা। বৃহদাকার মসজিদের উঁচু মিনারগুলো দূর থেকে দেখা যায় যেন সেগুলো পাহাড়ের চূড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত রসুলুল্লাহ (সা.) এই মসজিদে নামাজ আদায় করেছেন। তিনি নামাজ শেষে বলেছিলেন, এখানে ৭০ জন নবী সমাহিত হয়েছেন। হজরত নবী করিম (সা.) বিদায় হজের সময় মসজিদ আল খায়েফে নামাজ পড়েছেন। এই মসজিদের অনেক ফজিলত হাদিস ও ইতিহাসের গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে। ইতিহাসে আছে, পঞ্চম হিজরিতে ইহুদিদের প্ররোচনায় মক্কার কাফেররা মদিনায় হামলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য তারা কিছু আরব গোত্রের সঙ্গে চুক্তি করে।  চুক্তি করার জন্য মক্কার কাফেররা এ স্থানটি বেছে নেয়। পরে সে স্থানেই খায়েফ মসজিদ নির্মাণ করা হয়। মূলত মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফের গোত্রগুলোর ঐক্যের ব্যর্থতার নিদর্শন হিসেবে মসজিদটি দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত ঘোষণা করছে ইসলামের বিজয়গাথা। ঐতিহাসিক বর্ণনায় আছে, ২৪০ হিজরিতে এক প্রলয়ঙ্করী বন্যায় খায়েফ মসজিদ ধসে পড়ে। তবে বন্যা শেষ হওয়ার পরপরই মসজিদটি আবার নির্মাণ করা হয়। এর চারপাশে বন্যা প্রতিরোধ ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়। সে সময় এই মসজিদের দৈর্ঘ্য ছিল ১২০ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৫৫ মিটার। সে হিসাবে এটি ছিল ওই সময় আরব অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মসজিদ। এমনকি তখন মসজিদে হারামের চেয়েও বড় ছিল এই মসজিদের আয়তন। খায়েফ মসজিদে এখন ৩০ হাজার মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের চারকোণায় অবস্থিত চারটি সুউচ্চ মিনার মসজিদটিকে দিয়েছে অপার সৌন্দর্য।

 

মহানবী (সা.)-এর প্রতি সম্মান

মক্কা নগরীর আদব

বিশ্ব মুসলিমের প্রধান সম্মিলনস্থল পবিত্র নগরী মক্কা। আল্লাহতায়ালার ঘর কাবা সব মুমিন-মুসলমানের হৃদয়ের স্পন্দন। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হজ, ওমরাহ ও পরিদর্শনে এ পবিত্র নগরীতে যারা প্রবেশ করবেন তাদের উচিত এ নগরীর পবিত্রতা, আদব ও সম্মান রক্ষা করা। এ ব্যাপারে হাদিসে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। বাইতুল্লাহর সম্মানের কারণে হেরেমের সীমানায় শিকার করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমন কি শিকারিকে শিকারের বিষয়ে পথ-প্রদর্শন বা কোনো ধরনের সহযোগিতা করাও হারাম। পূর্বকাল থেকেই বাইতুল্লাহর প্রাঙ্গণ নিরাপদ ও সম্মানিত। কিয়ামতকাল পর্যন্ত নিরাপত্তা ও সম্মানের এ ধারা চলমান থাকবে। হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত ইহা (পবিত্র নগরী মক্কা ও বাইতুল্লাহ) আল্লাহ প্রদত্ত সম্মানের ভিত্তিতে সম্মানিত। সুতরাং হেরেম এলাকায় কাঁটাযুক্ত গাছও কাটা যাবে না।  হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ বুখারিতে হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন পবিত্র নগরী মক্কায় আসতেন তখন ‘জি-তুওয়া’ নামক স্থানে রাত যাপন করতেন। ভোরে গোসল করতেন। সেখানেই ফজর নামাজ আদায় করতেন। পরে পবিত্র নগরী মক্কায় প্রবেশ করতেন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন করতেন। সুতরাং হজ, ওমরাহ ও জিয়ারত উপলক্ষে যারা পবিত্র নগরী মক্কা ও বাইতুল্লাহয় আগমন করবেন; তারা সুন্নাত আদায়ে গোসল করবেন। পরে নগরীতে প্রবেশ করবেন। যদি কেউ এ পবিত্র নগরী ও বাইতুল্লাহর সম্মানে জেদ্দা থেকে গোলস করে রওয়ানা দেন তবে তার সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে।

 

কাবা শরিফ

এক ছাতার নিচে ২৫০০ মুসল্লি

লকডাউনের সময় কাবা শরিফের আঙিনায় তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ছাতা। একটি ছাতার নিচে অবস্থান করতে পারবেন ২৫০০ মুসল্লি। বাইতুল্লাহর চত্বর থেকে প্রায় ৩০ মিটার উচ্চতায় স্থাপন করা হচ্ছে এসব ছাতা। ছাতাটি দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে ৫৩ মিটার। প্রতিটি ছাতার ওজন হবে প্রায় ১৬ টন। সব মিলিয়ে এক একটি ছাতা হবে ২৮০৯ বর্গমিটার। এ ছাড়া হারাম শরিফের ছাদের ওপরে ৮টি হাই টেকনোলজি সাইজের ছাতা বসানো হয়েছে। পাশাপাশি হারামের উত্তর পাশে ৫৪টি নতুন ছাতা বসানো হয়েছে। সব কটি ছাতা মিলে প্রায় ১৯ হাজার ২০০ বর্গফুট স্থান জুড়ে ছায়া দেবে। নতুন স্থাপিত ছাতাগুলোর নিচে একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারবেন প্রায় ৪ লাখ মুসল্লি। কাবা শরিফের ছাদও মডেল ছাতার ছায়াতলে থাকবে। ভাঁজ করা এ ছাতাগুলোতে আছে নামাজের ওয়াক্ত দেখার জন্য বড় ঘড়ি। আরও থাকছে ডিজিটাল এইচডি স্ক্রিনে। আগত ওমরা ও হজযাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা। ছাতাগুলো এসির সাহায্যে গরমে ঠান্ডা দেবে। হাজী ও প্রার্থনাকারীদের বিশ্রামের জন্য ছাতার নিচে থাকবে ২২টি বেফ ও হাই সিকিউরিটি ব্যবস্থা। ছাতাগুলো খোলার সময় মনে হবে যেন বাগানে ফুল ফুটছে। এ ছাতা নির্মিত হলে বায়তুল্লাহ চত্বরসহ কাবা শরিফের দৃশ্য হবে দৃষ্টিনন্দন ও অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপনা। প্রচন্ড রোদের তীব্রতা থেকে সুরক্ষা দিতেই নির্মাণ করা হয়েছে এসব ছাতা। বিগত ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে পবিত্র দুই মসজিদের খাদেম প্রয়াত বাদশাহ মালিক আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ আল-সউদ প্রচন্ড তাপমাত্রায় হজ ও ওমরাহ পালনকারীদের কষ্টের কথা চিন্তা করেই এসব ছাতা নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। হজ ও ওমরাহ পালনকারীদের সুবিধার্থে মদিনার মসজিদে নববীর ভিতরের উন্মুক্ত স্থান ও বাইরের আঙিনায় স্থাপিত ভাঁজ করা ছাতার আদলেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ছাতা স্থাপনের জন্য বিগত ১৫ সালের ডিসেম্বরে কাজ শুরু হয়েছিল। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে এ কাজ সম্পন্ন করেছেন হারামাইন কর্তৃপক্ষ। সৌদি সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় জাপানের প্রযুক্তি জেনারেল প্রেসিডেন্সি টু হলি মস্ক নামের একটি কোম্পানি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভাঁজ করা ছাতা নির্মাণ কাজের অংশ নেয়। এ কাজে ২৫ জন অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারের নেতৃত্বে দক্ষ টেকনিশিয়ান ও সেফটি এক্সপার্টরা এ কাজে অংশ নিয়েছিলেন।

 

পবিত্র কাবা শরিফের গিলাফের কথা

প্রথম দেখায় মনে হবে কালো গিলাফে আবৃত পবিত্র কাবা শরিফ। কালো গিলাফ কে  কিসওয়া বলা হয়। কালো গিলাফে ঢাকা কাবা শরিফ মুসলিম উম্মাহর আবেগ-অনুভূতির সর্বোচ্চ স্থান। এ গিলাফ যেন কাবা শরিফকে অপার্থিব গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছে। পবিত্র কাবাকে ঘিরে রাখা এ গিলাফের আর্ট ও সোনার সুতায় বোনা ক্যালিওগ্রাফি মুমিন মুসলমানের হৃদয়ে তৈরি হয় ভালোলাগা এবং ভালোবাসা। অনুভূত হয় অন্যরকম এক মায়াবি আকর্ষণ। সৌদি আরবের উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. নাসের বিন আলি আল-হারেসির তথ্য থেকে জানা যায়, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ে পবিত্র কাবা শরিফে গিলাফ ব্যবহৃত হতো না। কাবাঘরে গিলাফ ব্যবহারের সঠিক তারিখ জানা না গেলেও পবিত্র নগরী মক্কা ও তায়েফে প্রাপ্ত শিলালিপিতে খচিত আরবি ক্যালিওগ্রাফি সূত্রে জানা যায়, ৪০ হিজরি সনের দিকে আরবি ক্যালিওগ্রাফির উন্নত স্টাইল তখন অধিক প্রচলিত ছিল। বর্তমান সময়ে একই স্টাইলের আদলেই পবিত্র কাবা শরিফের গিলাফে সোনার সুতায় আরবি ক্যালিওগ্রাফি খচিত হচ্ছে। কাবাঘরের গিলাফে আরবি নান্দনিক ক্যালিওগ্রাফি উপস্থাপনের বিষয়ে ড. হুসাইন আল-মাওজানের গবেষণায় যে তথ্যে উঠে এসেছে, মিসরের মামলুক সালতানাতের আমলে কাবার ভিতর ও বাইরে আলাদাভাবে গিলাফে আবৃত করা হতো এবং আরবি ক্যালিওগ্রাফি দিয়ে অলঙ্কৃত করা হতো। ৭৬১ হিজরিতে মামলুক আমলের সুলতান নাসের হাসান বিন মুহাম্মদ বিন কালাউনের সময় কাবার ভিতরের ক্যালিওগ্রাফি খচিত গিলাফের একখন্ড এখনো সংরক্ষিত আছে। তবে কাবার গিলাফের ভিতর-বাইরে উভয় অংশে শৈল্পিক এবং নয়নাভিরাম ক্যালিওগ্রাফির অলঙ্করণ শুরু করেন তুর্কি উসমানীয় সুলতানরা। তাদের সময়ে ক্যালিওগ্রাফির সবচেয়ে নান্দনিকশৈলী সুলুস ও জালি সুলুসের ব্যবহার শুরু হয়। মামলুক সুলতানদের সময়ে রায়হানি ও মুহাক্কাকশৈলীর কায়রো ধারায় ক্যালিওগ্রাফি ব্যবহৃত হতো। তবে কাবার চারপাশে মসজিদে হারামে কুফি কাইরোয়ানি, জাহরি-নাবতি লিপির অলঙ্করণ ছিল। ১৩৪৬ হিজরিতে কাবা শরিফের গিলাফ তৈরিতে বিশেষ কারখানা তৈরির বিষয়টি সামনে আসে এবং তৎকালীন সৌদি বাদশাহ আবদুল আজিজ আল-সৌদের নির্দেশক্রমে গিলাফ বা কিসওয়া তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৩৪৬ সালে ওই কারখানায় নির্মিত অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ক্যালিওগ্রাফিতে সজ্জিত কালো গিলাফ দ্বারা আবৃত করা হয় পবিত্র কাবা শরিফ। ‘কাবা শরিফের গিলাফের বাইরের কালো কাপড়ে স্বর্ণমন্ডিত রেশমি সুতা দিয়ে দক্ষ কারিগর দিয়ে ক্যালিওগ্রাফি করা হয়। এরপর ঝারনিখ কালি দিয়ে প্রথমে কাপড়ে ক্যালিওগ্রাফির আউটলাইন দেওয়া হয়, তারপর কারিগররা হরফের ভিতর রেশমি সুতার মোটা লাইন বসিয়ে স্বর্ণের সুতা দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে হরফ ফুটিয়ে তোলেন। গিলাফের কালো জমিনে স্বর্ণের সুতার ঢেউ খেলানো বুননের ক্যালিওগ্রাফির সোনালি আভা এক জান্নাতি আবেশ ছড়িয়ে দেয়। হজরে আসওয়াদের ওপর অংশে আল্লাহু আকবর ক্যালিওগ্রাফিসহ বর্তমানে গিলাফের অধিকাংশ ক্যালিওগ্রাফি মুখতার শোকদারের হস্তলিখিত। প্রতি বছর কাবা শরিফের গিলাফ পবিত্র হজের দিন সকালে (৯ জিলহজ) পরিবর্তন করা হয়। কাবা শরিফের গিলাফ নির্মাণে যেসব জিনিসপত্র প্রয়োজন সেগুলো তৈরির বিশেষ কারখানা মক্কার উম্মুল জুদ এলাকায় অবস্থিত। নতুন গিলাফ তৈরি করতে দরকার হয় ১২০ কেজি সোনার সুতা, ৭০০ কেজি রেশম সুতা ও ২৫ কেজি রুপার সুতা। গিলাফটির দৈর্ঘ্য ১৪ মিটার এবং প্রস্থ ৪৪ মিটার। গিলাফের সেলাই কাজে অংশগ্রহণ করে দেড় শতাধিক অভিজ্ঞ দর্জি। গিলাফ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় বিশেষ মেশিন। কালো সিল্কের কাপড়ের ওপর কুরআনুল কারিমের আয়াত অঙ্কনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় সোনা ও রুপা তৈরি সুতা। কাবা শরিফের গিলাফ তৈরির পর তা বিশেষ বৈদ্যুতিক প্রক্রিয়ায় তাপ দেওয়া হয়। যাতে তা প্রচন্ড রোদ ও তাপের কারণে অবিকৃত থাকে।

 

জান্নাতুল বাকি (মদিনা)

পবিত্র হজ এবং ওমরাহয় মৃত্যু হলে...

হজ এবং ওমরাহযাত্রী সৌদি আরবে মারা গেলে মরদেহ দেশে পাঠানো হবে নাকি সেখানে দাফন করা হবেÑ এ নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে। প্রতি বছর পবিত্র হজ এবং ওমরাহ পালন করতে গিয়ে অনেক বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। হজ এবং ওমরাহ পালনে সৌদি আরবে আসার আগে প্রত্যেক ওমরাহ এবং হজযাত্রী হজে গমনের আবেদনপত্র পূরণ ও স্বাক্ষর করেন। সেই আবেদনপত্রে সবাইকে অঙ্গীকার করতে হয়, সৌদি আরবে মৃত্যু হলে মরদেহ সেখানেই দাফন করা হবে। কোনোভাবেই বাংলাদেশে আনা যাবে না। এমন কি কোনো ধরনের ওজর-আপত্তি থাকবে না। পরিবার-পরিজনের কোনো আপত্তি গ্রাহ্য করা হবে না। সৌদি আরবে ওমরাহ ও হজ করতে যাওয়া বাংলাদেশি হজযাত্রীর বাড়ি বা সড়কে দুর্ঘটনা অথবা হাসপাতাল থেকে মৃত্যুর সংবাদ জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হয়ে নিকটস্থ হাসপাতাল অথবা বাংলাদেশ হজ কার্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে চিকিৎসকের সনদ সংগ্রহ করতে হয়। এরপর মৃতদেহ শনাক্ত করা হয়। এ কাজটি মৃত হাজির আত্মীয়স্বজন বা কাছের কেউ করে থাকেন। কেউ না থাকলে সত্যায়িত করার জন্য বাংলাদেশের মোয়াল্লেম অফিস থেকে মৃতের ছাড়পত্র সংগ্রহ করতে হয়। ছাড়পত্রের সব ধরনের ফরম মক্কা-মদিনাস্থ বাংলাদেশ হজ কার্যালয় থেকে সনদপত্র সংগ্রহ করা হয়। মক্কায় হজযাত্রী মারা গেলে মসজিদুল হারামে জানাজা হয়। আর মদিনায় মারা গেলে মসজিদে নববীতে জানাজা হয়। জেদ্দায় মারা গেলে জেদ্দায় জানাজা হয়। জানাজা শেষে মক্কার শারায়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। মদিনার জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে অথবা জেদ্দায় কবরস্থানে দাফন করা হয়। মক্কা ও মদিনা দুই জায়গাতেই প্রায় প্রতি ওয়াক্তেই ফরজ নামাজের পর জানাজা হয়। হজযাত্রী এবং আশপাশের এলাকার স্থানীয় সৌদি নাগরিক মারা গেলে তাদের জানাজা এই দুই পবিত্র মসজিদে হয়ে থাকে। কোনো কোনো ওয়াক্তে একাধিক জানাজাও হয়ে থাকে। মক্কার বলিদিয়ার (সিটি-করপোরেশন) কর্মকতা জানান, কোনো হজযাত্রী মারা গেলে লাশ গোসল করানো, কাফনের কাপড় পরানো, জানাজা পড়ানো, দাফন করাসহ যাবতীয় কাজ নির্দিষ্ট সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ করে থাকে। হজ কিংবা ওমরাহ করতে এসে কোনো হজযাত্রী অসুস্থ হলে বাংলাদেশ মেডিকেল মিশনে চিকিৎসকদের কাছ থেকে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ গ্রহণ করেন। চিকিৎসক রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে বিভিন্ন হাসপাতালে, যেমনÑ বাদশাহ আবদুল আজিজ হাসপাতাল, বাদশাহ ফয়সাল হাসপাতাল, আল নূর বিশেষায়িত হাসপাতাল, আজইয়াদ হাসপাতালে, বাদশাহ আবদুল্লাহ মেডিকেল সিটি, মদিনার আনসার হাসপাতাল রেফার্ড করেন। এর বাইরে মক্কা-মদিনায় এলাকাভিত্তিক অসংখ্য ক্লিনিক রয়েছে। হাজীদের জন্য সব স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স সেবাও দেওয়া হয়। এ ছাড়া হজের সময় মিনা, মুজদালিফা, আরাফাতে অনেক ক্লিনিক ও হাসপাতালে হাজীদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। তবে আমাদের দেশের মতো চাইলে যে কেউ ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে পারেন না। ওষুধ কিনতে হলে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র দেখাতে হয়। আর চিকিৎসকের কাছে গেলেও ইকামা বা সৌদি আরবে থাকার বৈধ অনুমতিপত্র দেখাতে হয়। ওমরা ও হজযাত্রীদের মোয়াল্লেমের দেওয়া পরিচয়পত্র দেখাতে হয়।

 

আরাফাতের ময়দান

৪০ বার পবিত্র হজ বন্ধের কারণ

ইসলামের ১৪০০ বছরের ইতিহাসে হজ স্থগিত কিংবা স্বল্প পরিসরে আয়োজনের ঘটনা ঘটেছে ৪০ বারের মতো। প্রতি বছরই কোনো না কোনো কারণে তা স্থগিত কিংবা অল্প আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। 

হজ বন্ধ থাকা বা স্থগিত হওয়ার কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- মহামারী রোগ, রাজনৈতিক অশান্তি, অর্থনৈতিক অশান্তি, নিরাপত্তাজনিত অস্থিরতা, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত, ডাকাত কিংবা হানাদারদের আক্রমণ কার্যক্রম। এসব কারণে কয়েক বছর হজ বন্ধ ছিল আবার কয়েক বছর হজ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো হলো-

২৫১ হিজরি ৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ : ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে ওই বছর হজ বাতিল হয়। আব্বাসীয় খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অংশ হিসেবে ইসমাইল বিন ইউসুফ আল-আলাউই সাফাক নামে পরিচিত গোষ্ঠী সে বছর পবিত্র নগরী মক্কার ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হয়। হজে সেখানে তারা অসংখ্য হাজীকে  হত্যা করে। ফলে সে বছর হজ স্থগিত করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।

৩২৭ হিজরি ৯৩০ খ্রিস্টাব্দ : হজের ইতিহাসে এ বছর সবচেয়ে খারাপ ঘটনা ঘটেছিল। ঐতিহাসিক হিসাব অনুযায়ী সে বছর ৩০ হাজারের বেশি হজপালনকারীর ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছিল। জমজম কূপকে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার মানসে প্রায় ৩ হাজার হাজীর মৃতদেহ এ কূপে ফেলা হয়েছিল। ওই বছর পবিত্র কাবাঘরে স্থাপিত হাজরে আসওয়াদ ভেঙে লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এরপর হাজরে আসওয়াদ ২২ বছর নিখোঁজ ছিল। এ ঘটনায় দীর্ঘ ১০ বছর হজ উদযাপিত হয়নি।

৩৫৭ হিজরি ৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ : আল-মাশিরি নামক অজানা রোগের কারণে ওই বছর হজ বাতিল করা হয়। অনেকে হজ পালন করতে রওয়ানা হয়ে পথেই মারা যান। হজযাত্রীদের বহনকারী উটগুলোও পথেই মারা যায়।

৩৯০ হিজরি ১০০০ খ্রিস্টাব্দ এবং ৪১৯ হিজরির ১০২৮ খ্রিস্টাব্দে  হজ স্থগিত ছিল। বিশ্বব্যাপী চরম মূল্য ও মুদ্রাস্ফীতি তথা ভয়াবহ অভাবের কারণে কেউই সে বছর হজ করতে পবিত্র নগরী মক্কায় আসেনি। এমনকি চরম অভাবের কারণে এ বছরগুলোতে পূর্ব অঞ্চল ও মিসর থেকেও কেউ হজে আসেনি।

৪৯২ হিজরি ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দ : চরম অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে এ বছর হজ পালন হয়নি। সে সময় বড় বড় রাজ্যগুলোতে মুসলমানরা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে নিয়োজিত ছিল। ফলে নিরাপত্তা ও অশান্তির কারণে কেউ হজে অংশগ্রহণের সাহস করেনি। ফলে ওই বছর হজ অনুষ্ঠিত হয়নি।

৬৪৫ হিজরির ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দ : ওই বছর থেকে মোট ৪ বছর অনুষ্ঠিত হয়নি। শুধু হিজাজের লোকজন সীমিত পরিসরে হজে অংশগ্রহণ করেছেন। সে সময় চলমান অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে কেউ হজে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।

১২১৩ হিজরি ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ : ওই সময় ফরাসি বিপ্লব চলছিল। হজযাত্রীদের চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এবং চলাচলের সড়ক অনিরাপদ হওয়ায় ওই বছর হজযাত্রীরা হজে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।

১২৪৬ হিজরির ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ : ওই সময়ের তথ্য মতে, ভারত থেকে আসা একটি মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। হজের সময়ে ছড়িয়ে পড়া এ মহামারীতে হজে অংশগ্রহণকারী (বেশির ভাগ) তিন-চতুর্থাংশ মানুষ মারা যান। ফলে ওই বছরও হজ অনুষ্ঠিত হয়নি।

১২৫২ হিজরি ১৮৩৭ এবং ১৩১০ হিজরি ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ : ওই সময়ের মধ্যে বেশ কয়েক বছর মহামারীর কারণে হজ অনুষ্ঠিত হয়নি। এ দীর্ঘ ৫৫ বছর সময়ের মধ্যে মহামারীর কারণে বেশ কয়েক বছর হজ করতে পারেনি হজযাত্রীরা। হজের মৌসুমে কলেরা মহামারীর প্রাদুর্ভাবে অনেক মানুষ মারা যাওয়ার ভয়ে অনেকেই হজে অংশগ্রহণ করেনি। ওই সময় কলেরায় অনেকে আরাফাতের ময়দানে মারা যান। আবার অনেকে মিনায় ধরাশায়ী হয়ে যান।

১৪৪১ হিজরি ২০২০ খ্রিস্টাব্দ : কভিড-১৯ নামক নভেল করোনাভাইরাসের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে হজ পালনকে স্থগিত করা হয়েছে। সীমিত আয়োজনে স্বল্প পরিসরে স্থানীয় ও দেশটিতে থাকা বিদেশিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে হজ। তবে হাজীদের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১০ হাজারের বেশি হবে না। এই ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির হজ ও ওমরা মন্ত্রণালয়।

সর্বশেষ খবর