ঢাকা, শনিবার, ২৫ মে, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

ধর্মতত্ত্ব
বুদ্ধিভিত্তিক জ্ঞানচর্চার পুরোধা ইমাম আবু হানিফা
ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ

বিশিষ্ট তাবিয়ি বিদগ্ধ আলেম ও ইজতিহাদ জগতের মেহেরবান রাহনুমা ছিলেন হজরত ইমাম আবু হানিফা। জ্ঞান রাজ্যের শ্রেষ্ঠতম গৌরবের বিশিষ্ট এই দিকপাল বুদ্ধিভিত্তিক গবেষণা কর্মের দুয়ার উন্মোচন করেন এবং মানুষের জীবন ও জগতের সব পরিবর্তনশীলতার মাঝেও নববী আদর্শের নিখুঁত অনুসারী হয়ে দুনিয়া ও আখেরাতের সার্বিক সফলতা অর্জনের পথ প্রদর্শন করেন। আজ মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্ঞানচর্চার যত দিকপাল আমরা দেখি সবাই তার কাছে ঋণী। সবাই ইমাম আবু হানিফার পথ ধরেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছেন। তিনি ইসলামের বিশুদ্ধ গবেষণা ও ইজতেহাদের পথিকৃৎ, তিনি এ মহাজগতের পুরোধা, তিনি ইমাম আজম।

পৃথিবীতে সক্রেটিস, প্লেটো, আইনস্টাইন প্রমুখ বিজ্ঞজন বিশ্বমানবতাকে জ্ঞান ও দর্শনের দীক্ষা দান করেছেন। তারা মানুষের জীবন ও জগৎ সুডৌল করার পথ ও পদ্ধতি তুলে ধরেছেন। কিন্তু তাদের সেসব দর্শন ও দিকনির্দেশনা ছিল একপেশে, একদিকদর্শী ও অপূর্ণ। তাদের দর্শনে জাগতিক সফলতার বহুবিদ উপকরণ বিদ্যমান কিন্তু মানুষের অন্তর, মানুষের মনোজগৎ, মানুষের মওত ও আখেরাতকে অভিষ্পিত পাওয়ার ব্যাপারে সেখানে কোনো নির্দেশনা নেই। এ ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা অনন্য। তিনি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি সাদা কালো নির্বিশেষে বিশ্ব মানবতার বিশ্বাস ও আকায়েদ, জ্ঞান ও চেতনা, নৈতিকতাবোধ, আচার-আচরণ দৈনন্দিন জীবন চলার নিখুঁত পথ ও পাথেয়, ইবাদত বন্দেগি, ওজিফা ওযায়েফ থেকে শুরু করে জীবনের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ ও সফলতার সহজসাধ্য নির্দেশনা পেশ করেন। তার সেই নির্দেশনা সব পরিবর্তনশীলতার চাকার সঙ্গে সর্বদা খাপ খাইয়ে চলার উপযোগী ও পূর্ণাঙ্গ।

কী সুন্দর। এ পথ ও পদ্ধতি তিনি নিজ মেধা থেকে নয়; পবিত্র কোরআন, মহানবীর সুন্নাহ ও সাহাবা চরিত্রের ভিত্তিমূলে উদ্ভাবন করেন। সুন্নাহর সুকঠিন নিক্তির অবলম্বনে একই সঙ্গে মানুষকে উপহার দিয়েছেন জীবন ও জগৎ সাজানোর এবং দুনিয়া ও আখেরাত কল্যাণকর বানানোর যুগপত্ভাবে পরিচালনার আলোকবর্তিকা। কী এক মহারাজপথ। আর উম্মতের সালাফ খালাফ নির্বিশেষে সবাই একবাক্যে তার বিস্ময়কর প্রতিভার স্বীকৃতি দেন এবং নিজেরাও সহযোদ্ধা হয়ে সম্মুখ পথ আরও সুগম করার অভিযানে অবতীর্ণ হন। আজ ভাবতে ভালো লাগে, ইউরোপের অনেক নামকরা দার্শনিক মুসলিমদের এ ইমামের প্রতিভা ও জ্ঞানের পরিধি, ব্যাপ্তি, গভীরতা ও সূক্ষ্মানুভূতি দেখে তাকে দর্শন জগতের ইনসানে কামিল আখ্যা দিয়ে সম্মান করে।

এখানে বলে রাখি, ইসলামে ইজতেহাদের দুয়ার কখনো বন্ধ করা হয়নি। ইজতেহাদের দুয়ার আগেও খোলা ছিল, এখনো খোলা আছে, ভবিষ্যতেও খোলা থাকবে। তবে জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে কোনো বিকৃতি সাধনের দুয়ার বন্ধ। অর্থাৎ ইজতেহাদের নাম ভাঙিয়ে ইসলাম বিকৃতির অপচেষ্টা করা কিংবা কেউ নিজের নিজস্ব কোনো ধ্যান ধারণাকে ভুল পথে ইসলামের লেবেল সাঁটিয়ে উম্মতের কাছে ইসলাম বলে বিক্রি করার সুযোগ চিরকালের জন্য বন্ধ।

তাই সেই তাবিয়ি যুগ থেকে আইন চলে আসছে যে, যিনি মুজতাহিদ হবেন তিনি অবশ্যই বিশুদ্ধ আকিদা ও চিন্তাধারার অধিকারী, কোরআন সুন্নাহর বিষয়ে প্রাজ্ঞ, সুউচ্চ মানের পণ্ডিত, উম্মতের কাছে স্বীকৃত, বিশাল আমানতদার, সর্ব বিষয়ে সচেতন ও সজাগ, শেষরাতের সেহেরগাহীসম্পন্ন, শ্রেষ্ঠ পরহেজগার, সগিরা ও কবিরা গুনাহ থেকে নিজকে হেফাজতের জন্য কঠোর মুজাহাদাকারী ব্যক্তিত্ব হবেন।

দুঃখের বিষয় আসমানি নেজাম থেকে এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট, ইজতেহাদের সেই জামানা শেষ হওয়ার পর ইমাম চতুষ্ঠয়ের সেই মেধা ও আখলাক পরবর্তীকালে অপর কোনো ব্যক্তিত্বের মধ্যে ফিরে পাওয়া যায়নি যেমনিভাবে ইমাম বোখারির ইন্তেকালের পর মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে গোটা জগতের কোথাও বোখারির মতো যোগ্য অপর কোনো মেধা আর দুনিয়ায় ফিরে আসেনি।

আমরা জানি, জীবন ও জগৎ তথা গোটা সৃষ্টিই মহান আল্লাহর অসীম কুদরতের উন্মুক্ত বহির্প্রকাশ। এ সৃষ্টির কোনো কিছুই স্থবির নয়; চলমান গতিশীল সদা সম্মুখের দিকে দ্রুত ধাবমান। সৃষ্ট জগতের এ গতিশীল স্পন্দনের সঙ্গে মানুষের জীবনও গতিময়, সদা সম্মুখ অগ্রসরমান, কেউ থেমে নেই, থেমে থাকবেও না। আবার মহান আল্লাহর নির্দেশ হলো; পরিবর্তিত কোনো পরিস্থিতিতেই সুন্নাহর উপেক্ষা করা যাবে না। হার হালতে মানুষ নিজেকে সুন্নাহর আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাখতে হবে। তাই এতসব পরিবর্তনশীলতা ও অগ্রসরমানতার পাশাপাশি উম্মতের মাঝে যদি ইমাম আবু হানিফা ও তার সহযোদ্ধাদের হামেশা চৌকান্না উপস্থিত না থাকত তাহলে পরিবর্তনশীলতার ঘূর্ণাবর্তে দুনিয়ার কত জায়গায় কত মানুষ যে সিরাতে মুস্তাকিম ও সুন্নাহর পথ থেকে হারিয়ে যেত তার কোনো ইয়ত্তা ছিল না।

লেখক :  উপপরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন।



এই পাতার আরো খবর