শনিবার, ২৫ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

অনেক রকম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ইমদাদুল হক মিলন

অনেক রকম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

স্কুলজীবনের শেষ পরীক্ষা হয়ে গেছে। হাতে অখণ্ড সময়। স্কুলমাস্টার বাবা ছেলেকে একটা কাজ দিলেন। ইংরেজি কবিতার অনুবাদের কাজ। ঘরে বসে এসব কবিতা অনুবাদ করতে করতে সমবয়সি এক বান্ধবীর উদ্দেশে নিজেই একটি কবিতা লিখে ফেলল সেই ছেলে। কবিতার নাম ‘একটি চিঠি’। ডাকে পাঠিয়ে দিল বিখ্যাত ‘দেশ’ পত্রিকায়। কিছু না বুঝেই পাঠানো। কবিতাটি ছাপাও হলো। ১৯৫১ সালের ৩১ মার্চ সংখ্যা ‘দেশ’ পত্রিকায় যে ছেলেটির এই কবিতা ছাপা হলো তাঁর নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলা ভাষার বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় লেখক। সাহিত্যের সব শাখায় কমবেশি বিচরণ করেছেন। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রস রচনা, নাটক, প্রবন্ধ আর বিপুল শিশু-কিশোর সাহিত্য। সব মিলিয়ে প্রকৃতই সব্যসাচী লেখক। তাঁর সময়কার সবচেয়ে বড় সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। বাংলাদেশের মাদারীপুরে। গ্রামের নাম মাইজপাড়া। ছেলেবেলায় কিছুদিন এই গ্রামে কাটিয়েছেন। তারপর কলকাতায়। টিউশনি দিয়ে জীবিকা শুরু। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে আর আসেননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এ দেশের সাহিত্যপ্রেমী মানুষ তাঁকে গভীরভাবে ভালোবেসেছে। ষাট দশক থেকে বেলাল চৌধুরী তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর। বেলাল ভাই ছিলেন অসাধারণ বাউণ্ডুলে। ষাট দশকের শুরুর দিকে কুমির শিকারের জাহাজে চড়ে কলকাতায় গিয়ে নেমেছিলেন। ভিড়েছিলেন সুনীলদের দলে। বহু বহু বছর পূর্ব পাকিস্তানে ফেরা হয়নি তাঁর। মাইজপাড়া গ্রামটির জন্য সুনীলের মন বড় কাঁদত। ’৯০ সালের মাঝামাঝি সেই গ্রামের এক ভদ্রলোক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়দের পৈতৃক ভিটা উদ্ধার করলেন। তাঁর নাম আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার। থাকেন আমেরিকায়। সুনীলদার মহা অনুরাগী। বাড়ি উদ্ধার করে সেখানে একটি পাঠাগার করলেন। প্রতিবছর সুনীলদার জন্মদিনে দুই দিনব্যাপী ‘সুনীল মেলা’ হয় এখন মাইজপাড়া গ্রামে। বেশ কয়েকবার সুনীলদা সেখানে এসেছেন। বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন। দেশভাগের বেদনা তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখত। তাঁর বিশাল উপন্যাস ‘পূর্ব-পশ্চিম’ পড়লে এই হাঁহাকার টের পাওয়া যায়। বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামটি এই উপন্যাসের অনেকখানি জুড়ে আছে। উপন্যাসের এক চরিত্র অতীন মালখানগরের। দেশভাগের ফলে সেই গ্রাম ফেলে উদ্বাস্তু হয়ে চলে গিয়েছিল কলকাতায়। মা মৃত্যুশয্যায়, ছেলে মাকে বলছে ‘তোমার শেষ ইচ্ছে কী?’ মা বললেন, ‘আমাকে মালখানগরে নিয়ে যা।’ এই একটি বাক্যে দেশপ্রেমের গভীর টান উপলব্ধি করা যায়।

এই মালখানগর বাংলা সাহিত্যের আরেক বিখ্যাত লেখকের গ্রাম। তাঁর নাম বুদ্ধদেব বসু। বেশ কাছেই আরেক গ্রাম ‘মালপদিয়া’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রাম। তাঁর মামাবাড়ির গ্রাম ‘গাওদিয়া’। এই গ্রামের পটভূমিতে লেখা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’। দেশভাগের ভয়ংকর সব ঘটনা এবং উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতার উপকণ্ঠে আশ্রয় নেওয়া পূর্ববঙ্গের ছিন্নমূল মানুষকে নিয়ে সুনীল লিখেছিলেন ‘অর্জুন’ নামের দুর্দান্ত এক উপন্যাস। সেই যে বান্ধবীর উদ্দেশে চিঠির আকারে লেখা কবিতা, সেই যে শুরু, তারপর ধীরে ধীরে জড়াতে লাগলেন সাহিত্যজগতে। কফি হাউসের আড্ডা, হৈ-হল্লা, সম্পূর্ণ বোহেমিয়ান জীবন, অবিরাম লিখে যাওয়া এবং পত্রিকা প্রকাশ ইত্যাদিতে এমনভাবে জড়ালেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, এক জীবনে সেখান থেকে আর বেরোতে পারেননি। ‘এক জীবনে’ নামে তাঁর একটি উপন্যাসও আছে। তাঁর আত্মজীবনীর নাম ‘অর্ধেক জীবন’। এক সন্ধ্যায় আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘অর্ধেক জীবন’ নাম দিলেন কেন? মৃদু হেসে বললেন, ‘জীবনের সব কথা তো লিখতে পারিনি! বাঙালি লেখক হিসেবে লেখা সম্ভবও না। অর্ধেক লিখেছি, বাকি অর্ধেক স্মৃতিতে চাপা পড়ে রইল।’

স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের প্রজন্মকে পাগল করে দিয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কবিতা আমাদের মুখে মুখে ফিরত। গল্প-উপন্যাস নিয়ে তুমুল আলোচনা এবং মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন থাকতাম। ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটি কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান মাতিয়ে রাখত। ‘যদি নির্বাসন দাও’ কবিতার সেই দুটি লাইন ‘বিষণ্ন আলোয় এই বাংলাদেশ, এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি’ আমাদের রক্তে দোলা লাগিয়েছে। প্রেমিক-প্রেমিকাদের মুখে মুখে ফিরছে ‘ভ্রু পল্লবে ডাক দিলে, দেখা হবে চন্দনের বনে’। এই কবিতাটি লেখার ইতিহাস সুনীলদা লিখেছেন। মধ্যরাতে একাকী বসে আছেন এক অচেনা স্টেশনে। তীব্র শীত। হঠাৎ একটি লাইন তাঁর মনে এলো। ‘ভ্রু পল্লবে ডাক দিলে, দেখা হবে চন্দনের বনে’। এই লাইনটি ভেবে সেই তীব্র শীতে উষ্ণ হয়ে উঠেছিলেন কবি। সুনীলদের সেই সব উন্মত্ত দিনে তাঁর আরেক কবিবন্ধু শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় লিখলেন, ‘মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করে চার যুবক।’ এই চার যুবক কে কে? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় আর আমাদের বেলাল চৌধুরী। পুলিশে ধরেছে কত রাত, কবরখানায় শুয়ে থেকেছেন, ধলভূমগড় নাকি চাইবাসা বেড়াতে গিয়ে বদ্ধ মাতাল হয়ে খোলা মাঠে ঘুমিয়ে পড়েছেন সদলে। সকালবেলা গ্রামের মানুষ চারদিক থেকে ঘেরাও করেছিল ডাকাত ভেবে মেরে ফেলার জন্য। এ রকম কত দুঃসাহসিক ঘটনা লুকিয়ে আছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনের পরতে পরতে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমি প্রথম দেখলাম ১৯৭৪ সালে। ফেব্রুয়ারি মাসে সেবার একটি সাহিত্য সম্মেলন হলো বাংলা একাডেমিতে। উদ্বোধন করলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্নদাশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে কলকাতার একদল লেখক-কবি এলেন ঢাকায়। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালবেলায় কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান। সভাপতিত্ব করছেন বেগম সুফিয়া কামাল। সেই অনুষ্ঠানে শক্তি চট্টোপাধ্যায় পড়লেন ‘অবনী বাড়ি আছ’ কবিতাটি। সুনীলদা প্রথমে একটি কবিতা পড়লেন। তারপর বেগম সুফিয়া কামালের অনুরোধে পড়লেন ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটি। প্যান্টের ওপর চেকের হাওয়াই শার্ট পরা। স্বাস্থ্যবান টগবগে একজন মানুষ। দেখে লেখক-কবি মনেই হয় না। আমি ততদিনে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি’ পড়ে ফেলেছি। ‘জীবন যেরকম’ উপন্যাসটি পড়েছি। আর ‘দেশ’ এ ধারাবাহিকভাবে পড়ছিলাম ‘একা এবং কয়েকজন’। ‘দেশ’ পত্রিকায় কিছু গল্প পড়েছি। ‘সনাতন পাঠক’ নামের কলামটি নিয়মিত পড়ি। ‘নীললোহিত’ ছদ্মনামের লেখাগুলো পড়ি। তখনো তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ ও ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ পড়া হয়নি। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকাটি নিয়মিত পড়ি। এই পত্রিকা ঘিরে যে লেখক কবির দল তাঁদের প্রত্যেকের সম্পর্কেই ধীরে ধীরে জানছি।

সুনীলদার সঙ্গে পরিচয় হলো আরও চার বছর পর ’৭৮ সালে। ঢাকায় এসে তিনি উঠেছিলেন গাজী শাহাবুদ্দিন, মানে আমাদের মনু ভাইয়ের বাড়িতে। ‘জোনাকী সিনেমা’ হলের পাশেই বাড়ি। নিচতলায় মনু ভাইয়ের পত্রিকা ‘সচিত্র সন্ধানী’র অফিস। নতুনভাবে পত্রিকাটি বেরোবার তোড়জোড় চলছে। আগে মাসিক পত্রিকা হিসেবে বেরোত। সেখানে সৈয়দ শামসুল হক লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘খেলারাম খেলে যা’। সেবার সুনীলদার সঙ্গে ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষও ছিলেন। ‘ইত্তেফাক’ ভবন থেকে সাপ্তাহিক ‘রোববার’ বের করার চেষ্টা চলছে। সেই পত্রিকায় জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে জয়েন করেছি। রোববারের পক্ষ থেকে ঢাকা ক্লাবে পার্টি দেওয়া হলো। সাগরময় ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, রশীদ করীম, রফিক আজাদ, রাহাত খানের সঙ্গে আমিও ছিলাম। তারপর কত নিবিড় পরিচয় সুনীলদার সঙ্গে। বাংলাদেশ কলকাতা মিলিয়ে কত আনন্দসন্ধ্যা একসঙ্গে কাটানো। নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেসে একসঙ্গে দিন কাটানো। ’৯৬-এর ইলেকশনে সুনীলদা এলেন ইলেকশন অবজারভার হয়ে। তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে যুক্ত করা হলো আমাকে। একসঙ্গে চার দিন বরিশালে কাটালাম। জীবনানন্দ দাশের ‘ধানসিঁড়ি নদী’ খুঁজে একদিনের অর্ধেক সময় চলে গেল। আশ্চর্য ব্যাপার, এলাকার লোকজন নদীটি চিনতেই পারছিল না। সেই নদীতে ঘণ্টা দুয়েক ঘুরে বেড়ানো। সারাটাক্ষণ সুনীলদা উদাস হয়ে থাকলেন। বরিশালের সবচেয়ে ভালো হোটেলে একটি রুম পেয়েছিলাম আমরা। পাশাপাশি দুটি বিছানা। ঘুমাবার আগে সুনীলদা বললেন, ‘আমি কিন্তু খুব নাক ডাকি। তুমি ঘুমাতে পারবে তো?’ ভাবলাম, কী আর নাক ডাকবেন সুনীলদা! নিশ্চয়ই ঘুমাতে পারব। তখনো কল্পনা করিনি কাণ্ডটা কী হতে যাচ্ছে। শোয়ার এক মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। তারপর শুরু হলো তাঁর নাক ডাকা। বাপ রে! নাক ডাকা কাহাকে বলে? আমার এক সময় মনে হলো সুনীলদার নাক ডাকার শব্দে বরিশাল শহরের সব মানুষ জেগে যাবে। কলকাতায় ফিরে গিয়ে এই ভ্রমণ নিয়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় তিনি একটি লেখা লিখেছিলেন ‘ধানসিঁড়ি নদীর সন্ধানে’। পরে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বই বেরোয় ‘ধানসিঁড়ি নদীর সন্ধানে ও অন্যান্য’ নামে।

ঢাকায় সৈয়দ আল ফারুক আর তাঁর স্ত্রী নাহিদ নাজিয়া, তার ডাকনাম বীথি, বীথির বাড়িতে সুনীলদাকে নিয়ে অনেক সন্ধ্যা আমরা কাটিয়েছি। বীথি খুব ভালো গান করে। তার গানে গল্পে জমে থাকত আড্ডা। কলকাতার আবৃত্তিকার সৌমিত্র মিত্র আর তাঁর স্ত্রী মুনমুন থাকত। অনুষ্ঠানের সব শেষ আকর্ষণ সুনীলদার গান। একটু টিপসি হয়ে উদাত্ত গলায় গান ধরতেন সুনীলদা। ‘তুই লাল পাহাড়ের দেশে যা, রাঙামাটির দেশে যা, হিথায় তোকে মানাইছে না গো ‘ইক্কেবারে মানাইছে না গো’। ‘ইক্কেবারে’ শব্দটায় এমন জোর দিতেন, শুনে আমরা হৈ হৈ করে উঠতাম। সুনীলদা প্রথম উপন্যাস লিখলেন ১৯৬৫ সালে। কবি হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে উঠছেন। টুকটাক গদ্য রচনা করেন। ‘দেশ’ পত্রিকায় ফিচার জাতীয় লেখা লেখেন পয়সার জন্য। সম্পাদক সাগরময় ঘোষ ডেকে বললেন, এবারের ‘দেশ’ পুজো সংখ্যায় তুমি উপন্যাস লিখবে। সুনীলদার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি সর্বগ্রাসী পাঠক। পড়েন সব কিছুই। বাংলা সাহিত্য ও পৃথিবীর সাহিত্যের বহু ভালো উপন্যাস পড়ে ফেলেছেন। নিজে উপন্যাস লেখার কথা ভাবেননি কখনো। কবিতা নিয়ে আছেন, নিজের ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা নিয়ে আছেন আর ব্যাপক আড্ডা-ঘোরাঘুরি তো আছেই। কিন্তু সাগরময় ঘোষের কথা তো ফেলা যাবে না। তিন মাস সময় দিয়েছেন। সুনীলদা প্রতিদিন সকালে কাগজ-কলম আর চা নিয়ে বসেন। এক লাইনও লেখা এগোয় না। কী নিয়ে উপন্যাস লিখবেন, তাই ঠিক করতে পারছেন না। একটি একটি করে দিন যাচ্ছে। প্রায় আড়াই মাস চলে গেল। সময় ফুরিয়ে আসছে। প্রবল অস্থিরতা নিয়ে ঘুম থেকে ওঠেন। চা নিয়ে চেয়ার টেবিলে বসেন। মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। লেখা হয় না এক লাইনও। এ রকম একদিন সকালবেলায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ছোট ভাই এসে খুবই রাগ করে বলল, ‘এসব আপনারা কী শুরু করেছেন? দাদা কাল রাতে বাড়ি ফেরেনি।’ সুনীলদা উপন্যাসের আইডিয়া পেয়ে গেলেন। নিজেদের ওই সময়কার জীবনযাত্রা নিয়েই উপন্যাস লিখবেন। টানা ১৫ দিনে লিখলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’। পাণ্ডুলিপি সাগরময় ঘোষের হাতে পৌঁছে দিয়ে কলকাতা থেকে উধাও হয়ে গেলেন। কারণ তাঁর ধারণা, ওটা উপন্যাস হয়নি। তিনি ‘দেশ’ পত্রিকা ডুবিয়ে দিয়েছেন। পুজো সংখ্যা বেরোল। তারও কয়েক দিন পর ভয়ে ভয়ে কলকাতায় ফিরলেন। কোথাও নিজের লেখা নিয়ে কিছু শুনছেন না। একদিন সাহস করে গেলেন ‘আনন্দবাজার’ অফিসে। লিফটে দেখা হলো রমাপদ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘তোমার উপন্যাস পড়তে শুরু করেছি। শেষটা যদি ভালো না হয় তাহলে খুন করে ফেলব।’

সুনীলদা একটু সাহস পেলেন। তারপর তো সাড়া ফেলে দিল ‘আত্মপ্রকাশ’। একেবারেই নতুন আঙ্গিকে নতুন ধরনের উপন্যাস। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা ছাপা হয়ে পড়ে আছে প্রেসে। পয়সার অভাবে ছাড়াতে পারছেন না। মাসিক ‘জলসা’ পত্রিকা উপন্যাস চাইল সুনীলদার কাছে। ওই প্রেসে বসে বসে টানা কয়েক দিন ধরে লিখলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। সেই উপন্যাস এগিয়ে গেল আরও কয়েক ধাপ। সত্যজিৎ রায় সিনেমা করে আন্তর্জাতিক মহলে পৌঁছে দিলেন। সুনীলদার ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসটি নিয়েও সিনেমা করলেন সত্যজিৎ রায়। উপন্যাসের নায়কের প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে কলকাতা শহর। তারপর কত লেখা সুনীলদার! পুজো সংখ্যায় কবিতা গল্প লিখছেন। ‘দেশ’, ‘আনন্দবাজার’ ও ‘আনন্দমেলা’ সর্বত্রই লিখতে হচ্ছে। একই হাউসের এতগুলো পত্রিকায় একই নামে লেখা ঠিক হবে না দেখে ‘নীললোহিত’ নামও ধারণ করলেন। এই নামে আগে এদিক-ওদিক নানা রকমের গদ্য লিখতেন। ততদিনে ‘দেশ’ পত্রিকায় জয়েন করেছেন। ‘সনাতন পাঠক’ ছদ্মনামে সাহিত্যের কলাম লিখছেন। বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে লিখে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রকে তিনি সাম্প্রদায়িক বললেন। লেখক পাঠক মহলে ব্যাপক ক্ষোভ।

নীললোহিত নামে প্রথম উপন্যাস লিখেছিলেন ‘আনন্দলোক’ পত্রিকায়। উপন্যাসের নাম ‘ছবিঘরে অন্ধকার’। স্কলারশিপ নিয়ে চলে গিয়েছিলেন আইওয়ায়। সেখানে পরিচয় হয়েছিল ফরাসিনী মার্গারিটের সঙ্গে। গভীর প্রেম। মার্গারিট ঘুরেফিরে তাঁর অনেক লেখায় এসেছে। তাকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছিলেন ‘সুদূর ঝর্ণার জলে’। অসামান্য প্রেমের উপন্যাস। স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়কে ভালোবেসেই বিয়ে করেছেন। স্বাতীদির পরিবার বনেদি ও অর্থশালী। এ রকম বোহেমিয়ান কবি লেখকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চায়নি পরিবার। তার পরও বিয়ে হলো। একমাত্র ছেলের ডাকনাম ‘পুপলু’। ভালো নাম সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়। সে ইঞ্জিনিয়ার। টরন্টোতে থাকে। বাংলাদেশের রংপুরের মেয়ে তার স্ত্রী। স্বাতীদি এক অসামান্য মানুষ। স্নিগ্ধ সুন্দর হাসিমুখের মানুষটি দুই বাহু দিয়ে আগলে রেখেছেন সুনীলদাকে সারাটি জীবন। কত সামান্য জিনিসে স্বাতীদিকে বিস্মিত হতে দেখেছি। অতি মায়াময় চরিত্র। সুনীলদার কথা কত বলব! ফুরাতেই তো চায় না। ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’ আর ‘প্রথম আলো’ এই তিন মহা উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ। ‘একা এবং কয়েকজন’ উপন্যাসটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন কমলকুমার মজুমদারকে। বইটি সাইজে বেশ মোটা। উৎসর্গ করেছিলেন কমলকুমার মজুমদারকে। বইটি তাঁকে পৌঁছে দিতে গিয়ে লিখলেন, ‘কমলদা আপনার খাটের পায়া যদি নড়বড়ে হয়ে যায় তাহলে এই বইটি সেই পায়ার তলায় দিয়ে রাখবেন।’ কমলকুমার সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘কমলকুমার মজুমদার হচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় ধাঁধা’। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত কমলকুমার মজুমদারের ‘গল্প সমগ্র’ ও ‘উপন্যাস সমগ্র’র ভূমিকা লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কত বইয়ের যে ভূমিকা লিখেছেন, বলে শেষ করা যাবে না। কত বই যে সম্পাদনা করেছেন। হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন ‘দুই বাংলার ভালোবাসার গল্প’। আমার সঙ্গে করেছেন তিনটি কিশোর গল্পের সংকলন। একজন লেখক এত কাজ করেন কীভাবে? তাঁর বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৪০০। কিশোর পাঠকরা ‘সন্তু ও কাকাবাবু’র জন্য পাগল। এক কিশোর পাঠক একবার চিঠি লিখে সুনীলদাকে বলেছিল, ‘আপনি অন্য কিছু লিখবেন না। শুধু ‘সন্তু ও কাকাবাবু’ লিখুন। তাঁর কিশোর উপন্যাস বড়রাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে। ‘সন্তু ও কাকাবাবু’র অ্যাডভেঞ্চার ছাড়া আনন্দমেলার পুজো সংখ্যা ভাবাই যেত না। আনন্দ পাবলিশার্স ছয় খণ্ডে প্রকাশ করেছে ‘কাকাবাবু সমগ্র’। ‘নীললোহিত সমগ্র’ও বেরিয়েছে। বহু আগে পাঁচ খণ্ডে বেরিয়েছিল তাঁর ‘গল্প সমগ্র’। প্রকাশক ‘বিশ্ববাণী’। এখন আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বেরোচ্ছে তাঁর ‘উপন্যাস সমগ্র’। ষোল খণ্ড বেরিয়ে গেছে। ছয় খণ্ডের ‘কবিতা সমগ্র’ও বের করেছে ‘আনন্দ’।

সুনীলদার কথা ভাবলে বিস্ময়ের শেষ থাকে না। দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করছেন, ‘বুধসন্ধ্যা’ নামের ক্লাব চালিয়েছেন। মঞ্চে অভিনয় করেছেন। এক নাটকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর সহ-অভিনেতা। সৌমিত্রর নয়, তাঁর অভিনয় বেশি প্রশংসিত হয়েছিল। সন্ধ্যার পর কখনো কলম ধরতেন না। তখন শুধু আড্ডা আর পানাহার। লিখতেন সকালবেলায়। দুপুরের দিকে যেতেন ‘দেশ’ পত্রিকার অফিসে। সেখানে করতেন কবিতা বাছাইয়ের কাজ। আমি একদিন তাঁর টেবিলে বসে আছি। করিডর দেখিয়ে বললেন, ‘ওই দেখো, একজন নায়িকা যায়।’ তাকিয়ে দেখি অপর্ণা সেন হেঁটে যাচ্ছেন। অপর্ণা সেন তখন ‘সানন্দা’ পত্রিকার সম্পাদক।

সুনীলদা ভ্রমণকাহিনি লিখলেন ‘রাশিয়া ভ্রমণ’। দুই জার্মানি যেদিন একত্র হচ্ছে সেদিন তিনি বার্লিনে। ফিরে এসে লিখলেন ‘ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ’। তাঁর অসামান্য ভ্রমণকাহিনি ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’। বাংলা সাহিত্যে এই বইটির কোনো তুলনা নেই। এই বইটির মধ্য দিয়ে ফরাসি দেশটা, সেই দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য আর বিখ্যাত শিল্পী-কবিদের অনুপুঙ্খ জানা যায়। কী যে আকর্ষণীয় ভাষায় লেখা! তার আগে আমেরিকা ভ্রমণ নিয়ে নীললোহিত নামে লিখেছিলেন ‘তিন সমুদ্র সাতাশ নদী’। ‘পায়ের তলায় সর্ষে’ নামে তাঁর দু’খণ্ডের ভ্রমণ সমগ্র বের করেছে ‘পত্রভারতী’।

নকশাল আন্দোলন যখন তুঙ্গে, বড় লেখকরা প্রায় সবাই সেই আন্দোলন নিয়ে উপন্যাস গল্প লিখছেন, সুনীলদা তখন হাঁটলেন একেবারে উল্টোপথে। তিনি চলে গেলেন পুরাণের দিকে। লিখলেন রাধা কৃষ্ণের প্রেমকাহিনি ‘রাধা কৃষ্ণ’। ভাষা ও আঙ্গিক মিলিয়ে এই উপন্যাসটির তুলনা হয় না। রবীন্দ্রনাথ ও লেডি রানু মুখার্জিকে নিয়ে লিখলেন ‘রানু ও ভানু’। আদিম যুগের মানুষ নিয়ে লিখলেন ‘আমিই সে’। বোধিসত্ত্বকে নিয়ে লিখলেন ‘নবজাতক’। কত রকমের এক্সপেরিমেন্ট করেছেন উপন্যাসে। ‘মায়াকাননের ফুল’ উপন্যাসের কোনো বাক্যেই ক্রিয়াপদ ছিল না। ‘স্বপ্ন লজ্জাহীন’ নামে কত আগে লিখেছিলেন আরেক নতুন ধরনের উপন্যাস। ‘স্বর্গের নিচে মানুষ’, ‘কালো রাস্তা সাদা বাড়ি’, ‘তুমি কে’, ‘সংসারে এক সন্ন্যাসী’ এ রকম কত উপন্যাস। লালন সাঁইকে নিয়ে লিখলেন ‘মনের মানুষ’। গৌতম ঘোষ সিনেমা বানালেন সেই উপন্যাস নিয়ে। বর্ডার এলাকার নারী পাচার বিষয় করে লিখলেন অসামান্য ‘জোছনা কুমারী’। ‘মহাপৃথিবী’, ‘রাতপাখি’, ‘গরম ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প’, ‘দেবদূত অথবা বারো হাটের কানাকড়ি’, ‘শাজাহান ও তার নিজস্ব বাহিনী’ এ রকম কত অবিস্মরণীয় গল্প। ‘গরম ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প’ হিন্দি ভাষায় সিনেমা হয়েছিল। নাম ‘গরম ভাত’। ছোটদের প্রথম উপন্যাস লিখেছিলেন ‘ডুঙ্গা’। ডুঙ্গা ছিল একটা কুকুরের নাম। ‘পাহাড় চূড়ায় আতঙ্ক’, ‘খালি জাহাজের রহস্য’, ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’ এ রকম ১০টি উপন্যাস নিয়ে ‘দশটি কিশোর উপন্যাস’ নামে তাঁর একটি সংকলন আছে। এসব লেখা ‘সন্তু ও কাকাবাবু’ সিরিজের বাইরে।

ঢাকায় এলে হুমায়ূন আহমেদের ফ্ল্যাটে অন্তত একটি সন্ধ্যা কাটাতেন সুনীলদা। হুমায়ূন আহমেদ ঠিক করলেন সাত পর্বে সুনীলদার একটি ইন্টারভিউ করাবেন আমাকে দিয়ে। তিনি পরিচালক। দুটি পর্ব বোধহয় রেকর্ড করা হয়েছিল। তারপর কাজটা আর এগোয়নি। সুনীলদা সময় দিতে পারেননি। সেই পর্ব দুটি কোথায় আছে কে জানে। হুমায়ূন আহমেদ চলে যাওয়ার পর এক রাতে স্বপ্ন দেখি, সুনীলদা আর আমি একটি সরু পাহাড়ি নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছি। ওপারে নিবিড় বনভূমি, তারপর পাহাড়। নদীতে হাঁটুজল। সুনীলদা কোনো কথা না বলে সেই নদী পেরিয়ে ওপারে গেলেন।

আমি এপার থেকে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি। ওপারে গিয়ে তিনি একবারও ফিরে তাকালেন না। ধীরপায়ে বনভূমির ভিতর মিলিয়ে গেলেন। তার কয়েক দিন পর সুনীলদা চলে গেলেন। তারিখটা ২৩ অক্টোবর ২০১২। বাথরুমে হার্ট অ্যাটাক করেছিল, সেখানেই পড়ে গিয়েছিলেন। আমার সৌভাগ্য এই মহান লেখক তাঁর ‘পঞ্চাশ বছর’ বইটি আমাকে উৎসর্গ করেছেন। সুনীলদার একটি উপন্যাসের নাম ‘নদীর ওপার’। কোন অচিন নদীর ওপারে চলে গেছেন আমাদের প্রিয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়!

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ খবর