পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে অর্থ জোগান এবং অবৈধ এনজিও চালানোর অভিযোগ তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। তার নামে পাওয়া গেছে আটটি ব্যাংক হিসাব পরিচালনার তথ্য। তার স্ত্রী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব সায়লা ফারজানা, শ্যালক রেজাউল আলম শাহীন, শ্যালকের স্ত্রী সানজিদা খানম টুম্পাসহ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ঘুষ, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের এক সিন্ডিকেট। নিজের পরিবার, শ্যালক ও নিকটাত্মীয়দের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে সেই অর্থ বৈধ করার চেষ্টা করেছেন তিনি। এ ছাড়া কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ (কেএসআর) ও শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল নামের দুটি এনজিও নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এ দুটি এনজিও রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা ও পুনর্বাসনের নামে গত সাত বছরে আসা হাজার হাজার কোটি টাকা অনুদান থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সাবেক এসবি প্রধানের বিরুদ্ধে। ওই সময় স্ত্রী ও শ্যালকের মালিকাধীন এস এস এন্টারপ্রাইজ এবং তানভীর ডেইরি ফার্মসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি স্থানান্তরের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া রাজধানীর মিরপুর ও উত্তরায় ৫০টির বেশি ফ্ল্যাট রয়েছে মনিরুলের স্ত্রী ও শ্যালকের নামে। জানা যায়, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) আট ব্যাংকে মনিরুলের হিসাব পরিচালনার বিষয়ে গত ৯ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন জমা দেয় দুদকে। প্রাথমিক পর্যালোচনার পর ১৩ জুলাই থেকে এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করে দুদক। এ ছাড়া জঙ্গিবাদে অর্থ জোগান এবং নিষিদ্ধ এনজিও চালানোর অভিযোগ তদন্ত শুরু হয় গত ৭ সেপ্টেম্বর থেকে।
দুদক সূত্র জানায়, সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, তার স্ত্রী সায়লা ফারজানা, শ্যালক রেজাউল আলম শাহীন, শ্যালিকা সাদিয়া, শাহিনের স্ত্রী সানজিদা খানম টুম্পা ও টুম্পার ভাই দেলোয়ার হোসেনসহ সংশ্লিষ্টদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ ও শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল নামের দুটি এনজিওর অনুদান দেখিয়ে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। মনিরুল ইসলাম এবং তার স্ত্রী সায়লা ফারজানা বিধিবহির্ভূতভাবে অর্থ উপার্জন করে সেই টাকা মনিরুলের শ্যালক রেজাউল আলম শাহীনের মালিকাধীন এস এস এন্টারপ্রাইজ এবং তানভীর ডেইরি ফার্মসহ বিভিন্ন নামে পরিচালিত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করে আত্মসাৎ এবং মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ করেছেন। সন্দেহজনক এনজিও প্রতিষ্ঠান কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ (কেএসআর) ও শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনালের হিসাব থেকে এসএস এন্টারপ্রাইজের হিসাবে বড় অঙ্কের অর্থ জমা ও উত্তোলনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে দুদকের উপ-পরিচালক আকতারুল ইসলাম বলেন, দুদক আইন ও বিধি মোতাবেক অনুসন্ধান চালাচ্ছে। আর অনুসন্ধান চলমান অবস্থায় অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে মন্তব্য করা যায় না। দুদকে জমা হওয়া অভিযোগ থেকে জানা যায়, কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ (কেএসআর) প্রতিষ্ঠানটির নামে ২০১৭ সালের ১২ অক্টোবর কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনের উত্তরা শাখায় হিসাব খোলা হয়। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ডা. গাজী মো. জহিরুল ও প্রজেক্ট ইনচার্জ একেএম রফিকুল হক হিসাব পরিচালনাকারী। এই হিসাবে গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৮৬৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা জমা এবং ৮৬৭ কোটি নয় লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। দুদক সূত্র আরও জানায়, মনিরুল ইসলামের শ্যালক রেজাউল আলম শাহীনের নামে কমিউনিটি ব্যাংক, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ১১টি হিসাব পরিচালনার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মেসার্স এস এস এন্টারপ্রাইজের নামে কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনের মিরপুর শাখার হিসাবটি ২০২৩ সালের ৮ ডিসেম্বর খোলা হয়। গত বছরের ২৯ আগস্ট পর্যন্ত ২৮৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা জমা ও ২৮৫ কোটি ৮ লাখ টাকা উত্তোলনের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গত বছরের ২৮ জুলাই মনিরুলের নামে পরিচালিত সিটি ব্যাংকের হিসাবে ৫০ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। ওই হিসাবে ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকার সরকারি চেক ও ৩ কোটি টাকা নগদ জমা হওয়ার নজিরও রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনে ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকার দুটি এফডিআরসহ প্রায় ৭ কোটি টাকা রয়েছে। তার অন্যান্য হিসাবের মধ্যে কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনের আরেক হিসাবে ঋণের ২ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের বিভিন্ন সময়ে তার প্রতিষ্ঠান মেসার্স এস এস এন্টারপ্রাইজের হিসাবে ৩ কোটি ২১ লাখ টাকার সন্দেহভাজন লেনদেনের তথ্য মিলেছে।
অভিযোগ থেকে আরও জানা যায়, মনিরুল ইসলামের স্ত্রী সায়লা ফারজানার ঢাকা ব্যাংক পিএলসির বৈদেশিক বাণিজ্য শাখায় গত বছর দুই দফায় তার ভাইয়ের কমার্শিয়াল ব্যাংকের হিসাব থেকে ১৫ লাখ ও ২০ লাখ টাকা জমা হয়। মনিরুল ইসলামের শ্যালকের স্ত্রী সানজিদা খানম টুম্পার নামে ২০২০ সালে কমিউনিটি ব্যাংক পিএলসির হিসাবে ১১ কোটি ৭০ লাখ টাকা জমা হয় এবং প্রায় সমপরিমাণ টাকা উত্তোলনও করা হয়। একজন গৃহিণীর হিসাবে স্বল্প সময়ে ২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার চারটি ডিপিএস এবং ৬ কোটি ২১ লাখ টাকার তিনটি এফডিআর থাকা অস্বাভাবিক। জানা যায়, টুম্পার বিভিন্ন লেনদেনের মধ্যে রয়েছে- তার নামে সাউথইস্ট ব্যাংকের মিরপুর শাখায় পরিচালিত হিসাবে ২০২০ সালের জুন মাসে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা জমা হয়। এ অর্থ তার স্বামীর মালিকানাধীন এস এস এন্টারপ্রাইজের নামে পরিচালিত কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনের হিসাব থেকে এসেছে। ওই বছরের ২৮ জুন টুম্পার নামে পরিচালিত কমিউনিটি ব্যাংকের হিসাবে ছয়টি লেনদেনের মাধ্যমে ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা স্থানান্তর করেছে। একই মাসে কমিউনিটি ব্যাংকে টুম্পার হিসাবে মনিরুল ইসলামের স্ত্রী সায়লা ফারজানার বোন সাদিয়া আহম্মেদের হিসাব থেকে ৫৭ লাখ টাকা জমা হয়। ওই টাকাসহ টুম্পার নামে কমিউনিটি ব্যাংকে দুই কোটি টাকা স্থায়ীভাবে জমা হয়। এরপর ২০২২ সালে টুম্পার নামে ওই হিসাবে ঢাকা ব্যাংক থেকে ৪৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা, শাহিনের বোন সাদিয়ার হিসাব থেকে ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা এবং তার সাউথইস্ট ব্যাংকের হিসাব থেকে ৬৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা জমা হয়। সব অর্থ উত্তোলন করে দুই কোটি টাকার এফডিআর করা হয়। এছাড়া গতবছর বিভিন্ন সময়ে সানজিদা খানম টুম্পার নামে ঢাকা ব্যাংকের হিসাবে এফডিআর নগদায়নের মাধ্যমে ৭৮ লাখ ৯৪ হাজার টাকা জমা হয় এবং সেই অর্থ থেকে ৭৫ লাখ টাকা টুম্পার ভাই দেলোয়ার হোসেনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান উপমা ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে স্থানান্তরের তথ্য পাওয়া গেছে। জানা যায়, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসির কক্সবাজার শাখার গ্রাহক বিসমিল্লাহ কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড সাপ্লাইয়ার্স লিমিটেডের মালিক মোজাম্মেল হকের নামে পরিচালিত হিসাবে ২০১৯ সালের ৮ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা এস এস এন্টারপ্রাইজের নামে পরিচালিত কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন পিএলসির হিসাব হয়ে উত্তোলন করা হয়। আবার এস এস এন্টারপ্রাইজের নামে পরিচালিত কমার্শিয়াল ব্যাংকের অপর একটি হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়- ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাবে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা নগদ জমা, ৫৭ কোটি ২ লাখ টাকা এনজিওর হিসাব থেকে জমা, ১৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা নগদ উত্তোলন, ৩৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। যেখানে অর্থ জমাকারী তানভীর আহম্মেদ, সোহাগ হোসেন, শরীফুল ইসলাম ও হাবিবুর রহমানের নাম এসেছে। আর সানজিদা খানম টুম্পার ভাই ও উপমা ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী দেলোয়ার হোসেন এবং তার প্রতিষ্ঠানের নামে চলতি হিসাব, ঋণ হিসাব, স্থায়ী আমানত হিসাবসহ প্রায় ৩২টি হিসাব পাওয়া গেছে। যেখানে ২৮ কোটি টাকা জমা হওয়ার তথ্য মিলেছে।