সংবিধান রাষ্ট্রের মূল আইন। ১৯৭২ সালের আজকের দিনে (৪ নভেম্বর) প্রণয়ন হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান। আর একই বছর ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয় এটি। গত ৫৩ বছরে নানা প্রেক্ষাপটে সংশোধনের নামে ১৭ বার কাটাছেঁড়া করা হয়েছে এই সংবিধান। স্বাধীনতার এই পাঁচ দশক পর রাষ্ট্রের মূল আইনি কাঠামোকে ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা এখন শুধু রাজনৈতিক নয়, গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনজ্ঞদের মতে, একটি বিতর্কমুক্ত সংবিধান রচনা ও বাস্তবায়নই এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর সংবিধান নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। সংবিধান কতটা কার্যকর রয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সংসদ ভেঙে দেওয়া, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, রাষ্ট্রপতি অপসারণসহ নানা বিষয়ে দেখা দিয়েছে সাংবিধানিক জটিলতা। এ প্রেক্ষাপটে সংবিধান সংস্কারের দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। পরে রাষ্ট্র সংস্কারে বিভিন্ন কমিশন গঠনের সঙ্গে সংবিধান সংস্কারেও অন্তর্বর্তী সরকার একটি কমিশন গঠন করে। সংবিধানের বেশ কিছু সংশোধনীর প্রস্তাব দিয়ে ওই কমিশন তাদের সুপারিশও দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে। সর্বশেষ রাষ্ট্র সংস্কারে ঐকমত্য কমিশন যে ৮৪ দফা সুপারিশ দিয়েছে, তার ৪৮টিই সংবিধান সংস্কার বিষয়ে। এখন এসব সংস্কার কিভাবে হবে, তা নিয়ে চলছে আলোচনা। সুপারিশ বাস্তবায়ণে গণভোট আয়োজনের কথাও বলা হয়েছে সুপারিশে। আইনজ্ঞরা বলছেন, ঐক্যমত্য কমিশনের সুপারিশের অধিকাংশ সাংঘর্ষিক, অস্পষ্ট ও আইনি বৈধতাবিহীন, যা ভবিষ্যতে সাংবিধানিক জটিলতা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
জানা গেছে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদেই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে চারবার। শুধু একটি সংসদে অর্থাৎ ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মেয়াদের সপ্তম সংসদে কোনো সংশোধনী আনা হয়নি। সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় ব্যবস্থা পাল্টে দিয়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা যেমন প্রবর্তন করা হয়েছিল, অন্যদিকে দুবার সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমেই। গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনে বিজয়ের পর ৯০-এর দশকের শুরুতে দেশে আবার সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হয়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংসদে সংবিধানের এই সংশোধনী পাস হয়েছিল। নির্বাচনি ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনে রাজনৈতিক সরকারের বদলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। আবার পরে পাল্টা সংশোধনী এনে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক দ্রুততার সঙ্গে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদের (সংসদ) যাত্রা শুরু হয়েছিল। গণপরিষদে সংবিধান বিল গৃহীত হয়েছিল ৪ নভেম্বর। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে কার্যকর হয়েছিল সংবিধান। বলা হয়ে থাকে, এত অল্প সময়ে আর কোনো দেশে সংবিধান প্রণয়নের নজির নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণপরিষদের সদস্য এবং রাজনীতিকদের নিয়ে ৩৪ সদস্যের কমিটি করা হয়েছিল ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল। আট মাসের মধ্যেই কমিটি সংবিধানের খসড়া তৈরি করেছিল।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিটি দেশেরই সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটা কাটাছেড়া বা সংশোধন করা যায়। প্রয়োজন অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের পদ্ধতি সংবিধানের মধ্যেই দেওয়া আছে। সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোন পরিবর্তনের সুযোগ নেই। কেউ করতে চাইলে, সেটা অসাংবিধানিক হবে। তিনি বলেন, আবার এই সংশোধনের মাধ্যমে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলো কি না, এ গুলো দেখার ক্ষমতা আমাদের সুপ্রিম কোর্টকে দেওয়া আছে।
তিনি বলেন, বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের সময়ে দেখা যাচ্ছে, সাংবিধানিক বিভিন্ন বিষয় শুধু একটা অধ্যাদেশের মাধ্যমে বদলে দেওয়া হচ্ছে। এটা একটা অবৈধ প্রক্রিয়া। একটা কাগজ দিয়ে আপনি অধ্যাদেশ জারি করে দিলেন, তাতে কিছু যায় আসে না। সংবিধান তার জায়গায় থেকে যাবে। আজকে না হোক, সময়ের আলোকে সেগুলো অবৈধই ঘোষণা হবে। কোনদিন সেটা বৈধ হবে না।
তিনি বলেন, কিছু লোক সংবিধান বাতিল চায়। সংবিধানকে ছুড়ে ফেলতে চায়। এটার একটাই কারণ, এই সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করা। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে তৈরি করা। যারা মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বাস করেন না, তারাই সংবিধান ছুড়ে ফেলতে চায়।
সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে ঐক্যমত্য কমিশনের দেওয়া সুপারিশকে অসাংবিধানিক ও অবাস্তব বলে মন্তব্য করেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তার এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ঐকমত্য কমিশন তাদের ৮৪টি সুপারিশ সম্পর্কিত একটি দলিল প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছেন এবং এতে তারা সবাই স্বাক্ষর করেছেন। জানতে পেরেছি, ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৪৮টিই সংবিধানসংক্রান্ত। বলা হয়েছে, এ প্রস্তাবগুলোর ওপরে গণভোট হবে। গণভোট কবে হবে, সেটি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। কেউ চাচ্ছে আগে, কেউ চাচ্ছে পরে, কেউ চাচ্ছে একই দিনে। এ বিতর্ক কীভাবে সমাধান হবে, সেটিতে আমরা যাব না। তিনি আরও লিখেন, ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে যতগুলো সংবাদমাধ্যমে আসছে, তাতে দেখছি, সবই বর্তমান সংবিধানের পরিপন্থি বা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তিনি আরও লিখেছেন, প্রশ্ন হলো, এ ৪৮টি সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো-দেখে, পড়ে, বুঝে মতামত দিতে পারবেন কয়জন লোকে? সংবিধানের চর্চা কিন্তু জেলা আদালতে হয় না। জেলা আদালতে হয় দেওয়ানি মামলা আর ফৌজদারি মামলা। সংবিধানের চর্চা হয় শুধু সুপ্রিম কোর্টে। এটি জেলা আদালতের বিচারক এবং আইনজীবীদের সাধারণত করতে হয় না। যেখানে দুই-চার-পাঁচ হাজার আইনজীবীর মধ্যেই সংবিধানটা সীমাবদ্ধ, সেখানে দেশের সাধারণ জনগণ, এমনকি সুপ্রিম কোর্টের বাইরে থাকা অন্যান্য আদালতের আইনজীবীরাও যেহেতু এটা চর্চা করেন না, অতএব তাদের পক্ষেও এটি পড়ে বুঝে মতামত তৈরি করা বা সিদ্ধান্তে আসা খুবই দুষ্কর হবে।
সংবিধান দিবসের কর্মসূচি : দেশের সংবিধান প্রণয়নের এই দিনটি (৪ নভেম্বর) দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে মাত্র দুবারই জাতীয় দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন হয়েছে। ২০২২ সালে দিবসটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। এরপর ২০২৩ সালেও যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়। তবে গত বছর থেকে অন্তর্বর্তী সরকার দিবসটিকে জাতীয় দিবসের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে।
আগামী ৬ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে গণফোরাম সংবিধান দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন।